স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আমূল সংস্কার চান চিকিৎসক নেতারা
দেশের স্বাস্থ্য খাতের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস এসে তা অনেকটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। করোনা সংক্রমণের কারণে গোটা দেশ যখন বিপর্যস্ত, তখন মাস্ক কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে করোনা পরীক্ষার ভুয়া সনদ, স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালকের বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগে দুর্নীতিসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বেশকিছু খবর সবার নজর কাড়ে। অভিযোগ রয়েছে, এসব অনিয়মে জড়িত অনেকে এখনো বহাল তবিয়তে এখানে কর্মরত আছেন।
এ অবস্থায় স্বাস্থ্যের উন্নয়ন এবং মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে পুরো ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের তাগাদা দিয়েছেন চিকিৎসক নেতারা। তাদের মতে, যিনি প্রশাসন চালাবেন তার স্বাস্থ্য বিভাগ বোঝার দক্ষতা থাকতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগকে বোঝার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকলে এটি সম্ভব নয়। ফলে যারা এখানে আসবেন, তাদের স্বাস্থ্য প্রশাসক হতে হবে। দীর্ঘ সময় তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি বন্ধ হবে কবে?
এ বিষয়ে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) সভাপতি ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে আমূল পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে জিরো টলারেন্সের কথা বলছেন, সেটা যদি বাস্তবায়ন করতে হয় তাহলে আমাদের অবশ্যই সেই জায়গাগুলোতে সৎ ও মেধাবী লোকের প্রয়োজন। শুধু সৎ হলেও হবে না, আবার শুধু মেধাবী হলেও হবে না। আমরা দেখতে পাচ্ছি এ জায়গাগুলোতে বসে মেধাবী ও অসৎ লোকেরা কী করছে, আবার সৎ ও মেধাহীন লোকেরা কী করছে। এজন্য সরকারের প্রয়োজন মেধাবী ও সৎ লোকদের খুঁজে বের করা এবং তাদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে বসানো।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা অনেক আগে থেকে পৃথক পেশাজীবী মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি জানিয়েছি। চিকিৎসকদের মন্ত্রণালয় যদি চিকিৎসকরাই পরিচালনা করেন, তাহলে তারা বিষয়গুলো ভালো বুঝবেন। কোথায় কী তুলে ধরতে হবে, কোথায় কী প্রয়োজন, কোনটাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে বা চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় সঠিকভাবে কী পদক্ষেপ নিলে তা বেশি কার্যকর হবে—এ বিষয়গুলো এ পেশার লোক ভালো বুঝবেন। পেশার বাইরের লোক সেটা বুঝবেন না।’
ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘সবমিলিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটা আমূল পরিবর্তন দরকার। এখানে স্বাস্থ্য প্রশাসন আছে, শিক্ষা কার্যক্রম আছে, স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম আছে— সবগুলোতে একটা পরিবর্তন জরুরি। বিশেষ করে স্বাস্থ্য প্রশাসনটা ঢেলে সাজানো দরকার। স্বাস্থ্য প্রশাসন কেমন হবে সেটা বঙ্গবন্ধুই দেখিয়ে গেছেন। তিনি তার সাড়ে তিন বছরের সময় স্বাস্থ্য সচিব করেছিলেন একজন চিকিৎসককে। এ কারণে আজ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে অবকাঠামো ও ভিত্তি, সেটা তৈরি হয়েছিল।’
‘আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাস্থ্য খাতের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য প্রশাসনের সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাবে সেই উন্নয়নে পূর্ণতা আসেনি। পূর্ণতা পেত যদি সেখানে কোনো চিকিৎসক নেতৃত্ব দিতেন’— যোগ করেন স্বাচিপ সভাপতি।
একই ধরনের মত দেন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটিস (এফডিএসআর)-এর উপদেষ্টা ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ডা. আব্দুন নূর তুষার। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে দুর্নীতিবাজদের সাজা দেওয়া দরকার। শুদ্ধি অভিযান নয়, শুদ্ধি অভিযান মানে আপনি আগে দুর্নীতি করেছেন, এখন ভালো/শুদ্ধ হয়ে যান। এখানে যারা দুর্নীতি করেন তাদের ভালো হওয়ার সুযোগ দেওয়ার কিছু নেই। তারা যে অন্যায়গুলো করেছেন, সেগুলোর সাজা হওয়া উচিত। কঠোর বিচার হওয়া উচিত।'
আক্ষেপ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘গত ১০ বছরে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির দায়ে কয়জন লোকের সাজা হয়েছে? আবজাল আর মিটুদের কিছুই হয় না। আমরা দেখেছি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ড্রাইভার ১০০ কোটি টাকার মালিক। এমন রিপোর্টও হয়েছে কিন্তু তার কিছু হয়নি। একটা মন্ত্রণালয়ের ড্রাইভার (গাড়িচালক) যদি ১০০ কোটি আয় করেন, তাহলে সচিব-উপসচিবসহ অন্যরা কী পরিমাণ টাকা আয় করেন, চিন্তা করা যায়!’
