নজিরবিহীন ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট, নন্দিত-নিন্দিত ‘পলক’
সারা বিশ্বে ইন্টারনেট একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগের মাধ্যম। বাংলাদেশেও এর প্রভাব রয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংকিং, বিনোদনসহ প্রতিটি খাতে ইন্টারনেটের ব্যবহার অপরিহার্য। ইন্টারনেটের অপ্রতুলতা বা অপ্রাপ্যতা জনজীবনকে পুরোপুরি স্থবির করে দেয়। ফলে ইন্টারনেটকে মৌলিক মানবাধিকারের অংশ হিসেবেও গণ্য করা হয়। কিন্তু চলতি বছরের জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের কর্মসূচি ঘিরে টানা পাঁচ দিন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট এবং আট দিন মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে রাখা হয় সরকারি নির্দেশনায়।
টেলিযোগাযোগ খাতে এমন নজিরবিহীন ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের ঘটনা শুধু এ বছর নয় বরং দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। এর পেছনের কারিগর হিসেবে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ভূমিকা রেখেছিলেন বলেও অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট নিয়ে ‘সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করেনি, ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেছে’; শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর জন্য ফেসবুককে দায়ী করে দেওয়া বক্তব্যসহ নানা কারণে পলক সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হন।
বিজ্ঞাপন
একই সঙ্গে সারা বছরের মধ্যে নজিরবিহীন ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের ওই ঘটনা দেশব্যাপী তীব্র বিতর্ক ও সমালোচনার জন্ম দেয়। মূলত, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে ১৭ জুলাই রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট এবং ১৮ জুলাই রাতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করে আওয়ামী সরকার। পাঁচ দিনের মাথায় ২৩ জুলাই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ সীমিত পরিসরে চালু করা হয়। ১০ দিন পর ২৮ জুলাই মোবাইল ইন্টারনেট চালু হয়। কিন্তু ফেসবুকসহ মেটার অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রাম বন্ধ রাখা হয়। স্বল্পদৈর্ঘ্যের ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম টিকটকও বন্ধ ছিল। সর্বশেষ ৫ আগস্ট বেলা ১১টা নাগাদ ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়।
আরও পড়ুন
নিন্দিত হয়েছেন নন্দিত ‘পলক’
অভিযোগ রয়েছে, সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের নির্দেশে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এ ব্ল্যাকআউট কার্যকর করে। যদিও শুরুতে পলক দাবি করেছিলেন, মহাখালীর খাজা টাওয়ারের ডেটা সেন্টারে অগ্নিকাণ্ডের কারণে ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হয়। তবে পরে তদন্তে জানা যায়, অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে ইন্টারনেট শাটডাউনের কোনো সম্পর্ক ছিল না। বরং, এটি পলকের মৌখিক নির্দেশে এবং সরকারদলীয় লোকজনের সহায়তায় সম্পন্ন করা হয় বলে অভিযোগ করে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি)।
অন্যদিকে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) ১৭-২৮ জুলাই এবং ৫ আগস্ট মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের জন্য নির্দেশনা প্রদান করে। ফলে জনজীবনে চরম ভোগান্তি এবং দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে পরবর্তী সময়ে এটি স্পষ্ট হয় যে, ইন্টারনেট বন্ধ করার সিদ্ধান্তটি একাধিক দপ্তরের সমন্বয়ে নেওয়া হয়। একই সঙ্গে এ ধরনের ঘটনার ফলে নাগরিক অধিকার এবং তথ্যপ্রবাহের স্বাধীনতা সম্পর্কেও নতুন প্রশ্ন সামনে আসে।
টেলিযোগাযোগ খাতে এমন নজিরবিহীন ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের ঘটনা শুধু এ বছর নয় বরং দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। এর পেছনের কারিগর হিসেবে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক ভূমিকা রেখেছিলেন বলেও অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট নিয়ে ‘সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করেনি, ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেছে’; শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর জন্য ফেসবুককে দায়ী করে দেওয়া বক্তব্যসহ নানা কারণে পলক সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হন
‘পলক’ আউট, ‘নাহিদ’ ইন
