ইমেজ রক্ষায় স্ত্রীকে খুন করেন বাবুল আক্তার!
একের পর এক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও জঙ্গি গ্রেফতার, জঙ্গি আস্তানা ও অস্ত্র উদ্ধার করে সারা দেশে প্রশংসিত হয়েছিলেন তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তার। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে তাকে দেওয়া হয়েছিল একাধিক পুরস্কারও। এসব পুরস্কার ও সফলতার গল্পের পেছনে ছিল বাবুল আক্তারের আরেক কালো অধ্যায়। যা শুধু জানতেন তার প্রথম স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু।
স্বামীর অনৈতিক কর্মকাণ্ড দীর্ঘদিন মুখ বুঝে সহ্য করেছিলেন মিতু। একটি মাত্র আশা, দুই সন্তানের কথা ভেবে সঠিক পথে ফিরে আসবেন বাবুল আক্তার। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ফিরে না আসায় বাবুল আক্তারের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন মিতু। তার এমন আচরণে কিছুটা শঙ্কিত হয়ে পড়েন বাবুল আক্তার। নিজের পজিশন (অবস্থান) ও ইমেজ (ভাবমূর্তি) নষ্ট হওয়ার শঙ্কা ঢোকে বাবুল আক্তারের মধ্যে।
বিজ্ঞাপন
অবশেষে নিজের ইমেজ, পজিশন ও আয়েশি জীবনধারা অব্যাহত রাখতে স্ত্রীকে হত্যার মতো পরিকল্পনা নেন বাবুল আক্তার। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের মাধ্যমে খুন করান মিতুকে।
স্বামীর অনৈতিক কর্মকাণ্ড দীর্ঘদিন মুখ বুঝে সহ্য করেছিলেন মিতু। একটি মাত্র আশা, দুই সন্তানের কথা ভেবে সঠিক পথে ফিরে আসবেন বাবুল আক্তার। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি
‘মিতুকে হত্যার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে’— ঢাকা পোস্টের কাছে তা ব্যাখ্যা করতে এসব কথা বলেন মিতুর বাবা ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন। তার মতে, স্বামী বাবুল আক্তারের অনৈতিক কর্মকাণ্ড জেনে যাওয়ায় মিতুকে হত্যা করা হয়।
মেয়ে হত্যায় মোশাররফ হোসেনের মনে যে সন্দেহ
মিতুর বাবা ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাবুল আক্তার তৎকালীন পুলিশের একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা ছিলেন। ভালো কাজের পাশাপাশি তার অনেক খারাপ কাজও ছিল। সেগুলো তার অফিসের অনেকে জানলেও ভয়ে কেউ মুখ খুলতেন না। তবে মনে রাখতে হবে, বাসার কাজের মেয়ে এবং নিজের স্ত্রীর কাছে সবকিছু গোপন করা অসম্ভব। সত্য প্রকাশ পাবেই।
তিনি বলেন, ভারতীয় এনজিওকর্মী গায়েত্রী অমর সিংয়ের সঙ্গে বাবুল আক্তারের অনৈতিক সম্পর্কসহ আরও কিছু অপরাধের কথা জেনে যায় মিতু। বিষয়গুলো সে আমাদের জানায়। তখন তাকে (মিতু) আমরা বলি, বাবুল আক্তারকে ছেড়ে ঢাকায় চলে আসতে। কিন্তু রাজি হয়নি মিতু। সে বলে, দুটো ছেলে-মেয়ের দিকে তাকিয়ে বাবুল একদিন ফিরে আসবে। কিন্তু সে (বাবুল আক্তার) আর ফিরে আসেনি। অনৈতিক কাজের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে মিতু তখন মুখ খুলতে শুরু করে। এসব কাজ থেকে বিরত থাকতে বাবুলকে একাধিকবার বলে। কিন্তু বাবুল তার কথা না শুনে উল্টো মিতুর ওপর নির্যাতন শুরু করে।
মোশাররফ হোসেন আরও বলেন, ‘বাবুল যখন দেখেছে মিতু তার অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেছে, তখন তার মনে হয়তো ভয় ঢুকে যায়। সে (বাবুল আক্তার) চিন্তায় পড়ে যায় যে, তার এসব অপকর্মের কথা যদি মিতু বলে দেয় তাহলে তার সুনাম ও পজিশন সবকিছু ধুলায় মিশে যাবে। যেহেতু বাবুল তখন খুবই প্রশংসিত পুলিশ অফিসার ছিলেন। তাই নিজের পজিশন ও সুনাম রক্ষায় ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে আমার মেয়েকে হত্যা করায়।’
মেয়ে হত্যার ন্যায়বিচার পাবেন কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলনে, বাবুলকে পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) গ্রেফতার করেছে। এক শ্রেণির পুলিশ কর্মকর্তারা চাইবেন বাবুল আক্তারের সাজা হোক যাতে সবার কাছে এ বার্তা যায় যে, পুলিশ কাউকে ছাড় দেয় না। আরেক শ্রেণির কর্মকর্তারা চাইবেন, নিজেদের লোক যেন সাজা না পায়। তবে পিবিআইয়ের তদন্ত ও আদালতের ওপর আমাদের আস্থা আছে। আমরা আশা করি ন্যায়বিচার পাব।
স্ত্রী হত্যার কথা এখনো স্বীকার করেননি বাবুল আক্তার
গত ১২ মে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেনের করা মামলায় বাবুল আক্তারকে গ্রেফতার করে পিবিআই। যদিও এর আগে তদন্ত সংস্থাটি মিতু হত্যার সঙ্গে বাবুল আক্তারের সংশ্লিষ্টতা পায়। বাবুল আক্তারকে গ্রেফতারের পর পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। আদালত তা মঞ্জুর করেন। রিমান্ডে তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। জিজ্ঞাসাবাদে বাবুল আক্তার মিতু হত্যার বিষয়টি সবসময় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে তিনি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার কথা জানান।
