২০১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর; ১১ বছরের আফসানা মায়ের সঙ্গে ঢাকা আসে। কাজ শেষে বাড়িতে ফেরার পথে কালো পোশাকধারী এক দল লোক তুলে নেয় মা রেজিয়া বেগম ও আফসানাকে। কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে অজানা স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। একটি গোপন কক্ষে নিয়ে আফসানার সামনেই মাকে মারধর করা হয়। দেখানো হয় ভয়ভীতি। পরের দিন আফসানাকে কমলাপুরে ফেলে গেলেও মায়ের খোঁজ মেলেনি এখনও। এভাবেই কেটে গেছে নয় বছর।

গাবতলীর শ্যামলী বাস কাউন্টারের সামনে থেকে হোমল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সের কক্সবাজার শাখার ম্যানেজার রেজিয়া বেগমকে ওই দিন গুম করা হয়। রেজিয়া বেগম রেজির ছেলে সাজেদুল কবির সাজেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মাকে হারিয়ে আমরা দিশাহারা হয়ে পড়ি। আমার ছোট বোন তার স্বাভাবিক জীবনটা হারিয়ে ফেলে। চরম আতঙ্কের মধ্যে পার হচ্ছে তার দিন। মা গুম হওয়ার পর আমাদের জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা, অন্ধকার। বোন আলিয়া কান্না করে বারবার বলতো, আম্মাকে মারছে। ওই ঘটনার পর আমাদের জীবন থেকে আনন্দ যেন হারিয়ে গেছে। এমনকি ঈদের দিনেও কান্নাকাটি হয়েছে আমাদের সম্বল। এখনও আমার বোন কান্না করে, হয়তো মা ফিরে আসবে।’

শুধু আফসানা নয়, গুম হওয়া বাবা-মা কিংবা ভাইকে ফিরে পাওয়ার আশায় এখনও পথ চেয়ে বসে আছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, ২০০৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৬২৯ জন গুমের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে লাশ হয়ে ফিরেছেন ৭৮ জন। গুম থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৫৯ জন, গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ৭৩ জনকে। বাকিদের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাদের স্বজনেরা এখনও অপেক্ষায় দিন পার করছেন।

১৭ বছরের ফারজানাকে রেখে ২০১৩ সালে নিখোঁজ হন বাবা কুদ্দুসুর রহমান চৌধুরী। তিনি মিরপুরের জমি ব্যবসায়ী। ওই বছর তাকে তুলে নিয়ে যায় র‍্যাব। মেয়েটির যখন এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার কথা সেই সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপর্যায়ে ছোটাছুটি করতে হয় ফারজানা ও তার মাকে। তারা তিন বোন ও দুই ভাই। প্রথম প্রথম তারা জানতেন যে বাবা ফিরবেন। একপর্যায়ে মা তাদের বলতে বাধ্য হন, বাবা আর ফিরবেন না। এরপর কয়েক মাস বিপর্যস্ত থাকে শিশুরা। খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ করে দেয়। স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়। বাবার শূন্যতা কাটাতে না পেরে ঠিক মতো কথাও বলতো না শিশুগুলো।

গুমবিষয়ক কমিশনে গত ১৫ বছরে ১৬০০টি ঘটনার অভিযোগ জমা পড়েছে / ছবি- সংগৃহীত

ফারজানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাবা গুম হওয়ার পর আমরা পথে পথে ঘুরেছি। আমার মা প্রায় পাগল হয়ে যায়। ছোট বোন অক্সফোর্ডে পড়তো। বাবা নিখোঁজের পর তাকে অন্য স্কুলে ভর্তি করা হয়। তখন আমি এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম। আমার পড়ালেখাও ভালো হয়নি। মা দিন-রাত থানা-পুলিশ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসা-অফিস, র‍্যাব ও পুলিশের কার্যালয়ে ছোটাছুটি করতেন। যে যা বলেছে, আমরা তা-ই করেছি। বাবাকে খুঁজতে গিয়ে এক সময় আর্থিক সংকটে পড়তে হয় আমাদের। এমনকি আমাদের জমিগুলো অন্যরা দখল করে নেয়।

