জনপ্রশাসনে সংস্কার : তদবির বন্ধের তাগিদ বিশেষজ্ঞদের
জনপ্রশাসনে সংস্কার আনতে কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ইতোমধ্যে বিভিন্ন পেশার নাগরিকদের মতামত জানতে চেয়েছে এ সংক্রান্ত কমিশন। পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে তদবির বন্ধসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে তাগিদ দিয়েছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলারা।
গত ৩ অক্টোবর আট সদস্যের জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এ কমিশনের প্রধান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী। জনমুখী, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক এবং নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এ কমিশন গঠন করা হয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে। ৯০ দিনের (৩ মাস) মধ্যে প্রস্তুত করা প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হবে।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, ইতোমধ্যে কয়েকটি বৈঠকও করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। সংস্কারের বিষয়ে বিভিন্ন পেশার নাগরিকদের মতামত জানতে চেয়েছে এ কমিশন। আগামী ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত অনলাইনে ও সরাসরি নাগরিকরা তাদের অভিপ্রায় ও অভিমত জানাতে পারবেন।
গত ৩ অক্টোবর আট সদস্যের জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এ কমিশনের প্রধান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী। জনমুখী, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক এবং নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এ কমিশন গঠন করা হয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে। ৯০ দিনের (৩ মাস) মধ্যে প্রস্তুত করা প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হবে
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলারা বলছেন, জনপ্রশাসনে প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি সংস্কার করতে হবে। নিয়োগে স্বচ্ছতা, প্রশিক্ষণে গুরুত্ব, পদোন্নতি ও পদায়নে তদবির ও বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।
তদবির বন্ধের তাগিদ
সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘জনপ্রশাসনের সংস্কারে প্রথমে নিয়োগ পদ্ধতির স্বচ্ছতা আনতে হবে। এটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। এরপর আছে প্রশিক্ষণ।’
‘আমরা তো গণকর্মচারীদের গণকর্মচারী বানাতে পারছি না। প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের পাঠানো হয়, তারপর তারা জনগণের ওপর লাঠি ঘুরায়! অফিস-আদালতে জনগণ প্রকৃত সেবা পায় না। তার মানে, আমাদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের গলদ আছে। যেটা গণকর্মচারীদের জনগণের সেবক হিসেবে রূপান্তর করতে পারছে না। তাই এ বিষয়ে জোর দিতে হবে।’
তিনি বলেন, পদায়নের ক্ষেত্রেও নজর দিতে হবে। এটা তো বিশাল ব্যাপার। যার যার পছন্দ মতো পদায়ন দিতে হবে! রাজনীতিবিদরা তদবির করবেন! যিনি চাকরি করেন, তার প্রভাবশালী আত্মীয়-স্বজন তদবির করবেন! এগুলো বন্ধ করতে হবে। পদায়নে স্বচ্ছতা আনতে হবে।
‘তদবির আইনে নিষিদ্ধ থাকলেও এটি কেউ মানে না। বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে। এরপর আছে পদোন্নতি। পদোন্নতি যেভাবে দেওয়া হয় এবং যেভাবে দেওয়া হচ্ছিল, সেখান থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে হবে। স্বচ্ছ ও মেধাভিত্তিক পদোন্নতি দিতে হবে।’
সাবেক এ সচিব বলেন, যে পদ্ধতি আছে সেই পদ্ধতিতে এগুলো মোকাবিলা করার সম্ভব। কিন্তু এগুলো কেন বন্ধ হয় না? এখানে রাজনীতির ভূত ঢুকে পড়েছে। তদবির করে পদোন্নতি হচ্ছে, পদায়ন হচ্ছে। এ জন্য আপনি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবেন না? গণকর্মচারীদের তদবিরের কানেকশন থেকে মুক্ত করতে হবে। যে কোনো রাজনৈতিক দল হোক, ব্যক্তি হোক বা কোনো উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি হোক; গণপ্রশাসনের কোনো কর্মচারীর জন্য কেউ কোনো তদবির করবেন না। এ তদবির থেকে বের হয়ে আসলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
পদায়ন-পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় দরকার আমূল পরিবর্তন
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিয়োগ পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পছন্দ ও ব্যক্তিগত বিদ্বেষ বন্ধের উপায় খুঁজতে হবে। পদায়ন আর পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। যোগ্য ও দক্ষদের পদায়ন ও পদোন্নতি দিতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি যাতে না হয় সেটিও খেয়াল রাখতে হবে।
আরও পড়ুন
‘প্রশাসনে কর্মরতদের মন-মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। ভবিষ্যৎ চিন্তা করে প্রশাসনকে সাজাতে হবে। পদোন্নতি ও পদায়নে সবচেয়ে বেশি ঝামেলা হয়। কর্মচারীরা রাজনীতি করে কেন? পদোন্নতি আর পদায়নের জন্য। ওই দুই জায়গায় আমূল সংস্কার আনতে হবে।’
‘ইচ্ছা করলে কাউকে পদোন্নতি দিতে পারব না বা পদোন্নতি থেকে বাদ দিতে পারব না। খেয়াল-খুশি মতো পোস্টিং দিতে পারব না। যদি এগুলো করা হয় তাহলে জবাবদিহি করতে হবে।’
সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন বলেও মনে করেন এ জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ। তার মতে, ‘রাজনৈতিক দলগুলো চায়, তাদের কথা যে শুনবে ওই কর্মকর্তাকে তাদের প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে যোগ্য ও দক্ষ না হলেও সমস্যা নেই। এটা বন্ধ করতে হবে। এ জন্য পদায়ান ও পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। সংস্কার করে যদি বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি বন্ধ করা যায় তা হলে এর কিছুটা সুফল জনগণ পাবেন, সেবাপ্রত্যাশীরা পাবেন।’
অনিয়ম হলে দিতে হবে শাস্তি
সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান বলেন, ভালো কাজের জন্য পুরস্কার দেবেন আর মন্দ কাজের জন্য শাস্তি দেবেন— এটি আইনের মধ্যেই আছে। সে ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, জনগণকে কষ্ট দেওয়া— এগুলো যাতে জনপ্রশাসনের কর্মচারীরা করতে না পারেন, সে জন্য কঠোর হওয়া এবং উচ্চ পর্যায় থেকে মনিটরিং করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এটা কীভাবে করা যায়, সেটিরও একটা সাজেশন থাকতে পারে।
আরও পড়ুন
সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘আইনে আছে, দুর্নীতির দায়ে যদি এক বছর জেল খাটেন, চাকরি যাবে না। জেল খেটে এসে আবারও ওই চেয়ারে বসবেন, আগে যে চেয়ারে ছিলেন! এ ধরনের আইন যাতে না থাকতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। এ আইন যারা করেন তাদেরও যাতে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা যায়, সে ব্যবস্থাও রাখতে হবে।’
‘আপনি দুর্নীতি করলেন, এক বছর জেল খাটলেন, আপনার কিন্তু চাকরি যাবে না। এটা তো কোনো সভ্য দেশের আইন হতে পারে না।’
অনিয়ম করলে অবশ্যই আইন অনুযায়ী শাস্তি দিতে হবে। তা হলে কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা ভয় পাবেন। অনিয়ম অনেক কমে আসবে— মনে করেন মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া।
এসএইচআর/এমএআর/