১৭ বছরের রোবায়েদ ইসলাম মাহিদ একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় পরিবারের অন্যদের তুলনায় কিছুটা মেধাবী পরিচয়েই বেড়ে ওঠা তার। তেমন ফলাফলও মেলে এসএসসি পরীক্ষায়। গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে বড় স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হন নরসিংদী কাদের মোল্লা সিটি কলেজে। গত জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলি লাগে তার চোখে। এতে পরিবারে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার।

মাহিদের পরিবারের অভিযোগ, চোখে গুলি নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পর ‘আন্দোলনকারী’ বলে চিকিৎসাই দিতে চাননি নরসিংদী সদর হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসকরা। পরে মাহিদের বন্ধুরা হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ শুরু করলে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে বাধ্য হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে সামান্য চিকিৎসা দিয়েই ঢাকার কোনো হাসপাতালে চলে যেতে বলা হয় তার পরিবারকে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায় মাহিদের।

অন্যদিকে, রাজধানীর নর্দা এলাকায় গত ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হন স্থানীয় একটি থাই গ্লাসের দোকানে কাজ করা আব্দুল রহিম (১৪)। দুই বন্ধুর সঙ্গে সেদিন আন্দোলনে গিয়েছিলেন। তার দুই বন্ধু সেদিন অক্ষত অবস্থায় ফিরতে পারলেও চোখে গুলি নিয়ে লাগে রহিমের। তাৎক্ষণিক আশপাশের একাধিক বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হলেও কোথাও চিকিৎসা মেলেনি বলে অভিযোগ এই কিশোরের।

আন্দোলনে আহত হয়ে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা না পাওয়ার এমন অভিযোগ শুধু মাহিদ বা রহিমেরই নয়, এমন অসংখ্য ছাত্র-জনতার অভিযোগ, শুধু আন্দোলনকারী বলে বিভিন্ন হাসপাতাল যথাসময়ে চিকিৎসা সেবা দেয়নি। যার কারণে তাদের আন্দোলন চলাকালেই এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতাল আর এক জেলা থেকে অন্য জেলার হাসপাতালে ছটফট করতে করতে ছুটে বেড়াতে হয়েছে। ভুক্তভোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, স্বৈরাচারের মদতপুষ্ট চিকিৎসক-কর্মকর্তাদের চিকিৎসায় অবহেলার কারণে মাহিদ-রহিমদের মতো হাজারো শিক্ষার্থী-জনতা চিরতরে অন্ধ হতে যাচ্ছে।

‘চিকিৎসা বঞ্চিত’ হয়ে এক চোখ হারানো মাহিদের চাপা আর্তনাদ

‘আমি একটা চোখে কিছুটা দেখি কিন্তু অন্য চোখটা পুরোপুরি অন্ধকার। আমি হয়ত আজীবনের জন্যই একটা চোখ হারিয়ে ফেলেছি। সরকারের কাছে অনুরোধ এখন যেন অন্তত একটা চোখে হলেও ঠিকমতো দেখতে পাই, সেই ব্যবস্থা করবেন। সেই সঙ্গে যাদের অবহেলায় সময়মতো সঠিক চিকিৎসাটা পাইনি, তাদের যেন কোনোমতেই ছাড় না দেওয়া হয়।’ কথাগুলো বলছিলেন নরসিংদী কাদের মোল্লা সিটি কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থী মাহিদ।

তিনি বলেন, আন্দোলনে গত ১৮ জুলাই গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর প্রথমে আমাকে ঢাকা মেডিকেলে আনা হয়। সেখানে আসার পর প্রাথমিক কিছু চিকিৎসা এবং কিছু ড্রপ দিয়ে আমাকে নরসিংদী পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর নরসিংদীর একটি চক্ষু হাসপাতালে সপ্তাহখানেক চিকিৎসা করানো হয়। সেখানে চোখের খুব বেশি উন্নতি না হওয়ায় সেখানকার চিকিৎসকদের পরামর্শে ২৭ জুলাই ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে আসি। কিন্তু সেদিন তারা আমাকে ভর্তি তো নেয়নি, কেউ একজন এসে দেখেওনি।