‘অন্য রকম এক মানসিক পীড়ার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে আমাদের। একবার ভেবে দেখেন, ছোট ছোট বাচ্চাগুলো তাদের প্রিয় বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়’— প্রশ্ন রাখেন ফারজানা।

এমন মানসিক চাপে শিশুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় : ডা. হেলাল উদ্দিন

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাবাকে হারানো চট্টগ্রামের ১১ বছরের এক শিশু ঢাকা পোস্টকে বলে, ‘আমার আব্বু আমাকে খুবই ভালোবাসতো। আব্বুকে খুবই মিস করি। সবার আব্বু বাসায় ফেরে কিন্তু আমার আব্বু আসে না। আমি প্রতিদিন দরজার দিকে চেয়ে থাকি, কখন আব্বু আসবে, আমার জন্য খেলনা নিয়ে আসবে।’ আব্বুকে কখন বেশি মনে পড়ে— এমন প্রশ্নের জবাবে শিশুটি বলে, ‘রাতে ঘুমাতে গেলে। আমাকে তো আর আদর করে না।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন অনিশ্চিত পরিস্থিতি শিশুদের মধ্যে বিষণ্নতা তৈরি করে। ফলে তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, শিক্ষাগত, পেশাগত ও সামাজিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যাহত হয় তার স্বাভাবিক কর্মতৎপরতা।

এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এ ধরনের অনিশ্চিত পরিস্থিতি শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর দারুণ প্রভাব ফেলে। এক ধরনের তীব্র মানসিক চাপ তৈরি হতে পারে। দীর্ঘদিন এ অবস্থা থাকলে তাদের মধ্যে উদ্বিগ্নতা ও বিষণ্নতাসহ নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে। শিশুর ব্যক্তিত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এটি তাদের জন্য ট্রমা বা মানসিক চাপ। ভবিষ্যতে তাদের মধ্যে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি) নামক মানসিক রোগ বাসা বাঁধতে পারে।’

‘এই বুঝি ফিরে এলো বাবা’, অপেক্ষার প্রহরে বিপর্যস্ত শিশুরা / ছবি- সংগৃহীত

এ অবস্থায় করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া প্রয়োজন। মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বন্ধু, স্বজন ও পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি প্রফেশনাল লোক দিয়ে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা করা প্রয়োজন।

ঈদ বা জন্মদিন এলেই বাবাকে খোঁজে তারা

২০১০ সালে খাগড়াছড়ির এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে নিখোঁজ হন কাপড় ব্যবসায়ী আবু সালাম। নারায়ণগঞ্জের পাগলায় দুই মেয়ে, তিন বছরের এক ছেলে ও স্ত্রী ফরিদা বেগমকে রেখে যান তিনি। পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস ছিলেন আবু সালাম। তার নিখোঁজ হওয়ার পর সংসারে নেমে আসে ঘোর অমানিশা।

ফরিদা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর চোখে শুধু অন্ধকার দেখতাম। তিন সন্তানকে নিয়ে কই যাব, কী খাওয়াব? দুই মেয়েকে একটু বোঝাতে পারলেও ছেলে সাব্বিরকে বোঝানোই যেত না। বাবার কথা মনে হলেই সে কান্নাকাটি করতো। সারাদিন চুপচাপ থাকতো। রাতে ঘুমানোর সময় বলতো, আম্মু আব্বু এখনও আসে না কেন? তখন বলতাম, গেছে এক জায়গায়, কাজে। সময় লাগবে, আসবে। ছোট মানুষ, খুব কান্নাকাটি করতো। মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া ছাড়া কিছুই করার ছিল না। মেয়েরা একটু হলেও বুঝতো। তবে, তারাও কান্না করতো। ১৪ বছর পার হলেও মেয়েরা এখনও তার বাবার অপেক্ষায় আছে।’

