ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের ১০০ দিন পূর্ণ হলো শুক্রবার ।

দোর্দণ্ড প্রতাপ নিয়ে ১৫ বছর ‘রাজত্ব’ করা আওয়ামী লীগের পতনের পর ইউনূস সরকারের যাত্রার শুরুটা ছিল কঠিন। পরিবর্তিত দৃশ্যপটে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে বিএনপি। পাশাপাশি সুবিধা পেয়েছে জামায়াতে ইসলামীও। এই দুই দলের বাইরে ইসলামী আন্দোলন ও বামপন্থী দলগুলো সাংগঠনিকভাবে কিছুটা সুবিধা ভোগ করতে পারছে।    

অন্যদিকে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের পাশাপাশি তাদের জোটসঙ্গী অনেকে বিপদে পড়েছেন। দলটির নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটভুক্ত ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের শীর্ষ নেতা রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে কারাগারে আছেন।

গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর তাদের নির্বাচনী জোটসঙ্গী জাতীয় পার্টি শুরুতে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম দফার সংলাপে ডাকও পেয়েছিল দলটি। কিন্তু পরবর্তীতে জাপাকে সংলাপে ডাকার বিরোধিতা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বর্তমান আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সমন্বয়ক সারজিস আলম। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফার সংলাপে জাপাকে আর ডাকা হয়নি। জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে বলা হয়— তারা আওয়ামী লীগের ফ্যাসিজমের নীরব সমর্থন করে গেছেন। তারা অবৈধ নির্বাচনে অংশ নিয়ে সেগুলোর বৈধতা দিয়েছেন। এ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে বিরোধেও জড়ায় জাপা। এ সবের জেরে গত ৩১ অক্টোবর ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দেওয়া হয় জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে।  

রাজনৈতিকভাবে লাভবান বিএনপি, বদলে গেছে দাবি-দাওয়া ও কর্মসূচি

৫ আগস্টের আগে ভারত ইস্যু ও খালেদা জিয়ার মুক্তির লক্ষ্যে কর্মসূচি দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল বিএনপি ও তাদের জোটসঙ্গীদের। কিন্তু মধ্য জুলাই থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিএনপির বেশ কজন কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ‘ক্রাইম জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করে বন্ধ করে দেওয়া বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। এরমধ্যে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন সমর্থন দেওয়া বিভিন্ন পর্যায়ে এই আন্দোলন যুক্ত হয় বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা।  



৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে পাল্টে যায় বিএনপির ভাগ্য। পরেরদিন খালেদা জিয়ার মুক্তির আদেশে স্বাক্ষর করেন রাষ্ট্রপতি। এরপর বিএনপির বেশ কিছু সিনিয়র নেতা কারাগার থেকে মুক্তি পেতে থাকেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অনেকে কিছু মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।

 

শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনে লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপি শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের বক্তব্য-বিবৃতি প্রচার করা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকে গণমাধ্যমে তার বক্তব্য গুরুত্ব সহকারে প্রচারিত হচ্ছে।

বিএনপির নেতারা বলছেন, ৫ আগস্টের আগে মাঠ পর্যায়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। এখন সেই অবস্থা থেকে মুক্তি এসেছে। স্বাধীনভাবে রাজনীতির পাশাপাশি নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে পারছেন। বিনা বাধায় উৎসবমুখর পরিবেশে পালন করা যাচ্ছে যে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি।

এসব রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি বদলে গেছে বিএনপির দাবি-দাওয়াও। ৫ আগস্টের আগে দলের নেতাদের মুক্তি এবং দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসা ছিল বিএনপির প্রধান দাবি। এখন দ্রুততম সময়ে সংসদ নির্বাচন এবং দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে থাকা মামলা প্রত্যাহারই দলটির প্রধান দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, “গত ১৭ বছর আমরা নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়েছি। আমাদের বহু নেতাকর্মীকে খুন, গুম ও হত্যা করা হয়েছে। বহু নেতাকর্মী কারাগারে ছিল। শুধু আমরা কেন সাধারণ জনগণ নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে। সত্যি কথা বলতে গেলে বিপ্লবের পর মিথ্যা মামলাগুলো প্রত্যাহার না হলেও কারাগার থেকে আমাদের অনেক নেতাকর্মী মুক্তি পেয়েছে।’’