‘নরসিংদী থেকে ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে আসার পর তারা সরাসরি বলে দিয়েছে আন্দোলনে বুলেটের কোনো রোগীই দেখবে না। এ অবস্থাতেই আমার দীর্ঘসময় কাটে। সবশেষ সরকারের পতন হওয়ার পর আমরা জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে আসি এবং এখানে চিকিৎসা শুরু হয়।’

আক্ষেপ করে মাহিদ আরও বলেন, আমি তো প্রথম দিনেই ঢাকা মেডিকেলে গিয়েছিলাম, সেদিন কেন তারা আমাকে নরসিংদী পাঠিয়ে দিয়েছিল এখনো ভেবে পাই না। তারা তো চাইলেই আমাকে রেখে যথাযথ চিকিৎসা দিতে পারত। নরসিংদী সদর হাসপাতালেও আমি চিকিৎসা পাইনি। ওখানে যত রোগীই চিকিৎসা নিতে গেছে, সব রেফার্ড করে দিয়েছে। এখানে আসার পর আরও অনেকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, তারাও বলেছে যে আন্দোলনের সময় কোনো হাসপাতালে গিয়েই সঠিক চিকিৎসা পাননি। যে কারণে এখন অনেককেই চিরদিনের মতো অন্ধ হতে হয়েছে।

ইন্টার্ন চিকিৎসকরাই সেবায় ছিল, সিনিয়ররা আসেননি– অভিযোগ স্বজনের

ওমর ফারুক নাহিদ নামের আরেক আহতের বোন নাসরিন আক্তার বলেন, আমার ছোটভাই গত ১৮ জুলাই আন্দোলনে যায়। তখন পরিবার থেকে বার বার তাকে নিষেধ করা হলেও আমরা থামাতে পারিনি। উল্টো সে আমাদের জানায়, আন্দোলন শেষ করেই বাসায় ফিরব। সেদিন চার বন্ধুকে নিয়ে আন্দোলনের ফাঁকে দুপুরে খাওয়ার জন্য একটা চিপা গলি দিয়ে যাচ্ছিল। পেছন থেকে হঠাৎ করে এসেই পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। শুরুতে পেছনের পিঠে-হাতে লাগলেও যখন পেছনে ফিরে তাকায় তখন একটা গুলি গিয়ে তার ডান চোখে লাগে।

‘এমন কোনো জায়গা বাকি নেই যেখানে গুলি লাগেনি। চোখ, মাথা, পিঠ, পাসহ  গুলির চিহ্ন রয়েছে নাহিদের শরীরে। সবমিলিয়ে অন্তত ৫০ থেকে ৬০টি গুলি ছিল তার শরীরে। ভাইটাকে সঙ্গে সঙ্গে নরসিংদী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে শুরুতে তারা চিকিৎসা দিতে চায়নি। তখন ওর বন্ধুরা হাসপাতালের বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুর শুরু করলে তারা চিকিৎসা শুরু করতে বাধ্য হয়। সেখানে সামান্য চিকিৎসা দিয়ে তাকে ঢাকা মেডিকেলে রেফার্ড করা হয়। তাৎক্ষণিক তাকে ঢাকা মেডিকেল নিয়ে এলে সেখানেও ভালো চিকিৎসা পাওয়া যায়নি। ঢাকা মেডিকেলে তখন শুধু ইন্টার্ন চিকিৎসকরাই চিকিৎসায় ছিল, সিনিয়র কোনো চিকিৎসক উপরের নির্দেশনায় চিকিৎসা দিতে আসেনি।’

আন্দোলনে আহত হয়ে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা না পাওয়ার এমন অভিযোগ শুধু মাহিদ বা রহিমেরই নয়, এমন অসংখ্য ছাত্র-জনতার অভিযোগ, শুধু আন্দোলনকারী বলে বিভিন্ন হাসপাতাল যথাসময়ে চিকিৎসা সেবা দেয়নি। যার কারণে তাদের আন্দোলন চলাকালেই এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতাল আর এক জেলা থেকে অন্য জেলার হাসপাতালে ছটফট করতে করতে ছুটে বেড়াতে হয়েছে