‘বাবা নিখোঁজ হওয়ার পর মেয়েদের আর পড়ালেখা করাতে পারিনি’— উল্লেখ করে ফরিদা বেগম আরও বলেন, ‘সালমা দশম শ্রেণি আর সাবরিনা তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তো। এরপর মেয়েদের আর পড়ালেখা হয়নি। ছেলে সাব্বির কষ্ট করে পাগলা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। সে পড়ালেখা করার জন্য কান্নাকাটি করতো কিন্তু টাকার জন্য পড়াতে পারিনি। এখন সে পাগলা বাজারে মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজ শিখছে। বাবা থাকলে ১৭ বছরের ছেলেকে হয়তো কাজ শিখতে যেতে হতো না।’ 

‘ঈদ বা জন্মদিন এলেই সন্তানেরা তাদের বাবাকে খোঁজে। আমি কোথা থেকে এনে দেব? আমি তো জানি না সে কোথায়? সে কি বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে? আমার কোনো বিশেষ দিন নেই। আমাদের বাচ্চাদের মুখে হাসি নেই। বাবার কথা মনে হলেই কান্নাকাটি করে।’

 ঈদ হোক, জন্মদিন হোক; গুম হওয়া বাবাকে খোঁজে শিশুরা / ছবি- সংগৃহীত 

১৫ বছরে ১৬০০টি গুমের অভিযোগ

গুম বা নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গুমবিষয়ক তদন্ত কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কমিশনের সভাপতি করা হয়েছে সাবেক বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীকে। সম্প্রতি তিনি জানান, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত এক হাজার ৬০০-এর বেশি গুম হওয়ার অভিযোগ জমা পড়েছে।

তদন্ত কমিশন বলছে, তাদের কাছে এক হাজার ৬০০ জনের গুমের তথ্য এসেছে। এর মধ্যে এখনও অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন। যারা নিখোঁজ রয়েছেন তাদের অধিকাংশের পরিবার ও সন্তান রয়েছে। অনেকের তো শিশুসন্তানও ছিল। বাবা বা মা নিখোঁজের পর সেই সন্তানেরা সামাজিকভাবে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বাবা নিখোঁজের পর কোটিপতি থেকে শূন্য অবস্থায় চলে গেছে অনেক পরিবার। তারা আর্থিকভাবে কষ্ট করছেন। সন্তানদের ভালো মতো পড়ালেখাও করাতে পারেননি। বিশেষ করে বাবা নিখোঁজ হওয়ার পর অনেক মেয়ে পড়ালেখা থেকে ঝরে পড়েছেন।

গুমবিষয়ক কমিশনের সদস্য ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. নাবিলা ইদ্রিস ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এখানে ‍দুটি বিষয় আছে। একটি হলো- বাবার ফিরে না আসা এবং অপরটি মারা যাওয়া। ফিরে না আসাটা অত্যন্ত মানসিক কষ্টের। অন্যদিকে, কেউ মারা গেলে দুঃখ হয়, কষ্ট হয়। এখানে নিজেকে বুঝ দেওয়া যায় যে, তিনি আর ফিরে আসবেন না। আর হারিয়ে গেলে বা নিখোঁজ বা গুম হলে তার ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে। এ ক্ষেত্রে তিনি আসবেন কি, আসবেন না— এমন দোদুল্যমান থাকাটা অত্যন্ত মানসিক কষ্টের। গুম হওয়া প্রতিটা পরিবারের মাঝে এটা আমরা দেখতে পেয়েছি।’

‘এ ছাড়া ভুক্তভোগী পরিবারকে কিছু আইনি জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। তার মধ্যে অন্যতম হলো- জমিজমা ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত। গুম হওয়া সব বাবারই নিজস্ব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা তাদের নামে জমিজমা বা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ আছে। কেউ মারা গেলে উত্তরসূরিরা সেগুলো স্বাভাবিক নিয়মে পেয়ে যান। কিন্তু কেউ যদি নিখোঁজ হন, তখন কিন্তু তিনি যে মারা গেছেন সেটা ঘোষণা করা যায় না। আদালতের আদেশ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।’

