বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) আরোপিত মাসিক ৬ শতাংশ হারে অস্বাভাবিক সারচার্জ দিতে হয়। মাসিক বকেয়া পাওনার ওপর বছর শেষে এ সারচার্জ দাঁড়ায় ৭২ শতাংশে। ফলে বাংলাদেশে সাময়িকভাবে বন্ধ হওয়া এয়ারলাইন্সগুলো আর ফিরতে পারছে না। মাত্রাতিরিক্ত এমন চার্জ অব্যাহত থাকলে যে কোনো পরিস্থিতিতে বন্ধ হয়ে যেতে পারে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলো।

বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনাকারী এয়ারলাইন্সগুলোর মালিকেরা বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত এ সারচার্জের কারণে অনেক এয়ারলাইন্স দেনা শোধ করতে পারছে না। দেনার চাপে তারা দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। সময় মতো পাওনা পরিশোধ করতে না পারলে সারচার্জ দিয়ে পাওনা পরিশোধের নিয়ম অনেক দেশেই আছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বেবিচকের হার অনেক বেশি।

বেশ কয়েকটি দেশের সিভিল এভিয়েশনের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশে এ সারচার্জ ৮ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ১২ শতাংশ, ওমানে ১০ শতাংশ এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রতিষ্ঠান ভেদে ১২ থেকে ১৮ শতাংশ, পাকিস্তানে আন্তঃব্যাংকিং এক্সচেঞ্জ রেটের ওপর ২ শতাংশ। বর্তমানে বেবিচকের বকেয়ার ওপর মাসে ৬ শতাংশ হারে বছরে সারচার্জ দিতে হচ্ছে ৭২ শতাংশ।

সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশে এ সারচার্জ ৮ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ১২ শতাংশ, ওমানে ১০ শতাংশ এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রতিষ্ঠান ভেদে ১২ থেকে ১৮ শতাংশ, পাকিস্তানে ২ শতাংশ। তবে, পাকিস্তানে চার্জের সঙ্গে ব্যাংকের কিছু চার্জ যুক্ত হয়। বর্তমানে বেবিচকের বকেয়ার ওপর মাসে ৬ শতাংশ হারে বছরে সারচার্জ দিতে হচ্ছে ৭২ শতাংশ

এয়ারলাইন্সের মালিকেরা বলছেন, যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, পাশাপাশি ডলারের মূল্যবৃদ্ধি— এ দুই কারণে এয়ারলাইন্স ব্যবসা বিরাট ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এর ওপর মোটা অঙ্কের সারচার্জ আরও বেশি সংকট তৈরি করেছে। সাময়িকভাবে স্থগিত হওয়া দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলো অতিরিক্ত সারচার্জের ভরে পিষ্ট হচ্ছে। ফলে তাদের পক্ষে আর ফিরে আসা সম্ভব হচ্ছে না।

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত প্রায় ডজনখানেক কমার্শিয়াল, কার্গো ও প্রাইভেট প্লেন ভাড়া দেওয়া প্রতিষ্ঠান তাদের অপারেশন শুরু করেও একপর্যায়ে বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। তাদের অধিকাংশেরই ছিল তারল্য সংকট। বাকিদের টেনে তুলতে তেমন কোনো উদ্যোগ ছিল না সরকার কিংবা বেবিচকের।

জানা যায়, ২০০০ সালে অপারেশন শুরু করে এয়ার বাংলাদেশ। পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া এয়ার পারাবত, জিএমজি এয়ারলাইন্স, রয়েল বেঙ্গল এয়ারলাইন্স, বেস্ট এয়ার, মিড এশিয়া এয়ারলাইন্স, টিএইচটি এয়ার সার্ভিসেস, ভয়েজার এয়ারলাইন্স বাংলাদেশ, জুম এয়ারলাইন্স, ইউনাইটেড এয়ার ও রিজেন্ট এয়ারওয়েজও কারও সহযোগিতা না পেয়ে টিকে থাকতে পারেনি।