নাসরিন আক্তার বলেন, ঢামেকে আশানুরূপ চিকিৎসা না পেয়ে বাধ্য হয়েই তাকে পপুলার হাসপাতালে নিয়ে যাই এবং সিনিয়র চিকিৎসকদের ঘুষ দিয়ে তার চিকিৎসা করা হয়। তখন একদিনের চিকিৎসায় পপুলার হাসপাতালে বিল দিতে হয়েছে প্রায় দেড় লাখ টাকা। এখানকার চিকিৎসকরাও শুরুতে চিকিৎসা দিতে চায়নি। পরে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে শুধু তার শরীরের ছররা গুলিগুলো বের করা হয়। তখনও নাহিদের চোখের চিকিৎসা পুরোপুরি শুরু হয়নি। অবশেষে যখন সরকারের পতন হয়, তখন আবার চিকিৎসা শুরু হয়। এখন আমরা বুঝতে পারছি যে শুরুতে যথাযথ চিকিৎসা পেলে হয়ত আজ চোখের গুরুতর সমস্যা হতো না।

সংসারে ‘সাপোর্ট’ দিতে ঢাকায় এসে উল্টো পরিবারের বোঝা রহিম

অভাবের সংসারে পরিবারকে একটু আর্থিক সাপোর্ট দিতে ভোলার দৌলতখান থানা থেকে ঢাকায় কাজ করতে এসেছিলেন কিশোর আব্দুল রহিম। আন্দোলনে চোখ হারিয়ে এখন সে হয়ে উঠেছে পরিবারের বোঝা।

আলাপকালে আব্দুল রহিম বলেন, আমার বয়সী বাচ্চার কত খেলাধুলা করছে, যেদিকে ইচ্ছে যাচ্ছে, যা মন চায় করছে। কিন্তু আমি অন্ধ, চোখ নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে দৌড়াচ্ছি। অথচ গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিলাম অভাবের সংসারে কিছুটা অর্থনৈতিক সাপোর্ট দেওয়ার জন্য। এখন নিজেই পরিবারের বোঝা হয়ে বসে আছি। আমাদের আজকের এই অবস্থার জন্য যারা দায়ী, তাদের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।

‘গুলি লাগার পর আমি আর কিছুই বলতে পারছিলাম না। হঠাৎ বুঝতে পারি আমাকে কোনো একটা হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে কিন্তু সেখানে কর্তব্যরতরা বলছে আমাদের এখানে গুলির রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া নিষেধ। এরপর সেখান থেকে আরেকটি হাসপাতালে নিলে সেখানেও তারা চিকিৎসা দিতে চায়নি। শেষে আমাকে নেওয়া হয় জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে। প্রথম দফায় নগদ টাকার বিনিময়ে চোখের অপারেশন করা হয়। তবে এখন পুরোপুরি বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’

এখন আমাদের যে গুরুত্বটা দেওয়া হচ্ছে, তখন যদি এর কিছুটা হলেও পেতাম তাহলে মনে হয় আমার আজ অন্ধ হওয়া লাগত না– বলেন এই কিশোর।

চোখের ভেতর বুলেট রেখেই সেলাই করে দেওয়া হয় আবু সাইদের চোখ

রংপুর থেকে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিতে এসেছেন অটোরিকশা চালক আবু সাঈদ। গত ১৯ জুলাই আন্দোলনে গিয়ে চোখে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। তাৎক্ষণিক রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখা হয় বলে অভিযোগ এই অটোরিকশা চালকের। এমনকি চোখের ভেতর বুলেট রেখেই সেলাই করে দেওয়ার মতো ভয়াবহ ঘটনা তার সঙ্গে ঘটেছে বলেও দাবি তার।

