দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের প্রতিষ্ঠান ‘প্রাণ’। শূন্য থেকে যার যাত্রা শুরু। এখন দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সফলতার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। বহুমুখী উৎপাদন, আধুনিক কৃষি-ব্যবস্থায় স্থানীয় কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ, সৃজনশীল বিপণন ও গুণগত মান নিশ্চিত করার কারণে দেশে ও বিশ্ববাজারে প্রাণ খাদ্যপণ্যের প্রসার দিনদিন বেড়ে চলেছে। প্রাণপণ্যে আস্থা রাখছেন নতুন নতুন ভোক্তা। 

বিপুল সংখ্যক ভোক্তার আস্থার বিষয়টি মাথায় রেখে এবার গাজীপুরের কালীগঞ্জ ইকোনমিক জোনে একটি শিল্পপার্ক গড়ে তুলেছে প্রতিষ্ঠানটি। নতুন এ শিল্পপার্কে রয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ফ্লাওয়ার মিল। প্রতিদিন ৫০০ টন উৎপাদন সক্ষমতার এ কারখানায় হাতের কোনো স্পর্শ ছাড়াই সম্পূর্ণ অটোমেটিক মেশিনে উৎপাদিত হচ্ছে আটা-ময়দা ও সুজি। যা ইতোমধ্যে বাজারজাত হচ্ছে।

কালীগঞ্জের মুক্তারপুর ইউনিয়নে ১৮০ বিঘা জমিতে ‘কালীগঞ্জ অ্যাগ্রো প্রসেসিং লিমিটেড’ নামের এ শিল্পপার্ক স্থাপনে প্রাথমিকভাবে দেড় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। ইতোমধ্যে সেখানে প্রায় ৭১৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। শিল্পপার্কটিতে প্রায় ৯০০ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। পুরোদমে চালু হলে তিন হাজার লোকের কাজের সুযোগ হবে

আটা-ময়দা ছাড়াও প্রাণের এ শিল্পপার্কে ভোজ্যতেল, লবণ, ডাল, স্টার্চ, মসলা, বেভারেজ, নুডলস, বিস্কুট, কনফেকশনারি, পোলট্রি ফিড ও ফ্লেক্সিবল প্যাকেজিংসহ বেশ কয়েকটি পণ্য উৎপাদিত হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কালীগঞ্জের মুক্তারপুর ইউনিয়নে ১৮০ বিঘা জমিতে ‘কালীগঞ্জ অ্যাগ্রো প্রসেসিং লিমিটেড’ নামের এ শিল্পপার্ক স্থাপনে প্রাথমিকভাবে দেড় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। ইতোমধ্যে সেখানে প্রায় ৭১৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে।

সরেজমিনে শিল্পপার্কটি ঘুরে দেখা যায়, দু-তিনটি কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কয়েকটির যন্ত্রপাতি বসানো প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ ছাড়া কয়েকটি কারখানা নির্মাণাধীন। ইতোমধ্যে শিল্পপার্কটিতে প্রায় ৯০০ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। পুরোদমে চালু হলে তিন হাজার লোকের কাজের সুযোগ হবে। 

কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে মান

শিল্পপার্কটিতে প্রায় ২১ বিঘা জায়গায় ১০ তলার সমান উচ্চতায় নির্মাণ করা হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির স্বয়ংক্রিয় ফ্লাওয়ার মিল বা আটা-ময়দার কারখানা। নতুন এ কারখানার প্রযুক্তি ও যন্ত্রাংশ আনা হয়েছে ইউরোপ থেকে। ডিজিটাল মেশিনে পুরো কারখানা নিয়ন্ত্রণ ও উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিচালিত হচ্ছে। সম্পূর্ণ অটোমেটেড এ কারখানায় কাঁচামাল আনলোড থেকে শুরু করে পণ্য প্যাকেজিং এবং ক্রেতার হাতে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার আগ পর্যন্ত সবকিছু হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে। 

