গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। যা এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সেখানে একের পর এক ঘটছে ছিনতাই-ডাকাতির মতো ঘটনা। ঘটছে সন্ত্রাসীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও।

এসব ঘটনায় এরই মধ্যে প্রাণ গেছে ১০ জনের। আহত হয়েছেন প্রায় অর্ধশত। স্থানীয়দের মতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর না হওয়ায় অপরাধ কমছে না।

শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত মোহাম্মদপুর এলাকায় বহু অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সম্প্রতি কিছু ঘটনা সবার নজরে এসেছে। যেমন- নেসলে কোম্পানির গাড়ি থেকে ১১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ছিনতাই, অস্ত্রের মুখে নারী শিক্ষার্থীর ব্যাগ কেড়ে নেওয়া, সাদেক খান আড়তের সামনে দুই জনকে কুপিয়ে হত্যা, একতা হাউজিংয়ে ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় নিরাপত্তা কর্মীকে কুপিয়ে খুন, কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্যে একের পর এক হত্যাকাণ্ড, জেনেভা ক্যাম্পের গোলাগুলি ইত্যাদি।

এসব ঘটনায় পুলিশ ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা বা উদাসীনতা পরিষ্কার চোখে পড়ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা প্রশাসনের তীব্র সমালোচনা করছেন। কয়েকদিন আগে তারা বিক্ষোভ মিছিলও করেন।

অবশ্য দুদিন আগে থেকে সেখানে বিশেষ অভিযান শুরু করেছে সেনাবাহিনী ও পুলিশ।

ছিনতাইয়ের জন্য এলাকা ভাগ করে নেয় অপরাধীরা

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, মোহাম্মদপুরে ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো বেশি ঘটছে ৩৩নং ওয়ার্ডে। আর একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে তীব্র ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে কিছু এলাকাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী চাঁদ উদ্যান, সাত মসজিদ হাউজিং, লাউতলা, নবীনগর হাউজিং, ঢাকা উদ্যান, তুরাগ হাউজিং, বসিলা ৪০ ফিট, কাটাসুর, গ্রিন হাউজিং, বসিলা গার্ডেন সিটি, একতা হাউজিং, চাঁন মিয়া হাউজিং, মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেড, মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটি, নবোদয় হাইজিং, বোটঘাট, সাদেক খান রোড, ক্যান্সার গলি, রায়েরবাজার, পুলপাড় বটতলা, শেরে বাংলা রোড এলাকায় সবচেয়ে বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।

সরেজমিনে মোহাম্মদপুর এলাকা ঘুরে ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকার পতনের পর মোহাম্মদপুরে দীর্ঘদিন পুলিশের অনুপস্থিতি ছিল। পুলিশ থানায় দায়িত্ব গ্রহণের পরও সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। থানা পুড়িয়ে দেওয়া, অস্ত্র লুট, বিট অফিস পুড়িয়ে দেওয়া, জনবল সংকটসহ নানা কারণে পুলিশ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আবার পুলিশের অনেক কর্মকর্তা ঢাকার বাইরে থেকে বদলি হয়ে এলেও তারা এলাকার অলিগলি এখনো চিনতে পারেননি।স্থানীয়রা বলছেন, এলাকায় পুলিশের পেট্রোলিং না থাকায় আগে যেসব অপরাধী গোপনে তাদের অপরাধ কার্যক্রম সেরে সটকে পড়ত তারা এখন প্রকাশ্যে ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ ভয়ে তাদের কিছু বলতে পারছে না। আবার ছিনতাইকারীরা সামনে দিয়ে ঘুরলেও পুলিশ তাদের চিনতে পারছে না। এসব অপরাধীদের বিরুদ্ধে হত্যা ছিনতাই চাঁদাবাজিসহ একাধিক মামলা থাকলেও আইনের ফাঁক দিয়ে তারা বারবার বেরিয়ে যায় এবং জেল থেকে বের হয়ে আবার একই কাজ করে।