আবু সাইদ বলেন, আমি একজন অটোরিকশা চালক। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আমিও সেদিন অংশগ্রহণ করেছিলাম। আন্দোলনে গিয়ে আমার বাম চোখটা এখন নষ্ট হয়ে গেছে। তাৎক্ষণিক রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পর তারা আমাকে ভালো চিকিৎসা তো দেয়নি, উল্টো অপারেশনের নামে বুলেট ভেতরে রেখেই সেলাই করে দিয়েছে। এই হাসপাতালে আসার পর ডাক্তার দেখে বলছেন চোখের ভেতরে এখনো বুলেট রয়ে গেছে, আগে আমার চোখের কোনো চিকিৎসাই হয়নি। এ কারণেই আমি একটা চোখ হারাইছি। এখন যদি দ্রুত সময়ের মধ্যে অপারেশন না করি, তাহলে আমার অন্য চোখটাও নষ্ট হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, গত ১৯ জুলাই আমি রংপুর মেডিকেলে ভর্তি হই, এরপর ২৮ জুলাই আমাকে ওই হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হয়। এসময়ে আমি কোনো ধরনের ভালো চিকিৎসা পাইনি। তারা যদি আমার চোখের অপারেশন নাই করবে, তারা আমাকে বলল না কেন? কেন আমাকে এতদিন শুধু শুধু হাসপাতালে আটকে রাখল? সেখানে চিকিৎসা না হলে আমি ঢাকায় আসতাম বা অন্য কোথাও যেতাম। তাহলে হয়ত আমাকে আজ অন্ধ নাও হওয়া লাগত।

‘আমার মতো অসংখ্য মানুষের চোখকে চিরদিনের মতো অন্ধ করে দিয়েছে, ওই সমস্ত ডাক্তারদের কীভাবে বিচার হওয়া উচিত, সেটা আপনারাই বলেন। রংপুর মেডিকেলে সেদিন বড় কোনো ডাক্তার চিকিৎসা দিতে আসেনি, যা করেছে মেডিকেল শিক্ষার্থীরা করেছে। এক কথায় বলতে গেলে একরকম মূর্খ মানুষ দিয়েই আমাদের চিকিৎসা করানো হয়েছে। যার কারণে আমার চোখের আলোটা সারা জীবনের জন্য নিভে গেছে। আমার চোখটা তারা ইচ্ছাকৃতভাবে নষ্ট করে দিয়েছে। আমি এখন কীভাবে আমার বাচ্চাকাচ্চা আর সংসার নিয়ে চলব? আমি তো এখন রিকশাও চালাতে পারব না। তারা আমার চোখ নষ্ট করে আমাকে পুরো নিঃস্ব করে দিয়েছে। আমি ওই সব কসাই ডাক্তারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’

আন্দোলনে চিকিৎসা সেবার ভয়াবহ বর্ণনা দিলেন কর্তব্যরত চিকিৎসক

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের ওপর অমানবিক হামলা আর হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহ কিছু বর্ণনা পাওয়া যায় সেই সময়ে চিকিৎসা সেবায় যুক্ত থাকা চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের মুখে। তাদেরই একজন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ও আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা সমন্বয়ক ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা।

ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, সর্বপ্রথম আমি এই আন্দোলনে আহত রোগীদের সংস্পর্শে আসি ১৭ জুলাই। কিন্তু ১৮ জুলাইয়ের অভিজ্ঞতাটা খুবই ভয়াবহ ছিল। সেদিন আমি প্রচুর অল্প বয়সী তরুণ-তরুণীকে দেখতে পাই, যাদের মধ্যে কেউ এক চোখ ধরে আছে, কেউ দুই হাতে দুই চোখ ধরে আছে আর অনবরত রক্ত পড়ছে। শুধু ওইদিনই আমাদের এখানে প্রায় দেড়শ জনের মতো রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

‘১৮ জুলাই থেকেই আমাদের হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে একসঙ্গে ১০ বেড করে টানা ওটি হয়েছে। ১৮, ১৯, ২০, ২১ এবং এর পরবর্তীতে ৪, ৫, ৬, ৭ আগস্ট টানা ১০টা টেবিলে একইসঙ্গে অপারেশন করা হয়েছে। এতে প্রচুর পরিমাণ রোগীকে আমরা প্রাইমারি রিপেয়ার করতে সক্ষম হয়েছিলাম।’