গত ১৭ মে বাবুল আক্তারকে আদালতে তোলা হয়। কিন্তু আদালতে স্ত্রী হত্যার বিষয়ে জবানবন্দি দিতে রাজি হননি আবুল আক্তার। পরে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। জবানবন্দি না দেওয়ার বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাবুল আক্তার প্রথমে আমাদের বলেছিলেন যে, আদালতে গিয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেবেন। কিন্তু আদালতে গিয়ে তিনি জবানবন্দি দিতে অস্বীকৃতি জানান।’
বাবুল আক্তার মিতু হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেছেন কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, ‘তিনি ১৬৪ ধারা করেননি, ডিকলাইন করেছেন।’ রিমান্ডে তিনি ‘খুনের’ কথা স্বীকার করেছেন কি না— প্রশ্নের জবাবে সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, ‘আমাদের কাছে স্বীকার করেও তো লাভ নেই। আদালতে গিয়ে স্বীকার করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘বাবুল আক্তার রিমান্ডে আমাদের কাছে মিতু হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য দিয়েছেন। তদন্তের বিষয় নিয়ে এর বাইরে আর কিছু বলতে পারব না।’
বাবুল আক্তারকে নতুন করে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হবে কি না— জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, এ বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি।
হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য নিয়ে পিবিআই যা বলছে
মিতু হত্যা মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট পিবিআই কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিনের তদন্তে তারা নিশ্চিত হয়েছেন এবং তাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য রয়েছে যে, বাবুল আক্তার মিতু হত্যার পরিকল্পনাকারী। তিনি টাকা দিয়ে এবং সোর্স কামরুল ইসলাম শিকদার মুছাকে দিয়ে হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছেন। হত্যার মোটিভ হিসেবে গায়েত্রী অমর সিংয়ের সঙ্গে বাবুল আক্তারের অনৈতিক সম্পর্কসহ বেশ কয়েকটি কারণ উঠে এসেছে। তবে হত্যার প্রকৃত উদ্দেশ্য উদঘাটনে এখনো কাজ করছে পিবিআই। মিতু হত্যার পেছনে বাবুল আক্তারের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী ছিল, দ্রুত সেটা বের হবে বলে আশা করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মিতু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বাবুল জড়িত, শুধু এটা প্রমাণ করলেই হবে না। কোন উদ্দেশ্যে বাবুল আক্তার মিতুকে হত্যা করেছেন, সেটাও বের করতে হবে। আমরা চেষ্টা করছি মিতু হত্যাকাণ্ডের মোটিভ বের করার জন্য। আশা করি তদন্ত শেষ হলে মোটিভ জানা যাবে।
মুছা কোথায়, জানে না কেউ
মাহমুদা খানম মিতু হত্যায় দায়ের করা প্রথম মামলার বাদী ছিলেন সাবেক পুলিশ সুপার স্বামী বাবুল আক্তার। ‘কিলার’ মুছার প্রশ্নে মামলাটি প্রায় থমকে গিয়েছিল। তবে তদন্তে অনেকটা নাটকীয়ভাবে এখন স্বামী বাবুল আক্তারই অভিযুক্ত। নতুন করে দায়ের হওয়া হত্যা মামলায় প্রধান আসামিও তিনি। তবে তার ঘনিষ্ঠ ‘সোর্স’ কামরুল ইসলাম শিকদার মুছা কোথায়? তা জানেন না কেউ।
এদিকে, স্বামী ফিরে আসবেন— এমন আশায় অপেক্ষায় আছেন মুছার স্ত্রী পান্না আক্তারও। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে তার কথা হয় ঈদের আগের দিন রাতে। তিনি বলেন, ‘ঈদের আগের রাতে আমি মিনতি করছি, আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। ২০১৬ সালের ২২ জুনের পর থেকে আমি ও আমার সন্তানরা তাকে পাইনি। অনেক দিন মুখ বন্ধ রেখেছি। আর নয়, আমার স্বামীকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। দোষী হোক, নির্দোষ হোক, আগে স্বামীকে ফেরত চাই।’
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। ওই সময় এ ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত হয়। ঘটনার সময় মিতুর স্বামী পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার অবস্থান করছিলেন ঢাকায়। ঘটনার পর চট্টগ্রামে ফিরে তৎকালীন পুলিশ সুপার ও মিতুর স্বামী বাবুল আক্তার পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমের জন্য স্ত্রীকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বলে মামলায় অভিযোগ করেন তিনি। তবে দিন যত গড়িয়েছে মামলার গতিপথও পাল্টেছে। একপর্যায়ে সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে আসে স্বামী বাবুল আক্তারের নাম। তদন্তে তার বিরুদ্ধেই হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত ১১ মে ডেকে তাকে হেফাজতে নেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
১২ মে দুপুরে বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন তার শ্বশুর অর্থাৎ মিতুর বাবা। মামলায় আসামি করা হয় আরও সাতজনকে। তারা হলেন- কামরুল ইসলাম মুছা, কালু, ওয়াসিম, শাহজাহান, আনোয়ার, এহতেসামুল হক ভোলা ও সাকি।
এদিকে, স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলার প্রধান আসামি বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ড শেষ বাবুল আক্তার এখন কারাগারে আছেন।
এমএসি/এমএআর