মাত্রাতিরিক্ত এ সারচার্জের কারণে অনেক এয়ারলাইন্স দেনা শোধ করতে পারছে না। দেনার চাপে তারা দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। সময় মতো পাওনা পরিশোধ করতে না পারলে সারচার্জ দিয়ে পাওনা পরিশোধের নিয়ম অনেক দেশেই আছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বেবিচকের হার অনেক বেশি

বকেয়ার চাপে পিষ্ট ইউনাইটেড-জিএমজি-রিজেন্ট

২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠার দশম বছরে আগাম ঘোষণা ছাড়াই ফ্লাইট অপারেশন বন্ধ করে দেয় ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। বন্ধ হওয়ার সময় ইউনাইটেড বলেছিল, বহরে থাকা ১০টি উড়োজাহাজের সবকটির রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। এ ছাড়া তাদের ওই সময় এত টাকাও ছিল না। দুই সপ্তাহ পর ফিরে আসার আশা ব্যক্ত করলেও আর ফিরতে পারেনি সংস্থাটি।

বন্ধ হওয়ার সময় এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠানটির কাছে বেবিচকের পাওনা ছিল ৫৫ কোটি টাকা। তবে, বকেয়া সারচার্জ যুক্ত হয়ে পাওনা গিয়ে ঠেকে ৩৫৫ কোটি টাকায়। এয়ারলাইন্সটি চালু করতে ২০২৩ সালের শুরুর দিকে নতুন সাতজন স্বতন্ত্র পরিচালক বসায় বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এভিয়েশন ও ভ্রমণবিষয়ক সাময়িকী ‘বাংলাদেশ মনিটর’ সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলমকে পর্ষদের চেয়ারম্যান করা হয়।

ফ্লাইট পরিচালনার জন্য ইউনাইটেড এয়ারওয়েজকে এয়ার অপারেটিং সার্টিফিকেট (এওসি) নবায়ন করতে হতো। তবে, বেবিচকের পাওনা ৩৫৫ কোটি টাকা না দিলে নবায়ন হতো না এওসি। ইউনাইটেডের পক্ষ থেকে ৩৫৫ কোটি টাকার মধ্যে মূল দেনা ৫৫ কোটি টাকা পরিশোধের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে সারচার্জ মওকুফের সম্মতিও দেওয়া হয়। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। ফলে সারচার্জের চাপায় চিরতরে ধ্বংস হয় ইউনাইটেডের ফেরার স্বপ্ন।

২০০০ সালে অপারেশন শুরু করে এয়ার বাংলাদেশ। পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া এয়ার পারাবত, জিএমজি এয়ারলাইন্স, রয়েল বেঙ্গল এয়ারলাইন্স, বেস্ট এয়ার, মিড এশিয়া এয়ারলাইন্স, টিএইচটি এয়ার সার্ভিসেস, ভয়েজার এয়ারলাইন্স বাংলাদেশ, জুম এয়ারলাইন্স, ইউনাইটেড এয়ার ও রিজেন্ট এয়ারওয়েজও কারও সহযোগিতা না পেয়ে টিকে থাকতে পারেনি

এদিকে, ২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করা জিএমজি এয়ারলাইন্স ২০১২ সালে এসে বন্ধ হয়ে যায়। ফ্লাইট বন্ধের কারণ হিসেবে তারা ‘জেট ফুয়েলের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং নতুন ব্যবসায়িক পরিকল্পনা নেওয়ার উদ্যোগ’-এর কথা জানায়। ২০১৩ সালের মধ্যে ফিরে আসার ঘোষণা দিয়েও আর ফিরতে পারেনি তারা। ফ্লাইট বন্ধের সময় জিএমজির কাছে বেবিচকের পাওনা ছিল প্রায় ২০০ কোটি টাকা। সময় মতো পরিশোধ না করায় তা চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েছে। এ ছাড়া শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জিএমজির একটি উড়োজাহাজ এখনও পড়ে আছে। সেটির সারচার্জসহ বর্তমানে দেনার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০০ কোটি টাকায়। অতিরিক্ত চার্জের কারণে জিএমজির অধিকাংশ শেয়ারের ক্রেতা বেক্সিমকো গ্রুপ এটি আর চালু করতে আগ্রহ দেখায়নি।