এই চক্ষু বিশেষজ্ঞ বলেন, সাধারণত একটা চোখে যখন প্রচণ্ড গতির একটা মেটালিক কিছু ঢোকে, তখন চোখের কর্নিয়া ফুটো হয়ে যায়। আইবল রাপচার হয়ে যায়। এখানে আমরা প্রাইমারি রিপেয়ার করি, পরে স্ট্যাবল হলে আমরা তার সেকেন্ডারি সার্জারি করি। দ্রুত গতির মেটালিক পিলেটের কারণে রোগীদের ভিট্রিয়াস হেমোরেজ হয়েছে, চোখের ভেতরে রেটিনাল ডিটাচমেন্ট হয়েছে, ট্রমাটিক ক্যাটারাক্ট হয়েছে, অপটিক নিউরোপ্যাথি হয়েছে। আমরা যাদের প্রথম ধাপে রিপেয়ার করেছিলাম, তাদের দ্বিতীয় ধাপের অপারেশন এখনো চলছে। ২৭৫টির বেশি রেটিনা অপারেশন আমরা সম্পন্ন করেছি।

চোখের সামনেই কিছু মানুষ স্থায়ী অন্ধত্বের দিকে এগিয়ে চলছেন উল্লেখ করে ডা. নীলা বলেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানেরও একটা সীমাবদ্ধতা থাকে। চোখের ভেতরে দ্রুত গতির মেটালিক পদার্থ ঢোকার কারণে তাদের চোখের রেটিনা যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। বিশেষ করে যাদের রেটিনা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের আসলে একেবারেই হয়ত ফিরে আসা সম্ভব নয়।

চিকিৎসায় সীমাবদ্ধতার কথা জানালেন হাসপাতাল পরিচালক

আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা সেবা এবং অসংখ্য ছাত্র-জনতার অন্ধত্ব বরণকে চিকিৎসায় সীমাবদ্ধতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, বাস্তবতাটা যত কঠিনই হোক না কেন, সেটাকে আমাদের মেনে নিতে হবে। আহত রোগীরা আমাদের কাছে যে অবস্থা নিয়ে এসেছেন, তাদের মধ্যে ১ থেকে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ রোগীর অবস্থা উন্নতি হতে পারে। অর্থাৎ কোনো রোগী যদি আমাদের কাছে ৫ শতাংশ ভিশন (দৃষ্টি সক্ষমতা) নিয়ে আসেন, সেক্ষেত্রে তার সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত উন্নতি হতে পারে। আর কোনো রোগী যদি ৯০ শতাংশ নিয়ে আসেন, তাহলে তাকে আমরা ৯৫ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত ভিশন দিতে পারব। এই সীমাবদ্ধতাটুকু যেন সবাই উপলব্ধি করি, এটাই আমাদের অনুরোধ।

‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত ৪০ জনের মতো রোগী আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। আন্দোলনের শুরুর দিক থেকেই এক চোখ এবং দুই চোখের ইনজুরি নিয়ে রোগীরা আমাদের কাছে আসেন। পেশাগত দিক থেকে সর্বোচ্চটা দিয়ে আমরা রোগীদের সেবা করার চেষ্টা করছি এবং আমাদের চিকিৎসকরা গত দুই মাস যাবত চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। তবে চিকিৎসা সেবায় আমরা সঠিক ট্র্যাকে আছি কি না, সেটি যাচাই করতে আমরা বিদেশি চিকিৎসকদেরও নিয়ে এসেছি। যারাই এ পর্যন্ত বিদেশ থেকে আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দিতে এসেছেন, প্রত্যেকেই আমাদের চিকিৎসকদের সেবায় সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। তাদের বক্তব্য হলো, আমাদের চিকিৎসকরা আন্তর্জাতিক মানের সেবা দিচ্ছেন এবং চিকিৎসায় কোনো ঘাটতি থাকছে না।’