তিনি আরও বলেন, সেই দিক থেকে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারছি আমরা। আমরা মুক্ত ও স্বাধীন হয়েছি। মানসিক ও পারিপার্শ্বিক সব কিছু মিলিয়ে আমরা একটা সুবিধা পেয়েছি। আমরা বাধাহীন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারছি, এটা সুবিধা বলতে পারেন।

বিএনপির দাবি-দাওয়া পরিবর্তনের প্রসঙ্গে সেলিমা রহমান বলেন, আমাদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য জনগণের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া, গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেওয়া। আর গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিতে হলে জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। সেটা হবে নির্বাচনের মাধ্যমে। যার মাধ্যমে জনগণ একটি জবাবদিহিতামূলক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।  

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “১৯৭৫ সাল এবং ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ নেতিবাচক হিসেবে উপস্থিতি হয়েছে জনগণের সামনে। এর রাজনৈতিক সুবিধা খুব স্বাভাবিকভাবে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের হাতে চলে গেছে। দেশের রাজনীতিতে মানুষ আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে বরাবর বিএনপিকেই দেখেছে। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের বাইরে যদি আরেকটি কার্যকরী শক্তি থাকতো তাহলে বিএনপি হয়তো এই সুবিধা পেতো না।”  

রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা জাপা

জুলাই-আগস্টে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে এই আন্দোলনের পক্ষে সংসদ এবং সংসদের বাইরে বিভিন্ন বক্তব্য ও বিবৃতিতে দিয়েছিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে বঙ্গভবনে দাওয়া ছিল জাতীয় পার্টির।  

গত ৩১ অক্টোবর আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে জাতীয় পার্টি রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুলে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-শ্রমিক-জনতা’ ব্যানারে মশাল মিছিল করা হয়। আর ওই মিছিলে হামলার অভিযোগ এনে দলটির কাকরাইল কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।

২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করে আসছে জাতীয় পার্টি। গত চারটি সংসদে মধ্যে তিনটিতে তারা সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হওয়ার পাশাপাশি সরকারের ইচ্ছায় সংসদের বিরোধী দলীয় আসনে বসেছে।  

বৈষম্যবিরোধীদের একাংশের দাবি, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর হচ্ছে জাতীয় পার্টি। গত ১৫ বছর তারা আওয়ামী লীগের ওপর ভর করে রাজনীতি করেছে। এখন জাতীয় পার্টির ওপর ভর করে আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে ফেরার চেষ্টা করছে। যার কারণে তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তোলা হচ্ছে।

যদিও জাতীয় পার্টির নেতাদের দাবি, তরুণ নেতৃত্ব নির্ভর একটি রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে ভাঙচুর ও আগুন দিয়েছে। তারা মনে করে জাতীয় পার্টিকে রাজনীতি থেকে ধ্বংস করতে পারলে এই দলের সমর্থন ও ভোট তাদের অনুকূলে যাবে। আর আওয়ামী লীগ অতীতে বিভিন্নভাবে জাতীয় পার্টিকে ব্যবহার করলেও ভবিষ্যতে সেই সুযোগ নেই।  

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেন, “একটি দল, যারা কখনও সংসদে যেতে পারেনি, তারা জাপাকে ধ্বংস করতে চাচ্ছে। তারা মনে করছেন আমাদেরকে ধ্বংস করতে পারলে জাতীয় পার্টির ভোট তাদের পক্ষে যাবে।”

তিনি আরও বলেন, “তাদের এই ধারণা ভুল। জাতীয় পার্টির রাজনীতি ধ্বংস হলে এই ভোটগুলো বেশি পাবে বিএনপি। তারপর কিছু সুবিধা পাবে জামায়াত।”

জাতীয় পার্টিকে রাজনৈতিকভাবে ধ্বংস করা সহজ নয় উল্লেখ করে জিএম কাদের আরও বলেন, জাতীয় পার্টিকে এখন ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে প্রমাণ করার অপচেষ্টা চলছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন সফল করতে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা রক্ত দিয়েছে। আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে আমাদের অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, মামলা দেওয়া হয়েছে। কারাগারে যেতে হয়েছে। দুজন কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। এরপরও যদি গণহত্যার দায় জাপার ওপর দেওয়া হয় তা খুবই দুঃখজনক।’’

অন্যদিকে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক বলেন, আমরা আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছি, কিংবা আমাদের ওপর ভর করে তারা ফিরতে চাচ্ছে এটা ভুল। তাদের ফিরিয়ে এনে আমাদের লাভ কী?

এএইচআর/এনএফ