নিষিদ্ধ হচ্ছে একক ব্যান্ডের রাউটার
বাংলাদেশের বাজারে বিভিন্ন ধরনের রাউটার পাওয়া যায়। মূলত ব্র্যান্ড, মডেল ও ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে এসব রাউটার কিনে থাকেন ক্রেতারা। এ ক্ষেত্রে একক ব্যান্ডের তুলনায় বর্তমানে ডুয়াল-ব্যান্ড বা ট্রাই-ব্যান্ডের রাউটার বেশি কার্যকর। সে জন্য দেশে এ নেটওয়ার্কিং ডিভাইস রাউটারের আমদানি ও উৎপাদন নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত জানিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। যা ২০২৫ সালের ১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে।
জানা গেছে, নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাউটারের কার্যক্ষমতার ব্যান্ড নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে যে কোনো একটি ব্যান্ড সাপোর্ট করে এমন ওয়াইফাই রাউটার আর বাজারজাত করার অনুমতি দেওয়া হবে না। যে সব রাউটার আমদানি করা হবে কিংবা দেশে উৎপাদন করা হবে সেগুলোর সাপোর্ট করতে হবে ডুয়াল-ব্যান্ড।
বিজ্ঞাপন
তবে, বিষয়টি হুট করেই আমদানিকারক ও উৎপাদকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। তাদের ছয় মাস সময় দেওয়া হয়েছে। সময় শেষে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের ১ এপ্রিল থেকে নতুন সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির স্পেকট্রাম বিভাগ থেকে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইএসএম ব্যান্ডের ওয়াইফাই রাউটার দেশে উৎপাদন ও বিদেশ থেকে আমদানি করতে নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফলে বাজারে নিম্নমানের এবং সিঙ্গেল বা একক ব্যান্ডের কোনো রাউটার বিক্রির দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
ডুয়াল-ব্যান্ড সাপোর্ট করে শুধু এমন রাউটারই করা যাবে বাজারজাত
বিটিআরসির নতুন সিদ্ধান্তের ফলে আগামী বছর থেকে ডুয়াল-ব্যান্ড সাপোর্ট করে শুধু এমন রাউটারই বিদেশ থেকে আমদানি এবং দেশে উৎপাদন করা যাবে। যে সব ওয়াইফাই রাউটার বাংলাদেশে বাজারজাত করা হবে সে সব রাউটারকে বাধ্যতামূলকভাবে ২ দশমিক ৪ থেকে ২ দশমিক ৪৮৩ গিগাহার্জ এবং ৫ দশমিক ৭২৫ থেকে ৫ দশমিক ৮৭৫ গিগাহার্জ, উভয় ব্যান্ড সাপোর্ট করতে হবে। এর মধ্যে যে কোনো একটি ব্যান্ড সাপোর্ট করে এমন ওয়াইফাই রাউটার বাজারজাত করা যাবে না।
ফলে নিম্নমানের এবং কম ব্যান্ডের রাউটার বিদেশ থেকে আমদানি ও দেশে উৎপাদনের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে।
একক-ব্যান্ডের চেয়ে ডুয়াল-ব্যান্ড রাউটার বেশি শক্তিশালী
রাউটারের মূল কাজ হলো বিভিন্ন ডিভাইসের মধ্যে ইন্টারনেট সংযোগ ভাগ করে দেওয়া। এটি মূলত নেটওয়ার্কিং ডিভাইস, যা ইন্টারনেট সার্ভার থেকে ডেটা গ্রহণ করে এবং সেই ডেটা ব্যবহারকারীদের কম্পিউটার, মোবাইল, ট্যাবলেট বা অন্যান্য ডিভাইসে পৌঁছে দেয়।
আরও পড়ুন