‘এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে অভিযান চালাতে হবে, দোষীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। ওনারা (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা) ফাইলের একটা নথির ছবি তোলায় এত উত্তেজিত হয়ে যান, আর ওনাদের থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি হয়, সেটা নিয়ে ওনারা কিছুই করতে পারেন না’— যোগ করেন তিনি।
আব্দুন নূর তুষার আরও বলেন, ‘একজন যোগ্য প্রশাসকের অধীনে মন্ত্রণালয়টা যেতে হবে। যিনি প্রশাসন চালাবেন, তার স্বাস্থ্য বিভাগ বোঝার দক্ষতা থাকতে হবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে যথেষ্ট জ্ঞানও থাকতে হবে। অন্যথায় সম্ভব নয়। তাদের দীর্ঘ সময় স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতাও থাকতে হবে।’
‘আমলারা কি পুলিশকে চালাতে পারবেন? কিন্তু তারা কিন্তু চিকিৎসকদের ঠিকই চালাচ্ছেন। পুলিশ আর চিকিৎসক হলো ২৪ ঘণ্টার একটা পেশা। এখানে মানুষের জীবন-মৃত্যু সম্পৃক্ত। দক্ষতা, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার বিষয় এটি। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যারা পরিচালনা করেন তাদের সেই প্রশিক্ষণ নেই, অভিজ্ঞতাও নেই।’
জনপ্রিয় এ চিকিৎসক নেতা আরও বলেন, ‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কারই এখন বড় প্রয়োজন। পুরো ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে আধুনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। যেখানে থাকবে আলাদা স্বাস্থ্য প্রশাসন। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রশাসন সাধারণ প্রশাসনের মতো নয়। এটি অনেকটা সেনাবাহিনীর মতো। তাদের যেমন আলাদা নিয়মকানুন আছে, স্বাস্থ্যেরও আলাদা নিয়মকানুন আছে। সাধারণ চাকরির মতো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নয়। চিকিৎসকের ফাইল আর সচিবালয়ের ফাইল কিন্তু এক নয়। একেক রোগীর জন্য আলাদা আলাদা ফাইল। তাদের ফাইলগুলো অন্য কেউ ধরতে পারেন না।’
স্বাস্থ্য খাতে প্রশাসনের কর্তৃত্ব চান না চিকিৎসকরা
দেশের স্বাস্থ্য খাতে প্রশাসনের কর্তৃত্ব মেনে নিতে চান না চিকিৎসক নেতারা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন অধিদফতর ও অধিদফতরের অধীন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সব পদে চিকিৎসকদের নিয়োগের পক্ষে তারা। এমনকি স্বাস্থ্য খাতের যেকোনো প্রকল্প ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এবং স্বাস্থ্যগত দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ারও মত তাদের।
সম্প্রতি স্বাস্থ্যের বড় পদগুলোতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের রাখা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসক কর্মকর্তাদের উপেক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেন চিকিৎসক নেতারা। সমস্যার সমাধান না হলে শিগগিরই আন্দোলনে নামারও ঘোষণা দেন তারা।
করোনা মহামারি মোকাবিলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিরোধ পরিকল্পনা সাজালেও বাংলাদেশে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা তা করতে গিয়ে ‘বিজ্ঞানকেও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছেন’ বলে অভিযোগ চিকিৎসক নেতা ডা. ইকবাল আর্সলানের। তিনি বলেন, ‘এ দেশের বিজ্ঞানীরা যে পরামর্শ দিচ্ছেন, সেগুলো পাশ কাটিয়ে তাদের (প্রশাসন ক্যাডার) নিজেদের মনগড়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন। আমলারা ব্রিটিশ আমলের শাসন ব্যবস্থা অনুযায়ী সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। নিয়ন্ত্রণের মানসিকতা থেকে এসব করা হচ্ছে। কোভিড মহামারির সময় আরেকটা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা।’
‘অতিমারি উপলক্ষে দেশটা দখলের একটা পাঁয়তারা করছেন তারা। এটা আমরা মেনে নিচ্ছি না। এর আগে যখন এ ধরনের কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল আমরা তাদের হুঁশিয়ার করেছিলাম। কিন্তু হুঁশিয়ারিটা…, আসলে তাদের কানে পানি যাচ্ছে না। যদি কানে পানি দিতে হয় তাহলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) অতীতে যেভাবে সব আন্দোলন পরিচালনা করেছে, ভবিষ্যতেও করবে।’
কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালক স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের অধীনস্থ একটি পদ। কিন্তু তিনি স্বাস্থ্যের মহাপরিচালককে পাত্তাই দেন না— অভিযোগ বিএমএ মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরীর। তিনি বলেন, ‘সিএমএসডির পরিচালক পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়ার সময় চিকিৎসকরা প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু সে সময় তাদের কথা শোনা হয়নি।’
‘তিনি অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি না সেক্রেটারি আমাদের বিবেচ্য নয়। তিনি একজন পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছেন, সুতরাং মহাপরিচালকের সভায় তাকে আসতে হবে। যদি না পোষায় তাহলে চলে যান, কে আসতে বলেছে এখানে? দিস ইজ মাই হোম।’
এ প্রসঙ্গে স্বাচিপের সাধারণ সম্পাদক ডা. এম এ আজিজ বলেন, ‘প্রশাসন ক্যাডারে অতিরিক্ত সচিবের পদ ১১৩টি। কিন্তু অতিরিক্ত সচিব করা হয়েছে ৬১০ জনকে। তাদের পদায়নের জন্যই বিভিন্ন জায়গায় নতুন নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিভিন্ন বিভাগে অ্যাডমিনের (প্রশাসন) লোকজন ঢোকানো হচ্ছে। নার্সিং, পরিবার পরিকল্পনায় তাদের লোকজন বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা আমাদের কাজের পরিবেশ তৈরি করে দেবেন, তা না করে খবরদারি করছেন।'
বিএমএ সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, ‘বাংলাদেশের চিকিৎসকদের পিঠে আরেকবার ছুরি বসানোর চেষ্টা হচ্ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আপনি জানেন কি না আমি জানি না, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনেক কাজে চিকিৎসক কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে আমলাতান্ত্রিক করা হচ্ছে।’
টিআই/এমএআর/