শিল্পপার্কটিতে প্রায় ২১ বিঘা জায়গায় ১০ তলার সমান উচ্চতায় নির্মাণ করা হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির স্বয়ংক্রিয় ফ্লাওয়ার মিল বা আটা-ময়দার কারখানা। নতুন এ কারখানার প্রযুক্তি ও যন্ত্রাংশ আনা হয়েছে ইউরোপ থেকে। ডিজিটাল মেশিনে পুরো কারখানা নিয়ন্ত্রণ ও উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিচালিত হচ্ছে

গম পেতে ৬০০ একর জমি লিজ

প্রাণের আটা-ময়দার সর্বোচ্চ গুণগতমান নিশ্চিতের জন্য রাশিয়া, ইউক্রেনের পাশাপাশি কানাডা ও আমেরিকা থেকে গম আমদানি করা হচ্ছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক নাসের আহমেদ। তিনি বলেন, এসব অঞ্চলের গমে প্রোটিনের মাত্রা ভালো থাকে। তবে স্থানীয়ভাবে লালমনিরহাট, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়সহ কয়েকটি জেলা থেকেও গম সংগ্রহ করা হবে। এ ছাড়া প্রাণ নিজেই জমি লিজ নিয়ে ভালো প্রোটিন পাওয়া যায় এমন গম উৎপাদন করবে। প্রাণ এরই মধ্যে গমসহ অন্য ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে উত্তরাঞ্চলে ৬০০ একর জমি লিজ নিয়েছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন মিলগুলোতে প্রতি বছর ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টন গমের চাহিদা রয়েছে। এর বেশির ভাগ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। স্থানীয়ভাবে ১০-১২ লাখ টন সংগ্রহ করা হয়। সেখান থেকে যে আটা-ময়দা ও সুজি উৎপাদিত হচ্ছে তার বাজারদর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এসব আটা-ময়দার মধ্যে বিভিন্ন ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ও হোটেলগুলোতে ব্যবহার হয় প্রায় ৭৫ শতাংশ। বাকিটা ভোক্তারা বাসাবাড়িতে প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য তৈরিতে ব্যবহার করেন। প্রতি বছর দেশে আটা-ময়দার চাহিদা ৮-১০ শতাংশ হারে বাড়ছে।

যেভাবে নিশ্চিত করা হয় গমের মান

প্রাণের জেনারেল ম্যানেজার (উৎপাদন) প্রকৌশলী ইন্দ্রজিত কুমার বলেন, পণ্যের গুণগতমান বজায় রাখার জন্য কয়েকটি ধাপে কারখানায় আটা-ময়দা ও সুজি তৈরি করা হচ্ছে। আমদানি করা গম মাদার ভ্যাসেল থেকে লাইটারের মাধ্যমে সরাসরি সাইলোতে নেওয়া হয়। এখানে কাঁচামাল রাখার জন্য ১০ হাজার টন সক্ষমতার ছয়টি এবং এক  হাজার টন সক্ষমতার তিনটি সাইলো রয়েছে। এ ছাড়া আরও ছয়টি সাইলো বসানো হবে।

সাইলো থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গম চলে যায় মেশিনে। এরপর সেপারেটর মেশিনের মাধ্যমে গম থেকে বার্লিসহ ময়লা আলাদা করা হয়। পরে স্টোন সেপারেটর মেশিনের মাধ্যমে পাথর আলাদা করার পর কোকো সিলিন্ডার মেশিনের মাধ্যমে ভাঙা ও অপরিপক্ব গম আলাদা করা হয়। পরবর্তীতে কয়েকটি ধাপে ক্লিনিং ও ম্যাগনেট সেপারেটর মেশিন হয়ে সম্পূর্ণ ফ্রেশ গম পাওয়ার পর ক্র্যাশিং কার্যক্রম শুরু হয়। ক্র্যাশিং পর্যায়ে কয়েকটি ধাপ পার হয়ে আটা-ময়দা তৈরি হওয়ার পর প্যাকেটজাত করা হয়।

