আগে নির্মমতা, গুম ও বিরোধী কণ্ঠ দমনে পুলিশকে ব্যবহার করা হতো। যে কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে পুরো পুলিশ বাহিনী বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুলিশকে পেশাদার ও জনমুখী সেবাদানকারী সংস্থায় পরিণত করতে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। এই সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করা জরুরি বলে মনে করছেন জননিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

এরপর থেকেই আলোচনায় আগামীর বাংলাদেশে ‘কেমন পুলিশ চাই’। এ লক্ষ্যে জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ৩ অক্টোবর ‘পুলিশ সংস্কার কমিশন’ গঠন করে। ইতোমধ্যে পুলিশ সংস্কারে সাধারণ মানুষের মতামত-পরামর্শ জানতে চেয়ে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছে কমিশন। আগামী ১৫ নভেম্বরের মধ্যে মতামত দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। জনতার পুলিশ গড়তে নেওয়া হয়েছে ব্যাপক সংস্কার প্রস্তুতি।   

এদিকে ড. ইউনুস নেতৃত্বাধীন অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আলোচনায় আসে পুলিশ সংস্কারের বিষয়টি। পুলিশ সংস্কারের কমিশন গঠনের কথা জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি এই কমিশনের দায়িত্ব দেন জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পালন করা সফর রাজ হোসেনকে। তার নেতৃত্বে গত ৩ অক্টোবর ‘পুলিশ সংস্কার কমিশন’ গঠন করা হয়। 

কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইকবাল, সাবেক বিভাগীয় কমিশনার ও যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ হারুন চৌধুরী, সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক শেখ সাজ্জাদ আলী, পুলিশের উপমহাপরিদর্শক মো. গোলাম রসুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহনাজ হুদা, মানবাধিকারকর্মী এ এস এম নাসিরউদ্দিন এলান ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি।

কমিশন গঠন পরবর্তীতে ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন প্রস্তুত করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করতে বলা হয়েছে।

ইতোমধ্যে পুলিশ সংস্কারে সাধারণ মানুষের মতামত-পরামর্শ জানতে চেয়ে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছে গঠিত কমিশন। আগামী ১৫ নভেম্বরের মধ্যে এ–সংক্রান্ত মতামত দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। পুলিশ সংস্কার কমিশনের ওয়েবসাইটে ‘কেমন পুলিশ চাই’ শীর্ষক এক জনমত জরিপ বিজ্ঞপ্তিতে এ অনুরোধ জানানো হয়েছে। মতামত গোপন রাখা হবে। মতামতগুলো শুধু পুলিশ সংস্কারের জন্য ব্যবহার করা হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

দেশের মানুষ কেমন পুলিশ চায়

খিলগাঁও থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নুরুজ্জামান জনি। ২০১৫ সালের ২০ জানুয়ারি রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে তিনি নিহত হন। এর আগে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছিল। ‘ক্রসফায়ারের নামে হত্যা’র অভিযোগে ডিএমপির তৎকালীন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াসহ বর্তমান ও সাবেক ১৩ পুলিশ কর্মকর্তাকে আসামি করে গত ৩ সেপ্টেম্বর থানায় মামলা দায়ের করেন জনির বাবা ইয়াকুব আলী।

ডিএমপির খিলগাঁও থানায় দায়ের করা ওই মামলায় ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন সাবেক ডিএমপি সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।

পুলিশের হাতে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে ছেলে জনিকে চিরতরে হারানো বাবা ইয়াকুব আলীর কাছে জানতে চাওয়া হয় কেমন পুলিশ চান তিনি।

তিনি বলেন, ‘আমি এমন পুলিশ চাই না, যেখানে হেফাজতে নিয়ে বন্দুকযুদ্ধের নামে কাউকে হত্যা করা হবে। পুলিশে আনা হোক আমূল পরিবর্তন। নিখোঁজ মাত্রই পুলিশ তৎপর হবে। কাউকে আটক বা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নিলে পরিবারকে যেন জানানো হয়। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ যেন দেওয়া হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জনরোষের বড় একটা কারণ ছিল বলপ্রয়োগ। যেটা বেশি করেছিল পুলিশই। যার বলি আমার ছেলে। ৫ আগস্টের গণবিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে পরিবর্তন এসেছে তার প্রভাবে যেন বদলে যায় পুলিশ। আর কারো মায়ের বুক যেন খালি না হয়,  পুলিশ হেফাজতে নিরীহ কেউ যেন নিরপরাধ মারা না যায়।’