‘আমি দেখেছি, অনেক ভুক্তভোগী পরিবার এটাও ক্লিয়ার না যে কত বছর তাদের অপেক্ষা করতে হবে। কেউ বলছেন সাত বছর, আবার কেউ বলছেন ১২ বছর। তারপর আদালত থেকে নিখোঁজ ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করার পর তার রেখে যাওয়া সম্পদ ভাগবাটোয়ারা করা যাবে। এটা বিশাল সময়সাপেক্ষ বিষয়। ফলে পরিবারের ওপর আর্থিক চাপ পড়ে। আর্থিক চাপের কারণে শিশুদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। তারা স্কুলে যেতে পারে না। একদিকে বাবাকে হারানোর বেদনা, অন্যদিকে স্কুল থেকে ঝরে পড়া— উভয় চাপে শিশুর মানসিক অবস্থা একেবারে ভেঙে পড়ে।’

আর্থিক সংকটের কারণে স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে গুম হওয়া ভুক্তভোগী পরিবারের শিশুরা / ছবি- সংগৃহীত

অবহেলার চোখে দেখেন আত্মীয়-স্বজনেরা

‘বাবা নিখোঁজ হলে আত্মীয়-স্বজনেরা অবহেলার চোখে দেখেন’— জানিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিতৃহারা এক মেয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাবা যখন ছিলেন তখন আমরা আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যমণি ছিলাম। বাবা নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা যেন পাল্টে যান। সবাই আমাদের অবহেলার চোখে দেখতে শুরু করেন। আগের মতো খোঁজখবর নেন না। শুধু আত্মীয়-স্বজন নন, পাড়া-প্রতিবেশীরাও আমাদের বোঝা মনে করেন। তারা বিষয়টি অন্যভাবে দেখেন। তারা মনে করেন, আমার বাবা বড় কোনো অপরাধ করে ফেলেছেন। তা না হলে কেন নিখোঁজ হবেন? আসলে আমরা তো জানি না কেন নিখোঁজ? একদিকে বাবাকে হারিয়ে কষ্টে আছি, অন্যদিকে প্রতিবেশীদের কাছ থেকেও শুনতে হয় নানা কথা।’

রাজধানীর ভাষানটেকের পকেট গেট এলাকায় ভাঙারির ব্যবসা করতেন মো. মোস্তফা। ২০২০ সালের ৬ জুন নিখোঁজ হন তিনি। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি চার সন্তান রেখে নিখোঁজ হন। তাদের মধ্যে তিনজনই নাবালক। বর্তমানে মাটিকাটা এলাকায় থাকেন তারা।

নিখোঁজ মো. মোস্তফার বড় মেয়ে সুমাইয়া বলেন, ‘আমরা বাবাকে অনেক জায়গায় খুঁজেছি। ভাষানটেক থানায় জিডি করেছি। গুম কমিশনে অভিযোগও দিয়েছি। আমরা বাবাকে ফিরে পেতে চাই। আমার মা ভেঙে পড়েছেন। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আমার ছোট বোন সুরাইয়া সবসময় বাবাকে খোঁজে। বাবাকে এনে দাও বলে শুধু কান্না করে। সকাল হলেই বাবাকে খোঁজে। মনমরা হয়ে বসে থাকে। প্রয়োজন ছাড়া কারও সঙ্গে কথা বলে না। প্রতি বছর ঈদ আসে, সবার মনে আনন্দ বয়ে আনে। কিন্তু আমাদের মাঝে আর ঈদ আসে না, আনন্দও আসে না।’

একপর্যায়ে গুম হওয়া ব্যক্তির ছেলে-মেয়েদের অবহেলার চোখে দেখেন স্বজনেরা / ছবি- সংগৃহীত

চাইল্ডহুড ট্রমা প্রাপ্তবয়সে মানসিক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়

বাবা গুম হওয়ার কারণে শিশুসন্তানদের মায়ের সঙ্গে নিয়মিত আদালত, থানা ও প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে ছোটাছুটি করতে হয়। তখন তাদের ওপর কোন ধরনের প্রভাব পড়ে— জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফারহানা জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আসলে এটা নির্ভর করে ওই শিশুর বয়সের ওপর। আদালতের পরিবেশ যেমন- পুলিশ, আইনজীবী ও বিচারকের পোশাক; তার বাবার সঙ্গে কোন ধরনের আচরণ করা হয়— এসব কম বয়সী শিশুদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলে। চাইল্ডহুড ট্রমা প্রাপ্তবয়সে মানসিক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। কম বয়সের শিশুদের ক্ষেত্রে বাবাকে ওই অবস্থায় দেখে নিজেকে অভিভাবকহীন এবং আদালতের প্রতি তার একটা নেগেটিভ মনোভাব তৈরি হয়। আরেকটা বিষয়, একটা শিশুর সামনে যখন তার বাবাকে গ্রেপ্তার কিংবা গুম করা হয় তখন তার মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ট্রমার প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।’