সক্রিয় ছিনতাইকারীদের ১২টি গ্রুপ

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে মোহাম্মদপুরে ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ১২টি ছিনতাইকারী গ্রুপ সক্রিয় আছে। এর বাইরে কোনো গ্রুপের নিয়মিত সদস্য নন, এমন অর্ধশত কিশোর-যুবক অস্ত্র হাতে ছিনতাইয়ে নেমেছে। যৌথ বাহিনীর অভিযানে তাদের কেউ কেউ ধরা পড়লেও বেশিরভাগ ছিনতাইকারী প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকার পতনের পর মোহাম্মদপুরে সবচেয়ে বেশি অপরাধমূলক কাজ করেছে আনোয়ার গ্রুপ। ‘কব্জিকাটা গ্রুপ’ হিসেবে পরিচিত এই গ্যাংয়ের প্রধান আনোয়ার। যার হাতে কিছুদিন আগে কিশোর গ্যাং লিডার ফাইটার বিল্লাল খুন হন। আনোয়ারের নেতৃত্বে মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই অব্যাহত রেখেছে কয়েকটি গ্রুপ। সেগুলোর মধ্যে ঢাকা উদ্যান এলাকায় হিন্দু হৃদয়, কালিয়া, বুলেট বাবু এবং রায়েরবাজার এলাকায় এলেক্স ইমন, ডাইল্যা হৃদয় গ্রুপ ছিনতাই ও একাধিক হত্যাকাণ্ডে জড়িত। সব গ্রুপের নামে একাধিক হত্যা মামলা রয়েছে। এসব গ্রুপের সদস্যরা বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার হলেও আইনের ফাঁক দিয়ে তারা বেরিয়ে এসেছে।

পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা উদ্যানের একজন স’মিল মালিক বলেন, কমপক্ষে এক হাজার ছিনতাইকারী আছে। সবার হাতে অস্ত্র আছে, ধারালো অস্ত্র। তাই কেউ কিছু বলে না। আমরা এখানে ব্যবসা করি। কিছু বলতে গেলে আমাদের ওপর আক্রমণ হবে, তাই আমরা চুপ থাকি। থানার লুট করা অস্ত্র দিয়ে তারা বিভিন্ন জায়গায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটাচ্ছে। আমরা যদি প্রকাশ্যে কিছু বলতে যাই, তাহলে তারা গ্রেপ্তার হলেও জেল থেকে বেরিয়ে আমাদের আর বাঁচতে দেবে না।

ঢাকা উদ্যান-নবীনগর হাউজিং

মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পশ্চিমে বিশাল আয়তনের এলাকা নবীনগর হাউজিং। ১৬টি অভ্যন্তরীণ সড়ক নিয়ে গড়ে ওঠা এলাকাটি ঘনবসতিপূর্ণ। ১৯৯০ সালে গড়ে ওঠা এ এলাকাকে ছিনতাইকারীদের আঁতুড়ঘর হিসেবে জানেন স্থানীয়রা। এ এলাকার প্রতিটি গলিতেই ছিনতাইকারীদের বসবাস। তারা নিজ এলাকাতেই ছিনতাই করেন।

পাশের ঢাকা উদ্যান ও চন্দ্রিমা মডেল টাউন এলাকার চিত্রও একইরকম। নব্য গড়ে ওঠা এলাকাগুলোতে ঠাঁই নিয়েছেন ছিনতাইকারীদের অনেকে। আবার নবীনগর এলাকা থেকে এসেও ছিনতাই করেন কেউ কেউ। সবশেষ গত শুক্রবার রাত ১০টা ৫০ মিনিটে ছিনতাইকারীদের একটি অস্ত্রধারী দল গণছিনতাই করে ঢাকা উদ্যান এলাকার ৩, ৪ ও ৫নং সড়কে। এসময় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হন বেশ কয়েকজন পথচারী।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই তিন এলাকায় ছিনতাই করে ইউনূস গ্যাং। যাদের নিয়ন্ত্রক কব্জিকাটা গ্রুপের প্রধান আনোয়ার।

মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেড, মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটি

সাতটি সড়ক নিয়ে শিয়া মসজিদের পশ্চিম দিকের এলাকা মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেড। পাশেই ১২টি সড়ক নিয়ে মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটি এলাকা। স্থানীয়দের তথ্যমতে, এই দুই এলাকায় যারা ছিনতাই করেন তারা কেউ স্থানীয় বাসিন্দা নন। আশপাশের এলাকা থেকে এসে এ এলাকায় ছিনতাই করে এক দল তরুণ। তারা কয়েকটি কিশোর গ্যাংয়ের সক্রিয় সদস্য। তবে তাদের সঙ্গে কোনো বড় গ্যাংয়ের সমন্বয় নেই।

কাটাসূর, রায়ের বাজার ও গ্রিন হাউজিং এলাকা

ঘন বসতি ও কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য নির্ভর এলাকা কাটাসুর, রায়ের বাজার ও গ্রিন হাউজিং এলাকা। এসব এলাকায় বসবাসকারীর সংখ্যাও অনেক। তবে স্থানীয়দের ছায়াতলেই ছিনতাইকারী চক্র তাদের বলয় তৈরি করেছে বলে জানা গেছে।