অপরদিকে কোটার সংস্কার প্রশ্নে তেঁতে উঠা আন্দোলন আরও তেঁতে উঠার নেপথ্যের যতগুলো কারণ ছিল তারমধ্যে অন্যতম ছিল পুলিশের অতিরিক্ত বল প্রয়োগ। যার প্রথম নজির রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেখানে বুলেট ছোড়ার পরিস্থিতিও ছিল না, সেখানে আন্দোলনকারী আবু সাঈদকে কাছে থেকে গুলি করে পুলিশ। ওই নির্মম ঘটনার ভিডিও দেখে সাধারণ জনতা নেমে পড়ে আন্দোলন। ছাত্রদের কোটা সংস্কারের আন্দোলন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পরিণত হয়। হাজারের বেশি ছাত্র-জনতার মৃত্যু আর হাজার হাজার মানুষ আহতের ঘটনায় আন্দোলন এক দফায় রূপ নেয়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসান ঘটে।

পুলিশের উন্মত্ত আচরণের শিকার সাংবাদিকরা

গত ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় যাত্রাবাড়ী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সাংবাদিক মেহেদী হাসান। অথচ ঘটনার পর যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ মেহেদীকে আন্দোলনকারী, নাশকতাকারী হিসেবেই দেখিয়েছে।

রাজধানীতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে নিহত হন ঢাকা টাইমসের সিনিয়র রিপোর্টার মেহেদী হাসান (৪০)।

ছেলেকে হারানোর পর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাবা মোশারেফ হোসেন হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘হার্টের রোগী আমি, তিনটা ব্লক আছে আমার হার্টে। মেহেদীর স্বপ্ন ছিল আমার হার্টের অপারেশন করাবে। সব স্বপ্ন ভেঙে গেছে। প্রতি মাসেই আমার ওষুধ লাগে। আমার ছেলেটাও নেই আমার ওষুধও নেই। কে আমারে ওষুধ কিনে দেবে? কে আমারে দেখবে? কে আমার সংসার চালাবে? এখন আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি।’

মেহেদীর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মেহেদীর নিথর দেহের ছবি যারা দেখেছেন তারা সবাইকে একমত হবেন মেহেদীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। কাছে থেকে গুলি করে ঝাঁজরা করে দেওয়া হয়েছে।  সাংবাদিক হয়েও রেহাই মেলেনি মেহেদীর। এমন অনেকে মারা গেছেন, পরিবারে পথে বসেছে, সন্তানরা এতিম হয়েছে। অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে পুরো পরিবার। এমন পুলিশে বড় পরিবর্তন দরকার।’

তিনি বলেন, ‘আমি চাই মানবিক পুলিশ, বিবেকবান পুলিশ, গুলি করে মানুষ মারা পুলিশ আমি চাই না। কেউই সেটা চাইবে না। সত্যিকারের জনগণের বন্ধু হিসেবেই দেখতে চাই। পুলিশ যদি নিজেকে ভিকটিমের জায়গায় দাঁড় করে একবার ভাবে তাহলে কখনো পুলিশ অমানবিক হবে না, ওপর যত চাপই আসুক। আর অপরাধী পুলিশ মাত্রই শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হোক। তাতে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে। ভবিষ্যতে কেউ অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ পাবে না।’

সরকারি চাকরিতে কোটার সংস্কারের আন্দোলনের শুরু থেকেই পুলিশকে মারমুখী ভূমিকা পালন করা পুলিশকে ঘিরে সমালোচনা ছিল আগে থেকেই। বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক পরিচয় ও আর্থিক লেনদেনে বদলি, পদোন্নতি ও নানা ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মত ঘটনায় সমালোচিত হয়েছে পুলিশ। বার বার অপেশাদার আচরণের কারণে পুলিশ মানুষের আস্থার হারিয়েছে। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে পেশাদারিত্ব নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। তবে জুলাই আগস্ট আন্দোলনে নির্বিচারে অস্ত্র ব্যবহারের কারণে অতীতের সকল সমালোচনাকে ছাড়িয়ে যায় বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। নিয়োগ বদলি ও পদোন্নতি রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত করা। আর এসব কর্মকাণ্ড তদন্তে স্বতন্ত্র কমিশন গঠনের পরামর্শ তাদের।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুর মোহাম্মদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কেমন পুলিশ চাই এই প্রশ্ন বহুদিনের। আমি যখন পুলিশে যোগদান করি তখন এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আবার পুলিশ থেকে চলে এলাম তখনও একই প্রশ্ন শুনতে হয়েছে। এখন আবারও সেই প্রশ্নের মুখোমুখি আমরা। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাইনি। শুধু শুনেছি পুলিশকে ঢেলে সাজাতে হবে। কখনো ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ আমরা দেখিনি। সরকার পরিবর্তন হয়েছে। পুলিশে খরচ বেড়েছে, সাময়িক সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে, পোষাক, বাড়ি-ঘর, অফিস, গাড়ির পরিবর্তন আসছে পুলিশে। কিন্তু পুলিশের মগজে পরিবর্তন আসেনি। মগজ সাফ বা ধোলাই কখনো কেউ করেনি।’