‘এ ছাড়া সমাজের মানুষের কাছ থেকে আসা বিরূপ মন্তব্য, যাকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় সোশ্যাল স্টিগমা; সেটাও একজন শিশুর জন্য দীর্ঘমেয়াদি মানসিক সমস্যা তৈরি করতে পারে।’

‘১৪ বছর ধরে পথ চেয়ে বসে আছি’

এদিকে, গুম হওয়া আওয়ামী লীগের নেতা ও রাউজানের সাবেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু জাফরের সন্ধান চেয়ে আকুতি জানিয়েছেন বড় ছেলে জিসানুর রহমান। তিনি বলেন, টানা ১৪ বছর বাবার পথ চেয়ে বসে আছি। বাবাকে হারানোর বেদনা বুকে চেপে রেখেছি। আমার ছোট ভাই জিয়ান কখনও আব্বু ডাকতে পারেনি। কারণ, সে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই বাবাকে হারিয়েছে। আপনারা আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন।

প্রচণ্ড মানসিক চাপের কারণে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে না গুম হওয়া ব্যক্তির সন্তানেরা / ছবি- সংগৃহীত 

‘আমার বাবা আবু জাফরকে ২০১০ সালের ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম নগরীর পশ্চিম খুলশীর ভূঁইয়া গলি থেকে তুলে নিয়ে গুম করা হয়। ওই দিন সকালে আমাদের সামনে থেকে কয়েকজন সন্ত্রাসী আব্বুকে জোরপূর্বক মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। অপহরণকারীরা তৎকালীন এমপি ফজলে করিম চৌধুরীর দলীয় খুন ও গুম চক্রের লোক। এ কারণে আমার পরিবারের সবাই নির্বাক হয়ে যাই। ওই ঘটনায় আমার মা ইয়াছমিন আক্তার বাদী হয়ে ২০১০ সালের ২০ এপ্রিল খুলশী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। সেখানে অপহরণকারীদের নাম ও ঠিকানা দিতে চাইলে সেটা (ডায়েরি) নিতে অস্বীকার করে পুলিশ। ফলে তাদের নাম দেওয়া সম্ভব হয়নি।’

গুম হওয়া এক বাবার আদরের মেয়ে শান্তা (ছদ্মনাম)। ঢাকা পোস্টকে সে বলে, ‘আমার বাবা আল্লাহর কাছে আছেন। আমার জন্য ই-য়া বড় পুতুল নিয়ে আসবেন। এসে আমাকে খুব আদর করবেন। আমি বাবার জন্য কত কত আদর রেখেছি। কিন্তু বাবা তো আসে না! আল্লাহ আমার বাবাকে ছেড়ে দেয় না।’ কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলে শিশুটি। সে আরও বলে, ‘নতুন সরকার আসার পর শুনলাম বাবা ফিরতে পারেন। তারা কি আমার বাবাকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন?’

গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তির স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’–এর সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গুম হওয়া অনেকের বাড়িতে এনএসআই, পুলিশ ও র‍্যাব সদস্যরা আসেন। রাইফেলসহ ইউনিফর্মে আসায় শিশুদের মধ্যে কী কাজ করতে পারে, সেটা সবাই জানেন। তারা প্রচণ্ড ভয় পায়। মানসিকভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। শুধু এটাই নয়; বাচ্চার স্কুল, সমাজ, পাড়া-প্রতিবেশীর কাছ থেকেও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। তাদের মনোজগতে বাজে একটা প্রভাব ফেলে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তারা যে সমাজব্যবস্থা দেখে দেখে বড় হচ্ছে, বাংলাদেশ আদৌ সেটা কি না? আপনি বা আমি যেভাবে বড় হয়েছি তারা সেভাবে বড় হচ্ছে কি না?