অন্যদিকে, ২০২০ সালের মার্চে করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় সব ধরনের ফ্লাইট স্থগিত করা রিজেন্ট এয়ারওয়েজের কাছে বেবিচকের পাওনা ছিল ২৮৩ কোটি টাকা। ২০২১ সালে আবারও ফ্লাইট পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছিল সংস্থাটি। সে সময় বেবিচকের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন রিজেন্টের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আশিস রায় চৌধুরী। দেনার বিষয়ে তারা বেবিচকের সঙ্গে একটা সমঝোতা করতে চেয়েছিল। তবে, বেবিচক কোনোভাবেই মোটা অঙ্কের বিলে ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিল না। তাই আর ফিরতে পারেনি সংস্থাটি।

অযৌক্তিক সারচার্জে বাংলাদেশে কোনো এয়ারলাইন্স টিকতে পারবে না

বিশিষ্ট এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এবং ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের পরিচালনা পর্ষদের (পুনর্গঠিত) সাবেক চেয়ারম্যান ও বিমানের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশের সারচার্জ অনেক বেশি। বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত যত এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, এর বেশির ভাগই বন্ধ হয়ে গেছে। তারা কিছুদিন ফ্লাইট পরিচালনার পর সারচার্জের টাকা দিতে না পেরে সার্ভিস বন্ধ করে দেয়।

‘বাংলাদেশের সারচার্জ নিঃসন্দেহে অনেক বেশি ও অকার্যকর। এ হারে সারচার্জ নির্ধারণ করলে বাংলাদেশে কোনো এয়ারলাইন্স টিকতে পারবে না। এয়ারলাইন্স শিল্পকে বিকশিত করার জন্য সারচার্জকে যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে আনতে হবে। ব্যাংক থেকে লোন নিলে বছরে ১৩ থেকে সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশ সুদ দিতে হয়। অথচ বেবিচক অস্বাভাবিক হারে নিচ্ছে এবং এর পেছনে কোনো যুক্তি তারা দিতে পারছে না।’

এ বিষয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও উইং কমান্ডার এ টি এম নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়েছেন এয়ারলাইন্সের মালিকেরা। এটাকে (সারচার্জ) যৌক্তিক পর্যায়ে অর্থাৎ মাসিক ১ শতাংশ হারে বছরে ১২ শতাংশ নির্ধারণ করার অনুরোধ করা হয়। কিন্তু সেটা এখনও করা হয়নি। আমার বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন্স বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক এয়ারলাইন্স সাময়িকভাবে বন্ধ হতেই পারে। কিন্তু মোটা অঙ্কের সারচার্জের জন্য তাদের ফিরে আসার সক্ষমতা আর থাকে না। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে দেখে এটা অবিলম্বে সংস্কার করা উচিত, যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করা উচিত।’

এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এওএবি) সাধারণ সম্পাদক ও নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মফিজুর রহমান বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে আমরা সারচার্জ কমানোর দাবি করে আসছি। এওএবির পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার লিখিতভাবে বেবিচক, অর্থ ও বিমান মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী, সচিব ও উপদেষ্টাকে জানানো হয়েছে। তবে, কোনো সাড়া পাইনি। এ বছরও দুবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। আমরা এটাকে যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার জোর দাবি জানাচ্ছি।’

হ্যাঙ্গার চার্জও আকাশচুম্বী

এওএবি জানায়, দেশের এয়ারলাইন্স ও হেলিকপ্টার পরিচালনা করা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বেবিচক অতিরিক্ত চার্জ আদায় করছে। আগে এয়ারলাইন্স অপারেটররা নিজস্ব হ্যাঙ্গার ব্যবস্থাপনার জন্য মাসে সর্বোচ্চ দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা ভাড়া হিসেবে ব্যয় করত। বর্তমানে বেবিচক কর্তৃক নির্মিত হ্যাঙ্গারে আকার ভেদে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা মাসিক ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। আকাশচুম্বী এ ব্যয় কোনো অপারেটরের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। যদিও ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে সিএএবি ও এওএবি’র মধ্যে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে করার কথা ছিল। কিন্তু সিএএবি এককভাবে এ ভাড়ার বোঝা অপারেটরদের কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এআর/