সাধারণত, একক-ব্যান্ডের চেয়ে ডুয়াল-ব্যান্ড ও ট্রাই-ব্যান্ড রাউটার বেশি শক্তিশালী হিসেবে বিবেচিত। কারণ, এগুলোতে দ্রুত সংযোগ, বিস্তৃত কভারেজ এবং উচ্চ ডেটা ট্রান্সফার ক্ষমতা রয়েছে। এর মধ্যে আবার ডুয়াল-ব্যান্ড রাউটারে ২ দশমিক ৪ গিগাহার্জ ও ৫ গিগাহার্জ ফ্রিকোয়েন্সি সাপোর্ট করে। যা বেশি গতির ইন্টারনেট প্রদান করে। ট্রাই-ব্যান্ড রাউটারে আরও একটি ৫ গিগাহার্জ ব্যান্ড থাকে, যা উচ্চ ট্রাফিকের ক্ষেত্রে আলাদা চ্যানেলে ট্রাফিককে ভাগ করে দেয়। ফলে গতি ও স্থিতিশীলতা বাড়ে।
আবার উচ্চ ক্ষমতার রাউটারে একাধিক অ্যান্টেনা থাকে। যা কভারেজ ও সংযোগের মান উন্নত করে। এ ছাড়া মাল্টি ইউজার, মাল্টি ইনপুট, মাল্টিপল আউটপুট প্রযুক্তি একসঙ্গে একাধিক ডিভাইসকে সমানভাবে সংযোগ দিতে পারে।
এর সঙ্গে ওএফডিএমএ প্রযুক্তি ডেটা ট্রান্সমিশনকে আরও কার্যকর করে তোলে। আবার বিল্ট-ইন সিকিউরিটি ফিচার অর্থাৎ ডব্লিউপিএথ্রি এনক্রিপশন সমর্থিত রাউটার নিরাপত্তার দিক থেকেও শক্তিশালী।
বিষয়টি নিয়ে এশিয়া প্যাসিফিক নেটওয়ার্ক ইনফরমেশন সেন্টারের (এপনিক) এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল সদস্য এবং ইন্টারনেট ও নেটওয়ার্ক প্রকৌশলী সুমন আহমেদ সাবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে বাজারে যে সব সিঙ্গেল-ব্যান্ড রাউটার আসে তা খুবই সস্তা এবং নিম্নমানের। এগুলো ব্যবহার করে মানুষ ভালো সেবা পায় না। ফলে এ জিনিস কিনে গ্রাহক আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন। সে জন্য প্রযুক্তিবিদরা মনে করেন এখন রাউটার কিনলে ডুয়াল-ব্যান্ডের নিচে কেনা উচিত নয়। কারণ, এটি ব্যবহার করার ফলে উন্নত সেবা পাওয়া যায় এবং দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায়।
সিঙ্গেল ব্যান্ডের রাউটার কিনে মানুষ ভালো সেবা না পেয়ে একবার আইএসপিকে গালি দেয় আর একবার সরকারকে গালি দেয়। কিন্তু তিনি (গ্রাহক) নিজেই জানেন না যে, তার রাউটারের সমস্যার কারণে ইন্টারনেট সেবা পাচ্ছেন না। সে জন্য সিঙ্গেল ব্যান্ড রাউটার নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত খুবই ভালো হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এখন বাজারে ডুয়াল-ব্যান্ড নয় বরং ট্রাই-ব্যান্ডের প্রচলন শুরু হয়েছে। সবদিক মিলিয়ে বলা যায়, সিঙ্গেল-ব্যান্ড ওয়াইফাইয়ের আসলে এখন কোনো কার্যকারিতা নেই। সস্তার জন্য অনেকে কিনে থাকেন। কিন্তু এগুলো দেশের বাজারে না থাকাটাই ভালো। আবার এ রাউটার মডার্ন নেটওয়ার্কিংয়ের জন্যও উপযুক্ত নয়। সবকিছু বিবেচনায় আমার কাছে মনে হচ্ছে, বিটিআরসি একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ইন্টারনেট সেবায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে নতুন এ সিদ্ধান্ত
বাজার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশে টিপি লিংক, ডি লিংক, আসুস, নেটগিয়ার, শাওমি ব্র্যান্ডের রাউটার সহজলভ্য এবং বিশ্বস্ত। এর সঙ্গে স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত রাউটারও বিক্রি হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিঙ্গেল ব্যান্ড রাউটারের আমদানি ও উৎপাদন বন্ধ হলে সাধারণ মানুষ ভালো ইন্টারনেট সেবা পাবেন।
ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সাধারণ সম্পাদক নাজমুল করিম ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ সিদ্ধান্ত আরও অনেক আগেই নেওয়া দরকার ছিল। কম দামি ও সস্তা রাউটার ব্যবহারের কারণে অনেক সময় গ্রাহক যথাযথ ইন্টারনেট সেবা পান না। তারা আইএসপিকে দোষারোপ করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তার রাউটারের ইন্টারনেট টানার সক্ষমতা নেই।
বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে যথার্থ সচেতনতা না থাকায় গ্রাহকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাজে রাউটার কিনে ফেলেন। ফলে যথার্থ ইন্টারনেট সেবা তারা পান না। সে জন্য এ সিদ্ধান্তকে যুগান্তকারী বলে আমি মনে করছি। এটি বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রেও সরকারকে বেগ পেতে হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তবে, রাউটারের ক্ষেত্রে আমদানি নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসার তাগিদ দিয়ে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, এটি ভালো সিদ্ধান্ত। তবে, রাউটারের ব্যাপারে আমদানি নির্ভর না হয়ে আমাদের নিজস্ব উৎপাদনের দিকে মনোযোগী হওয়া দরকার। এ ছাড়া বাজারে নামে-বেনামে বিভিন্ন ধরনের রাউটার প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু এসব রাউটারের মান পরীক্ষা করার জন্য বিটাসের পক্ষ থেকে কোনো কার্যক্রম আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি।
শুধু সিদ্ধান্ত দিলেই হবে না বরং সেটি বাস্তবায়নের জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। মানসম্মত রাউটার বাজারে বিক্রি না হওয়ার কারণে আইএসপি ইন্টারনেট সরবরাহ করলেও গ্রাহক পর্যায়ে মানসম্পন্ন ইন্টারনেট সেবা পাওয়া যায় না। সে জন্য কোয়ালিটি চেক (কিউসি) নিশ্চিত করতে হবে।
সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কঠোর হবে বিটিআরসি
সিঙ্গেল ব্যান্ড রাউটার আমদানি, উৎপাদন, বিপণন বন্ধে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন থেকেও কঠোরতা আরোপ করা হবে। একই সঙ্গে ১ এপ্রিলের পর থেকে আর কেউ সিঙ্গেল ব্যান্ড রাউটার আমদানি কিংবা দেশে উৎপাদন ও বিপণন করতে পারবেন না।
আরও পড়ুন
বিটিআরসির তরঙ্গ বিভাগের পরিচালক ড. মো. সোহেল রানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে সিঙ্গেল ব্যান্ড রাউটারের কার্যক্ষমতা সীমিত। সে জন্য ১ এপ্রিলের পর থেকে বাজার থেকে এটি তুলে দেওয়া হবে। তবে, এখন যেগুলো বাজারে আছে কিংবা সম্প্রতি যেগুলো আমদানি বা উৎপাদন হবে সেগুলো বাজারজাত করা যাবে। ১ এপ্রিল থেকে পরবর্তী সময়ে তাদেরকে আর কোনো কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হবে না। বিদেশ থেকে এগুলো আমদানির প্রক্রিয়া হচ্ছে বিটিআরসি থেকে প্রথমে অনুমতি নিতে হয়। তারপর এলসি খুলে দেশে আনা হয়। এরপর বাজারজাত করতেও আমাদের অনুমতির প্রয়োজন হয়। কিন্তু সবার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১ এপ্রিলের পর থেকে এগুলো আর বাজারজাত করা যাবে না।
বিষয়টি এরই মধ্যে সবাইকে জানানো হয়েছে যেন নতুন করে কেউ আর সিঙ্গেল ব্যান্ড রাউটার আমদানির ব্যাপারে মনোনিবেশ না করেন। এ ছাড়া বিষয়টি বাস্তবায়ন করা হলে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আরএইচটি/এমএসএ