হাসপাতাল পরিচালক বলেন, আমরা শুধু আমাদের হাসপাতালে ভর্তি রোগীদেরই সেবা দিচ্ছি না। বিদেশি চিকিৎসকদের নিয়ে আমরা চিকিৎসক ক্যাম্প করেছি, যেখানে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোগীদের নিয়ে এসেছি এবং তাদের আমরা চিকিৎসা সেবা দিয়েছি। এর বাইরেও আন্দোলনের প্রথম দিকেও যেসব রোগী আমাদের এখানে চিকিৎসা নিয়েছেন, তারা এখনো নিয়মিত আসছেন এবং ফলোআপ চিকিৎসা নিচ্ছেন।

চিকিৎসায় অবহেলা ও প্রতিবন্ধকতা তৈরিকারীদের নিবন্ধন বাতিলের দাবি

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহতদের যারা চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করেছেন তাদের তালিকা প্রণয়ন করে বিএমডিসির নিবন্ধন বাতিলের পাশাপাশি আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন চিকিৎসক নেতারা।

ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন আল রশীদ বলেন, আন্দোলন চলাকালীন আমরা দেখেছি তৎকালীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন), লাইন ডিরেক্টর, পরিচালক (প্রশাসন) নিপসমের পরিচালকসহ স্বাস্থ্যের শীর্ষ কর্মকর্তারা হাসপাতালে আহত ছাত্রদের চিকিৎসা দেওয়ার ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন। এমনকি বিভিন্ন হাসপাতালে ছাত্রলীগের পেটোয়া বাহিনী ও পুলিশ বাহিনী আহতদের চিকিৎসা কার্যক্রমে বাধার সৃষ্টি করেছে।

‘তারা শুধু চিকিৎসাতেই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেনি, নিহত ছাত্র-জনতার লাশের সংখ্যা গোপন করেছেন এবং ছাত্র-জনতার লাশগুলোকে সরকারকে দিয়ে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করতে সাহায্য করেছেন। কিন্তু সেই সময়ে ড্যাবের চিকিৎসকরা সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে আহত ছাত্র-জনতার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করায় তাদের বদলি, শারীরিক নির্যাতন এবং হয়রানির শিকারও হতে হয়েছে। আমরা চাই, কোটা সংস্কার ও পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনার পতনের দাবিতে আন্দোলনে অংশ নিয়ে আহত হওয়া ছাত্র-জনতাকে চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানানো চিকিৎসকদের তালিকা প্রণয়ন করে বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন (সনদ) বাতিল করতে হবে।’

গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলোতে স্বপদে বসে আছেন দোসর চিকিৎসকরা

ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামের (এনডিএফ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামের চিকিৎসকরা টানা তিন সপ্তাহ খেয়ে না খেয়ে আহত রোগীদের সেবা দিয়েছেন। বিপরীতে বিভিন্ন হাসপাতালে স্বৈরাচারের দোসর চিকিৎসকরা হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এরপরও আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আহতদের জন্য রক্ত সংগ্রহ, ওষুধের ব্যবস্থা, অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের ব্যবস্থা করেছি। আমাদের বেশ কিছু অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুরের শিকার হয়েছে। আমরা নিজেদের পকেট থেকে টাকা দিয়েও রোগীদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করেছি।

তিনি আরও বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহতদের যারা চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করেছে, তাদের তালিকা প্রণয়ন করতে হবে। তাদের বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন বাতিল করার পাশাপাশি আইনের আওতায় আনতে হবে। আমরা এখনো দেখছি যারা স্বৈরাচারে পক্ষে শান্তি সমাবেশ করে ছাত্র আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন এবং চিকিৎসা থেকে দূরে ছিলেন, সেই ফ্যাসিবাদের দোসর চিকিৎসক ও কর্মকর্তা/কর্মচারীরা নানা গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে স্বপদে বসে আছেন। অবিলম্বে তালিকা প্রণয়ন করে তাদের পদ থেকে অব্যাহতি দিতে হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণ করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

টিআই/এসএসএইচ