আলোচিত-সমালোচিত সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক রাজধানী ঢাকার বারিধারায় পাঁচ একর সরকারি জমি দখল করে আটতলাবিশিষ্ট সাতটি বাড়ি নির্মাণ করে শতাধিক ফ্ল্যাট বিক্রি করেছেন। কাগজপত্রে তিনি দাবি করেছেন ওই সম্পত্তি তার পূর্ব পুরুষের। তবে, সরকারি নথিতে জমিটি জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার (জার) নামের একটি সংস্থাকে লিজ দেওয়ার কথা উল্লেখ আছে। সংস্থাটির নামে ১৯৯৮ সালে ১০ একর জমি ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেয় সরকার। জমিটির পাঁচ একর মানিক দখল করে নির্মাণ করেন ওই স্থাপনা।

অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাব খাটিয়ে জাল নথি তৈরি করে পাঁচ একর জমি পৈত্রিক সম্পত্তি হিসেবে দেখান বিচারপতি মানিক। পরে সেখানে নিজস্ব ডেভেলপার দিয়ে সাতটি বহুতল ভবন নির্মাণ করেন। যার মূল্য প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে সরকারি বাড়িতে থেকে ভাড়া না দেওয়া এবং অর্থপাচার করে লন্ডনে বাড়ি কেনারও অভিযোগ রয়েছে।

এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর নথিপত্র সংগ্রহের কাজ চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘তার (বিচারপতি মানিক) বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, সরকারি জমি দখল করে স্থাপনা নির্মাণ, সরকারি বাসায় থেকেও ভাড়া না দেওয়া এবং বিদেশে অর্থপাচারসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ অনুসন্ধানে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা কাজ শুরু করেছেন। অনুসন্ধান শেষে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে।’

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাব খাটিয়ে জাল নথি তৈরি করে পাঁচ একর জমি পৈত্রিক সম্পত্তি হিসেবে দেখান বিচারপতি মানিক। পরে সেখানে নিজস্ব ডেভেলপার দিয়ে সাতটি বহুতল ভবন নির্মাণ করেন। যার মূল্য প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে সরকারি বাড়িতে থেকে ভাড়া না দেওয়া এবং অর্থপাচার করে লন্ডনে বাড়ি কেনারও অভিযোগ রয়েছে
ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় গত ২৩ আগস্ট বিজিবির হাতে আটক হন সাবেক বিচারপতি মানিক / ছবি- সংগৃহীত

যেভাবে সাংবাদিকদের জমি দখল

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, দুস্থ ও অসহায় সাংবাদিকদের পুনর্বাসনের জন্য জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার (জার) নামে একটি সংস্থাকে ঢাকার বারিধারায় ১০ একর জমি লিজ দেয় সরকার। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক প্রভাব খাটিয়ে ওই জমির পাঁচ একর দখলে নেন। দখল করার সময় ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে নিজের পৈতৃক সম্পত্তি দাবি করেন মানিক। এরপর অ্যাডভান্স ডেভেলপমেন্ট নামের একটি কোম্পানিকে দিয়ে সেখানে তৈরি করেন আটতলাবিশিষ্ট সাতটি ভবন। যেখানে রয়েছে শতাধিক ফ্ল্যাট।

যদিও সরকারি নথিপত্রে জমির আদি-মালিকানা ১৮৮৫ সাল থেকে আইন উদ্দিন হায়দার ও ফয়জুন্নেছা ওয়াকফ এস্টেটের। যা ২০০৪ সালে জমিটি জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ওয়েলফেয়ারকে (জার) ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়। যখন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, তখন সেটি ডোবা ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ওই জমির পাঁচ একর বিচারপতি মানিক জোরপূর্বক দখল করে নেন। তিনি ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে জমিটি দখল করেন। কেউ কোনো অভিযোগ দিলে তাকে বিভিন্নভাবে হেনস্তা করতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

২০১২ সালে শামসুদ্দিন মানিক লন্ডনে তিনটি বাড়ি ক্রয় করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। সেখানে নিজের ও পরিবারের নামে আরও সম্পত্তি আছে বলে জানা গেছে।