২০০৮ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন পলক। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য হন। এর আগে, ২০১৪ সালে তিনি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেশের আইসিটি খাতে নেতৃত্ব দেন। তবে, সরকারের পতনের পর তুরুপের তাসের মতো ভেঙে পড়ে তার সিন্ডিকেট। দেশ থেকে পালাতে গিয়েও ব্যর্থ হন। ৬ আগস্ট বিমানবন্দর থেকে তাকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ১০ বছরের বেশি সময়ের ‘পলকনামা’ বন্ধ হয়ে যায়।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর ৯ আগস্ট নতুন করে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। অবশ্য আন্দোলনকারী ছাড়াও নাহিদ ইসলামের রয়েছে রাজনৈতিক পরিচয়। তিনি গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির কেন্দ্রীয় নেতা। ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ থেকে বেরিয়ে ডাকসু’র সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনের নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয়েছিল গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি। কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক তিনি।
আরও পড়ুন
নাহিদ ইসলামের ডাকনাম ‘ফাহিম’। জন্ম ১৯৯৮ সালে ঢাকায়। বাবা শিক্ষক। মা ঘর সামলে সন্তানদের মানুষ করেছেন। ছোট এক ভাই রয়েছে তার। নাহিদ পড়েছেন সরকারি বিজ্ঞান কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘিরে তাকে দুবার আটক করা হয়। প্রথমবার, ১৯ জুলাই সাদা পোশাকধারী কয়েকজন তার বন্ধুর বাড়ি থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায়। চোখে কাপড় বেঁধে, হাতকড়া পরিয়ে তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। দুদিন পর পূর্বাচলে একটি ব্রিজের নিচে নিজেকে আবিষ্কার করেন নাহিদ। দ্বিতীয়বার, ২৬ জুলাই ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তাকে তুলে নেওয়া হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সারা দেশে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা হবে বলে জানান অন্তর্বর্তী সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ওই ঘটনায় সরকারের লোক, মন্ত্রী বা অন্য যে কোনো সংস্থার লোক জড়িত থাকলে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। তথ্য প্রবাহের অবাধ ব্যবহার এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করার নিশ্চয়তা মানুষের মানবাধিকারের বিষয়। তারা এটি বন্ধ করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে।
আরও পড়ুন
১৬ বছর ধরে হরিলুট
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের আওতাধীন দপ্তর, সংস্থায় ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়িত ও বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের সামগ্রিক মূল্যায়ন করা হয়। এতে দুর্নীতি, অনিয়ম, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে মূল্যায়ন করা হয়।
২০২৪ সালের ২২ আগস্ট গঠিত চার সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি ৯০ দিনের পর্যালোচনা শেষে প্রতিবেদন দাখিল করে। কমিটি প্রকল্পগুলোর সমাপ্তি রিপোর্ট, অডিট আপত্তি, ক্রয় কার্যক্রম ও কর্মপরিকল্পনার অগ্রগতি পর্যালোচনা করে। তাদের বিশ্লেষণে প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা চ্যালেঞ্জ ও ব্যর্থতার দিক উঠে আসে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্প গ্রহণের সময় যথাযথ সমীক্ষা এবং অংশীজনদের সঙ্গে পরামর্শের অভাবে অনেক প্রকল্পের কার্যপরিধি ও ডিজাইন বারবার পরিবর্তন করতে হয়। ফলে সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি পায় এবং প্রকল্প থেকে প্রাপ্ত সুবিধাগুলো জনগণের কাছে পৌঁছাতে দেরি হয়। কিছু প্রকল্পের আর্থিক, প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক প্রভাব সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। ফলে প্রকল্পগুলো কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হয়। অনেক প্রকল্পের অডিট আপত্তি এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। যা আর্থিক স্বচ্ছতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তদুপরি, বেশকিছু প্রকল্পের সমাপ্তি রিপোর্ট জমা না দেওয়ায় প্রকল্পের কার্যকারিতা নিরূপণ কঠিন হয়ে পড়ে।
বছরশেষে চ্যালেঞ্জ কাটাতে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। এক্ষেত্রে প্রকল্প গ্রহণের সময় অংশীজনদের সঙ্গে পরামর্শ এবং সঠিক সমীক্ষার মাধ্যমে চাহিদা ও কার্যপরিধি নির্ধারণ করা, অডিট আপত্তি দ্রুত নিষ্পত্তি করা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের সমস্যা এড়াতে পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
একই সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নিয়মিত পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা, আর্থিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ভ্যাট-ট্যাক্স নিয়মিতভাবে জমা দেওয়া, প্রকল্প পরিচালকের দক্ষতা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা এবং প্রকল্প অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গে পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
আরএইচটি/