পুলিশ সংস্কারের ধারাবাহিকতা রক্ষায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা গুরুত্বপূর্ণ

সাবেক আইজিপি নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কমিটমেন্টটা কি? পুলিশকে ঢেলে সাজাবে কে? কোনো সংস্থা কি নিজে থেকে ভালো হতে পারে। যদি সরকার নির্দেশনা বা পরামর্শ না দেয়। অতীতে পুলিশকে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সেখানে সরকারের বাইরে গিয়ে পুলিশের তো কিছু করার থাকে না।

অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার এইবার এই পুলিশ সংস্কারে হাত দিয়েছে। আমরা তাই আশাবাদী। কিন্তু পুলিশ সম্পর্কে মানুষের ধারণা খারাপ। আবার বিপরীতও আছে। মানুষের যখন সাহায্য দরকার, তখন পুলিশকেই আগে খোঁজে। এটা থাকবেই। এটা রাতারাতি কাটিয়ে উঠার নয়। রাজনৈতিক কমিটমেন্ট আগে জরুরি। সুরক্ষার জন্য একটা রক্ষাকবজ জরুরি সেটা হচ্ছে যে সংস্কার হচ্ছে সেটা পরবর্তীতে যে রাজনৈতিক সরকারই আসুক সেটা রক্ষা বা মেনে চলবে। তবে পুলিশকে ঢেলে সাজানো সম্ভব।’

চাই বিজ্ঞান সম্মত পরিবর্তন, জনবান্ধব পুলিশ

সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি অন্যান্য নাগরিকের মতোই জনবান্ধব পুলিশ চাই। যেখানে পরিবর্তন আসবে বিজ্ঞানসম্মত। যেখানে জনগণের প্রতি ও জনমুখী সেন্টিমেন্ট বোঝার মানসিকতাসম্পন্ন পুলিশ। মাত্রাতিরিক্ত শক্তিপ্রয়োগ করবে না এমন পুলিশ চাই, যেখানে পুলিশ থাকবে পুরোপুরি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত।’

অপকর্ম-দুর্নীতি করার সব সুযোগ বন্ধ করতে হবে 

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আসিফ শওকত কল্লোলের কাছে জানতে চাওয়া হয় ‘কেমন পুলিশ চান’। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পুলিশকে আচরণগত শিক্ষায় বদল আনতে হবে। জনবান্ধব প্রশিক্ষণের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা যেমন থাকবে, তেমনি কে কতটা জনবান্ধব কর্মকর্তা বা সদস্য সেটার একটা মার্কিং ব্যবস্থা থাকতে হবে। রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তি থেকে বের করে আনতে হবে। যারা পুলিশকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করবেন তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে সেটা সংস্কারে ও আইনগতভাবে অর্ন্তভুক্ত করতে হবে। পুলিশে অপকর্ম, দুর্নীতি বন্ধে সব ধরনের ছিদ্র বন্ধ করতে হবে। বিসিএস (পুলিশ) নিয়োগ ও বদলিতেও সংস্কার আনতে হবে। যে সংস্কার কার্যক্রম চলছে তার আইনগত ভিত্তি দিতে হবে। যে আমলেই হোক, অপরাধমূলক বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।’

পুলিশের জবাবদিহি ও দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করতে হবে

পুলিশের জবাবদিহি ও দায়িত্বশীলতা গত ১৫ বছরে নষ্ট হয়ে গেছে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এস এম জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে পুলিশকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। আগে জেলা পর্যায়েও আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় জনপ্রতিনিধিদের তোপের মুখে পড়তে হতো পুলিশ কর্মকর্তাদের। পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে এতটাই ব্যবহার বা জড়ানো হয়েছে তাতে গত ১৫ বছরে সেই জবাবদিহি পুলিশকে করতে হয়নি। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এখন জরুরি।’