ছয়টি হত্যা মামলায় বিচারপতি মানিককে গ্রেপ্তার দেখানো হয় / ছবি- সংগৃহীত

সরকারি বাড়ির ভাড়া পরিশোধ না করায় নোটিশ

বিচারপতি মানিকের বিরুদ্ধে সরকারি বাড়ির ভাড়া পরিশোধ না করারও অভিযোগ আছে। ওই অভিযোগ অনুসন্ধানে গত ২১ আগস্ট সাজ্জাদ হোসেন ও রওশন আলী নামের দুই আইনজীবী দুদকে নোটিশ দেন।

নোটিশ সূত্রে জানা যায়, সরকারি বাড়িতে থাকাকালে সাবেক বিচারপতি মানিক ভাড়া, গ্যাস ও পানির বিল দেননি। বাড়িভাড়াসহ এসব বিলবাবদ সরকারের পাওনা ১৪ লাখ ১৯ হাজার ২০০ টাকা। ২০১২ সালে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি থাকাকালে ঢাকার গুলশানে সরকারি বাড়িতে ওঠেন মানিক। অবসরের পর ২০১৬ সালে বাড়িটি তার ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাড়িটি সে সময় না ছেড়ে আরও দুই বছর থাকবেন জানিয়ে সরকারি আবাসন পরিদপ্তরকে চিঠি দেন মানিক। আবাসন পরিদপ্তর তখন তাকে ছয় মাস থাকার অনুমতি দিলেও তিনি এক বছরের বেশি সময় ওই বাড়িতে থাকেন। সে সময় বাড়িভাড়া থেকে শুরু করে গ্যাস, পানির বিল কোনো কিছুই পরিশোধ করেননি সাবেক বিচারপতি মানিক। গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বাড়িটি ছাড়ার জন্য বারবার তাগাদা দিলে একপর্যায়ে ২০১৭ সালের মে মাসে বাড়িটির দখল ছাড়েন তিনি।

একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোতে গিয়ে এক নারী উপস্থাপকের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন সাবেক বিচারপতি মানিক / ছবি- সংগৃহীত

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভারতে পালাতে গিয়ে গত ২৩ আগস্ট বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) হাতে আটক হন সাবেক এই বিচারপতি। সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে আটকের পর ৫৪ ধারায় মানিককে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে দায়ের করা ছয়টি হত্যা মামলায় তাকে আসামি দেখিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়।

বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিকের বাংলাদেশের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব রয়েছে। সেখানে মানিকের একাধিক বাড়িও রয়েছে। ২০১২ সালে বিচারপতি থাকা অবস্থায় লন্ডনে তিনি হামলার শিকার হন। ২০১৫ সালে অবসর নেওয়ার পর লন্ডনে ফের হামলার শিকার হন তিনি

এক নজরে বিচারপতি মানিক

শামসুদ্দিন মানিক ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তাকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল করা হয়। পরে তাকে হাইকোর্টের অস্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সেই নিয়োগ স্থায়ী হয়নি।

সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিকের বাংলাদেশের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব রয়েছে / ছবি- সংগৃহীত

 

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসার পরে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিচারপতি হিসেবে পুনর্বহাল হন। ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে পদোন্নতি পান মানিক। এ সময় জ্যেষ্ঠ ২১ জন বিচারককে ডিঙিয়ে তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়।

বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিকের বাংলাদেশের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব রয়েছে। সেখানে মানিকের একাধিক বাড়িও রয়েছে। ২০১২ সালে বিচারপতি থাকা অবস্থায় লন্ডনে তিনি হামলার শিকার হন। ২০১৫ সালে অবসর নেওয়ার পর লন্ডনে ফের হামলার শিকার হন তিনি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন চলাকালে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোতে গিয়ে এক নারী উপস্থাপকের সঙ্গে অশোভন আচরণে অধিক সমালোচিত হন মানিক। যদিও পরে নিজেকে অসুস্থ দাবি করে সেই উপস্থাপিকার কাছে ক্ষমা চান।

আরএম/এমএআর/