গমের পুষ্টিমান পরিমাপের জন্য কারখানায় অত্যাধুনিক ল্যাবের মাধ্যমে গমের গুণগতমান পর্যবেক্ষণ করা হয়— জানিয়ে তিনি আরও বলেন, বাজারে আটা-ময়দার সবচেয়ে বেশি চাহিদা রেস্টুরেন্ট, বেকারি শিল্পসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য উৎপাদনে। এরপর এর চাহিদা রয়েছে বাসাবাড়িতে। শুরুতে প্রাণ গ্রুপের উৎপাদিত ৫০ কেজির বস্তা নিজস্ব ডিলারের মাধ্যমে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের দোকানে পৌঁছে দেওয়া হতো। এখন প্রাণ ব্র্যান্ডের এক কেজি ও দুই কেজির প্যাকেটেরও পরীক্ষামূলক প্যাকেজিং চালু হয়েছে।

বিনিয়োগ সম্পর্কে যা বলছে প্রাণ

ফ্লাওয়ার মিলে নতুন বিনিয়োগ নিয়ে প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা বলেন, শুধু ফ্লাওয়ার মিলের মেশিনারি ও অন্যান্য বিল্ডিং নির্মাণে এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ১১০ কোটি টাকা। শিগগিরই উৎপাদন সক্ষমতা দ্বিগুণ করা হবে। ভোগ্যপণ্যের বাজারের বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে আটা-ময়দা। দেশে প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যের চাহিদাও বাড়ছে। পাশাপাশি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যেমন বেড়েছে তেমনি বিস্কুট, বেকারি, নুডলস, ফ্রোজেন ফুডসের বাজার দিনদিন বড় হচ্ছে। ফলে বর্তমানে বড় বড় কোম্পানি বেকারি, কুলিনারিসহ খাদ্যপণ্যের ব্যবসায় মনোনিবেশ করছে। এ কারণে আটা-ময়দার চাহিদাও ব্যাপক বেড়েছে।

‘অত্যাবশ্যকীয় এ নিত্যপণ্যের চাহিদা মেটাতে এ খাতে বিনিয়োগে এসেছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। আমরা বিশ্বাস করি, ভোগ্যপণ্যের বাজারে যত নতুন নতুন উদ্যোক্তা আসবেন, বাজার তত প্রতিযোগিতামূলক হবে। এতে ভোক্তারাই লাভবান বেশি হবেন।’

তিনি আরও বলেন, আমাদের এ শিল্পপার্কে ফিডমিল চালু রয়েছে যা প্রোটিন সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আমরা ভোগ্যপণ্যের বাজারে ভালো একটি অবস্থান তৈরি করতে চাই। এজন্য সিড ক্র্যাশিং, ভোজ্যতেল, লবণসহ বেশ কয়েকটি পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে কারখানায় কাজ চলমান। আশা করছি, আগামী দুই বছরের মধ্যে ভোক্তারা প্রাণের বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্য হাতে পাবেন।

চিনির বিকল্প ফ্রুক্টোজ উৎপাদনের উদ্যোগ

ভুট্টার সাইলেজ থেকে চিনির বিকল্প হিসেবে গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা। তিনি বলেন, চাহিদা অনুযায়ী দেশে আখের উৎপাদন কম হওয়া এবং চিনি আমদানিতে অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে খুচরা পর্যায়ে চিনি ও চিনিসমৃদ্ধ খাবারের দাম অনেক বেশি হয়। সেজন্য আমরা ভুট্টার সাইলেজ ব্যবহার করার মাধ্যমে চিনির বিকল্প হিসেবে ফ্রুক্টোজ উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ফ্রুক্টোজ একটি প্রাকৃতিক চিনি যা মূলত ফল, মধু ও কিছু শাকসবজিতে পাওয়া যায়। এটি চিনির বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং প্রাকৃতিকভাবে মিষ্টি হওয়ায় খাদ্যশিল্পে জনপ্রিয়। ফ্রুক্টোজ সাধারণ চিনির তুলনায় প্রায় দেড় গুণ বেশি মিষ্টি। এ কারণে এটি কম পরিমাণে ব্যবহার করেও বেশি মিষ্টতা দেয়। এটির উৎপাদন খরচও চিনির তুলনায় অনেক কম। যা সাধারণ মানুষকে অনেক স্বস্তি দেবে বলে মনে করি।

আরএইচটি/এমএআর/