ফেঁসে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা?
চাঙা হচ্ছে পদ্মা সেতুর দুর্নীতিসহ আধা ডজন মামলা
১০ বছর আগে নিষ্পত্তি হওয়া আলোচিত পদ্মা সেতু দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের মামলার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। যেখানে সন্দেহভাজনের তালিকায় ছিলেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী। ওই মামলায় তাদের আসামি করা না হলেও তৎকালীন সেতু সচিবসহ সাতজনকে আসামি করা হয়। পরবর্তীতে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। আলোচিত মামলাটির তদন্ত পুনরায় শুরু করতে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
শুধু তা-ই নয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার নির্মাণে দুর্নীতির তিন মামলা এবং মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয়সংক্রান্ত দুর্নীতিসহ পুরাতন আধা ডজন মামলা নতুন করে তদন্ত করার চিন্তাভাবনা করছে সংস্থাটি। এ ছাড়া আলোচনায় আছে ফ্রিগেট (যুদ্ধজাহাজ) ক্রয়সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলা; মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্র, ভাসমান বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বেপজায় পরামর্শক নিয়োগসংক্রান্ত দুর্নীতির মামলা।
বিজ্ঞাপন
ইতোমধ্যে এসব মামলার যাবতীয় নথিপত্র যাচাই–বাছাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। শিগগিরই আগের মামলার প্রতিবেদন ও অভিযোগ যাচাই করে কমিশনের অনুমোদনক্রমে নতুন করে তদন্ত করবে সংস্থাটি।
পদ্মা সেতু দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার নির্মাণসংক্রান্ত দুর্নীতি মামলা, নাইকো দুর্নীতি মামলা, আটটি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয়সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলাসহ আধা ডজন মামলার তদন্ত কার্যক্রম নতুন করে শুরু করার চিন্তাভাবনা করছে দুদক
বিষয়টি নিশ্চিত করে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ৮০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের অনুসন্ধান কার্যক্রম চলমান আছে। এ ছাড়া বিগত ১৬ বছরে অনেক মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নেও নানা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি আগের দুর্নীতির মামলাগুলোর নিষ্পত্তি নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।
আরও পড়ুন
‘বর্তমান কমিশন সব বিতর্কিত মামলা নতুন করে পর্যালোচনা করে তদন্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। কমিশন অনুমোদন দিলেই আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু হবে। বিশেষ করে পদ্মা সেতু দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলা ও নভোথিয়েটার নির্মাণসংক্রান্ত দুর্নীতির তিন মামলাসহ মোট চারটি মামলাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। দুদকের আইন অনুবিভাগের মতামতের ভিত্তিতে মামলাগুলোর তদন্ত শুরু হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিষয়গুলো আমার জানা নেই। চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে কি না, তা জেনে জানাতে পারব। আপাতত এ বিষয়গুলো নিয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে পারছি না।’
আরও পড়ুন
পদ্মা সেতু দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলা
২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানী থানায় (মামলা নং- ১৯) মোট সাতজনের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করে দুদক। সেতু বিভাগের তৎকালীন সচিব মোশাররফ হোসেইন ভূঁইয়া, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌস, সাবেক সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রিয়াজ আহমেদ জাবের, ইপিসি’র উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মোস্তফা, কানাডীয় প্রকৌশলী প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস, আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ ও সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল এ মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি ছিলেন। দীর্ঘ দেড় বছরের অধিক সময় তদন্ত শেষে ২০১৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মামলাটি থেকে আসামিদের অব্যাহতি দেয় দুদক। দুদকের উপ-পরিচালক মীর্জা জাহিদুল আলমের নেতৃত্বাধীন একটি টিম মামলাটি তদন্ত করে।
পদ্মা সেতু দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলার এজাহারে সন্দেহভাজনের তালিকায় ছিলেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও প্রাক্তন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী। মামলা থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়া প্রসঙ্গে তৎকালীন দুদক চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান বলেছিলেন, ওই মামলাটি ছিল দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের মামলা। তদন্তে আরও তথ্য পাওয়ার আশায় আমরা মামলা দায়ের করি। তদন্তকালে দেশে এবং কানাডায় গিয়ে দুদকের তদন্ত দল অভিযান চালায়। দুদক টিম কানাডায় গিয়ে কিছু কাগজপত্র সংগ্রহ করে। বিশ্ব ব্যাংকের আশ্বাসের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করা হলেও প্রমাণের জন্য দাতা সংস্থা ও কানাডা থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ফলে শেষ পর্যন্ত মামলা থেকে সব আসামিকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার নির্মাণে দুর্নীতি মামলা
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততা আছে— এমন সন্দেহে বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার নির্মাণসংক্রান্ত দুর্নীতির তিনটি মামলার তদন্ত কার্যক্রমও নতুন করে শুরু হতে যাচ্ছে। ২০০২ সালের ২৭ মার্চ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে আগের মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্ট একনেক সদস্যদের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় মামলা তিনটি দায়ের করে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো।