‘দানবিক’ পুলিশকে মানবিক করতে প্রয়োজন স্বাধীন পুলিশ কমিশন

‘জনমুখী পুলিশ সেবা নিশ্চিতকল্পে পুলিশ কমিশন গঠন ও অন্যান্য সংস্কারের প্রস্তাব’ শীর্ষক এক সেমিনারে অন্তর্বর্তী সরকারের নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘পুলিশের ভেতর থেকেই এখন একটি কমিশন গঠনের দাবি উঠেছে। বিগত সরকারের সময়ে পুলিশকে ‘দানবিক’ করা হয়েছে। পুলিশকে মানবিক করতে হলে স্বাধীন পুলিশ কমিশন করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘বিগত সরকারের সময়ে পুলিশে পদায়নের ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের ঘুষ লেনদেনের কথা শোনা গেছে। ঘুষ–বাণিজ্যের যে-সব তথ্য তিনি জেনেছেন, সেটি দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) বলেছেন। একজন পুলিশ সুপার নিয়োগে দুই কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এমনকি ঢাকায় একজন ওসির (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) পদায়নেও দুই কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এটা যদি হয়, তাহলে এই পুলিশ থেকে কোনো কিছুই প্রত্যাশা করা যায় না। পুলিশে ‘বাণিজ্য’ বন্ধ করতে হলে নিয়োগপ্রক্রিয়ার পরিবর্তন করতে হবে, স্বচ্ছতা আনতে হবে।’

মব নিয়ন্ত্রণে বলপ্রয়োগ পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রস্তাব

ফৌজদারি কার্যবিধির কিছু ধারা পরিবর্তনের বিষয়ে যাচাই করছে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত পুলিশ সংস্কার কমিশন। গত ৪ নভেম্বর কমিশনের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানাতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন কমিশন প্রধান সফর রাজ হোসেন। 

বৈঠকে তিনি জানান, পুলিশ সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যে ১০টি সভা করেছে। পাশাপাশি অংশীজনদের সঙ্গে আরও ৪টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পুলিশ সংস্কারের বিষয়ে জনসাধারণের মতামত চেয়ে একটি প্রশ্নমালা প্রস্তুত করা হয়েছে এবং সেটি ইতোমধ্যে ওয়েবসাইটেও দেওয়া হয়েছে। সফর রাজ হোসেন জানান, পুলিশের কিছু আইন ও বিধি সংশোধনের প্রস্তাব এসেছে যেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। এছাড়া কয়েকটি প্রক্রিয়া সহজ করে তোলার জন্য যথাযথ প্রস্তাব করা হচ্ছে।

তিনি জানান, মব নিয়ন্ত্রণে বলপ্রয়োগ পদ্ধতি পরিবর্তন করার প্রস্তাব নিয়ে কাজ চলছে। এছাড়া, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর কিছু ধারা পরীক্ষা করা হচ্ছে এবং তা পরিবর্তন করা হবে কি না, সেটি যাচাই করে দেখা হচ্ছে।

সংস্কার প্রক্রিয়া কতদূর জানতে যোগাযোগ করা হলে কমিশন চেয়ারম্যান সফর রাজ হোসেন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, অগ্রগতি এখনই জানানো সম্ভব না।

সংস্কারে মতামতে ব্যাপক সাড়া, জন পরামর্শকে গুরুত্ব দিচ্ছে কমিশন

পুলিশ সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, গণবিজ্ঞপ্তি জারির পর অভূতপূর্ব সাড়া মিলেছে। সাধারণ মানুষ যেভাবে পুলিশকে দেখতে চান তা মতামত দিচ্ছেন। আমরা ইতিবাচক হিসেবে প্রত্যেকটি মতামত গুরুত্ব দিচ্ছি। পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধ, হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় কঠোর শাস্তি, দেড়শ বছরের পুরোনো আইন সময়োপযোগী করা, মব জাস্টিস বন্ধে কার্যকরী উদ্যোগ, জনবল বৃদ্ধি, স্মার্ট পুলিশিং, ট্রাফিকিং, বাহিনীতে চেইন অব কমান্ড স্ট্রাকচার, কর্মকর্তাদের অপকর্ম ও ঘুষ নেওয়া বন্ধে কার্যকর উদ্যোগসহ পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার পরামর্শ এসেছে। আমরা কাজ করছি। আশা করছি সময় লাগলেও একটা কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাতে পারবো। 

জেইউ/এমএসএ