‘গুম হয়তো একজনকে করা হয় কিন্তু এর প্রভাব পড়ে পুরো পরিবারের ওপর। পরিবারের সবাইকে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হয়। আমরা যখন তাদের সঙ্গে কথা বলি, তখন তারা বলে যে, আমাকে আব্বু স্কুল থেকে নিয়ে যাবে। ঈদের সময় আব্বুর সঙ্গে ঘুরতে যেতে ইচ্ছা করে। ওদের তো বিরূপ মানসিক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। পাশাপাশি  একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ছে পরিবারটি। এর প্রভাবও পড়ছে ওই বাচ্চাটার ওপর। আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে শিশুটির অনেক ছোট ছোট ইচ্ছাও পূরণ করতে পারছে না পরিবারটি।’

একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে চরম আর্থিক সংকটে পড়ে গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবার / ছবি- সংগৃহীত  

শুধু মানসিক চাপ নয়, উদ্বেগ-নিরাপত্তাহীনতায়ও ভুগতে হয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি গুমের শিকার হলে পরিবারের সদস্যরা তিনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। প্রথমত, পরিবারের সদস্যদের মাঝে মানসিক চাপের পাশাপাশি উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়। দ্বিতীয়ত, অনেকে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। সামান্যতম সহানুভূতির অভাবও পরিলক্ষিত হয়। সমাজে তাদের সম্মান ও মর্যাদা কমে যায়। সর্বশেষ, একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে আয়ের উৎস হারিয়ে পরিবারটি অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। দৈনন্দিন ব্যয় ও বাচ্চাদের শিক্ষার খরচ চালানো কঠিন হয়ে যায়। ফলে তারা অসহায় হয়ে পড়েন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহজাবীন হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বা সাধারণ সদস্য যখন হারিয়ে যান, তখন তার পরিবারের সদস্যরা ব্যাপক ট্রমার মধ্যে পড়েন। মানুষের মৃত্যুতে ট্রমাটা ক্ষণস্থায়ী হয়। কিন্তু গুম হলে সেটা দীর্ঘস্থায়ী ও অনিশ্চিত ট্রমার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যদি সেই ব্যক্তি একমাত্র উপার্জনক্ষম হন তা হলে পরিবারটি ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে।

‘কীভাবে আয় হবে, সংসার কীভাবে চলবে— এটা নিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারকে হিমশিম খেতে হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা আরও প্রবল। স্কুল থেকে যখন বাবা-মাকে আসতে বলা হয়, তখন তারা বাবা-মাকে নিয়ে যেতে পারে না। যখন কেউ জিজ্ঞাসা করে, তোমার বাবা-মা কী করেন? তখন তারা উত্তর দিতে পারে না। অন্যদিকে, আমাদের দেশের মানুষ অসংলগ্ন কথা বেশি বলেন। যা ভুক্তভোগী ওই পরিবারকে আরও বেশি বিপাকে ফেলে। একজন মানুষের মৃত্যুতে যে প্রভাব পড়ে, গুম হওয়ার কারণে এর চেয়েও খারাপ প্রভাব পড়ে পরিবারটির ওপর। নানা ধরনের কটু কথা শুনতে হয় তাদের। শিশুদের ওপর এর প্রভাব হয় আরও মারাত্মক।’

শুধু আর্থিক সংকট বা মানসিক চাপ নয়, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবার / ছবি- সংগৃহীত

‘শিশুরা যখন স্বজনদের সঙ্গে থানায় আসা-যাওয়া করে, তখন তারা তো স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে না। শিশুদের মস্তিষ্কের গ্রোথ ততটা হয় না। ফলে তারা এটার সঙ্গে সহজে মানিয়ে নিতে পারে না। যা ভবিষ্যতে মারাত্মক মানসিক রোগের ঝুঁকিতে ফেলে তাদের’— বলেন ড. মাহজাবীন হক।

এমএসআই/এআর/এমএআর/