আরও পড়ুন
ব্যুরো বিলুপ্ত হয়ে দুদক গঠিত হলে মামলাগুলো কমিশনে হস্তান্তর হয়। তিনটি মামলার একটিতে সাতজন, একটিতে আটজন এবং অপরটিতে ১২ জনকে আসামি করা হয়। ২০০৫ সালের ২৪ আগস্ট বিচারপতি সুলতান হোসেন খানের কমিশন মামলা তিনটির চার্জশিট দাখিলের নির্দেশ দেন। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে দুটি রিট আবেদন করেন। ২০১০ সালের ৪ মার্চ চার্জশিট দাখিলের আদেশ অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল, মামলা তিনটি অসৎ উদ্দেশ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে (শেখ হাসিনা) হেয়প্রতিপন্ন করতে দায়ের করা হয়েছিল। মামলায় মাওলানা ভাসানীর নাম পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার নির্মাণে প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগে দুর্নীতি, অবৈধভাবে ব্যয় বৃদ্ধি করে রাষ্ট্রের ৫২ কোটি টাকা ক্ষতিসাধনের অভিযোগ আনা হয়।
প্রক্রিয়াধীন আরও ৬ মামলা
দুদক সূত্রে জানা যায়, আদালত থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অব্যাহতি পাওয়া দুর্নীতির পুরাতন আরও ছয়টি মামলা নতুন করে তদন্ত করা হবে। মামলাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো নাইকো দুর্নীতি মামলা। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অর্থাৎ ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর বিদেশি প্রতিষ্ঠান নাইকোকে তিনটি গ্যাস ফিল্ড থেকে অবৈধভাবে গ্যাস উত্তোলনের সুযোগ দেওয়ার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়। সেখানে অভিযোগ করা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে নাইকো রিসোর্সকে অবৈধভাবে ১৭৯৪ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলনের সুযোগ দিয়ে রাষ্ট্রের ১৩ হাজার ৬৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতিসাধন করেছেন।
আটটি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয়ের দুর্নীতির অভিযোগে বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোর সময় অর্থাৎ ২০০১ সালের ১১ ডিসেম্বর দুর্নীতির মামলাটি করা হয়। মামলায় শেখ হাসিনাসহ পাঁচজনকে আসামি করা হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়, ১৯৯৯ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে নীতিমালা লঙ্ঘন করে রাশিয়া থেকে ১৬টি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি করেন। এর মধ্যে আটটি সরবরাহ করা হয় এবং এর মূল্য হিসেবে ১২ কোটি ৯০ লাখ ইউএস ডলার বা তৎকালীন মুদ্রামানে ৭০০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। ১৬টির মধ্যে আটটি সরবরাহ না হওয়ায় সরকারের প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়
এ ছাড়া আটটি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয়ের দুর্নীতির অভিযোগে বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোর সময় অর্থাৎ ২০০১ সালের ১১ ডিসেম্বর দুর্নীতির মামলাটি করা হয়। মামলায় শেখ হাসিনাসহ পাঁচজনকে আসামি করা হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়, ১৯৯৯ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে নীতিমালা লঙ্ঘন করে রাশিয়া থেকে ১৬টি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি করেন। এর মধ্যে আটটি সরবরাহ করা হয় এবং এর মূল্য হিসেবে ১২ কোটি ৯০ লাখ ইউএস ডলার বা তৎকালীন মুদ্রামানে ৭০০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। ১৬টির মধ্যে আটটি সরবরাহ না হওয়ায় সরকারের প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়।
আরও পড়ুন
অন্যদিকে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় অর্থাৎ ২০০২ সালের ৭ আগস্ট বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরো ফ্রিগেট কেনায় দুর্নীতির অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে কোরিয়ান ফ্রিগেট ক্রয় দুর্নীতি মামলাটি করে। মামলায় দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে নৌবাহিনীর জন্য পুরাতন যুদ্ধজাহাজ ফ্রিগেট কেনায় সর্বনিম্ন দরদাতা চীনা কোম্পানির পরিবর্তে চতুর্থ সর্বনিম্ন দরদাতা দক্ষিণ কোরিয়ান কোম্পানিকে কাজ দিয়ে রাষ্ট্রের ৪৪৭ কোটি টাকা ক্ষতিসাধনের অভিযোগ আনা হয়।
এ ছাড়া মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে দুর্নীতির অভিযোগে ২০০১ সালের ১১ ডিসেম্বর রমনা থানায় এ সংক্রান্ত মামলাটি দায়ের করে বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরো। ২০০২ সালের ১৪ অক্টোবর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ মামলায় চার্জশিটও দেওয়া হয়। মামলার অভিযোগে বলা হয়, মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রের ১৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে।
আরও পড়ুন
বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের নামে তিন কোটি টাকা চাঁদা নিয়ে খুলনায় ভাসমান বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে সর্বনিম্ন দরদাতাকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয় দরদাতাকে কাজ দেওয়ার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে আরও একটি দুর্নীতির মামলা করা হয়। ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর তেজগাঁও থানায় মামলাটি দায়ের হয়। এ ছাড়া ২০০১ সালের ১১ ডিসেম্বর বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরো খুলনায় ভাসমান বিদ্যুৎকেন্দ্র দুর্নীতি মামলাটি করে। মামলায় বেপজায় পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির ফলে রাষ্ট্রের দুই কোটি ১০ লাখ এক হাজার ৬৮৮ টাকা ক্ষতিসাধনের অভিযোগ আনা হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে।
আরএম/