স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, এই তিন এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সবচেয়ে বড় গ্রুপ সাজ্জাদ গ্রুপ। এই গ্রুপের সদস্যদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাংশের সোর্স হিসেবে কাজ করার সুবাদে এই গ্রুপ প্রায়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে ছিনতাইয়ে সক্রিয় হয়েছেন এই গ্রুপের সদস্যরা।

গ্রিন হাউজিং এলাকা স্থানীয়ভাবে ‘গিরিঙ্গি হাউজিং’ নামে পরিচিত। নামের মতোই সার্বক্ষণিক থমথমে অবস্থা বিরাজ করে এ এলাকায়।

সাত মসজিদ হাউজিং, চাঁদ উদ্যান, লাউতলা, ৪০ ফিট এলাকা

এলাকার মূল ফটকে লেখা– ‘সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত এলাকা’। অথচ স্থানীয়রা বলছেন, রাজধানীর বেশিরভাগ ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীর বসবাস এই সাত মসজিদ হাউজিং ও চাঁদ উদ্যান এলাকায়। ছিনতাই এই এলাকার নিয়মিত ঘটনা। বিগত সরকারের সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ছায়াতলে থেকে ছিনতাই করে আসছিল কয়েকটি চক্র। সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগপন্থি অনেক কিশোর গ্যাং এখন পলাতক। তাদের জায়গা দখল করেছে রাসেল গ্রুপ। লাউতলা, বসিলা ৪০ ফিট এলাকায়ও রাসেলের নিয়ন্ত্রণে চলে ছিনতাই-ডাকাতি। তাদের নেতৃত্বে পথচারীদের কাছ থেকে মোবাইল, টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি দোকানপাটেও হামলা হচ্ছে নিয়মিত।

নবোদয় হাউজিং এলাকা

সন্ত্রাসী এলাকা হিসেবে আগে থেকেই পরিচিত মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিং এলাকা। এলাকার চারটি ব্লকের মধ্যে নবোদয় বাজার এলাকা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উঠে এসেছে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে। আহাম্মদ গ্রুপের নেতৃত্বে চলছে এ এলাকার ছিনতাই। আহাম্মদ গ্রুপ সরাসরি আনোয়ার গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে চলে।

বিহারীদের দৌরাত্ম্য

মোহাম্মদপুর এলাকার বাড়তি ঝামেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে জেনেভা ক্যাম্পের উর্দুভাষীরা। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানা লুট করে উর্দুভাষী মাদক কারবারিরা। সেই অস্ত্র দিয়েই প্রতিনিয়ত চলছে গোলাগুলি।

একটা বড় সমস্যা হলো, নতুন আসা পুলিশ কর্মকর্তাদের তেমন শক্ত কোনো সোর্স নেই। ফলে চোখের সামনে অপরাধীরা ঘুরতে থাকলেও তারা চিনতে পারছেন না।

জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবারি ভুঁইয়া সোহেল গ্রুপ এবং পারমনু ও চুয়া সেলিম গ্রুপের মধ্যে গুলি বিনিময়ের ঘটনায় এখন পর্যন্ত চার জন নিহত হয়েছেন। গত শনিবার (২৬ অক্টোবর) সন্ধ্যায়ও শিশুসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হন। এর বাইরে হুমায়ুন রোড এলাকায় ছিনতাই করেন জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের একাংশ।

যে কারণে ক্রাইম হাব মোহাম্মদপুর

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর মোহাম্মদপুর ক্রাইম হাব হওয়ার অন্যতম কারণ হলো জেনেভা ক্যাম্প। বিশেষ করে ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র চলে যায় জেনেভা ক্যাম্প কেন্দ্রিক অপরাধীদের কাছে। অস্ত্র পাওয়ার পর তারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে চুরি, ছিনতাই ও খুনের মতো নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে দিন দিন মোহাম্মদপুর এলাকায় নানা অপরাধমূলক কার্যক্রম বেড়ে চলেছে।

আরও জানা যায়, মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায় রাজধানীর অন্য সব এলাকার তুলনায় আবাসন কিছুটা সস্তা। ফলে নানা বয়সের অপরাধীরা সেখানে সহজে বসতি গড়ে তুলে অপরাধমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

যে কারণে ব্যর্থ হচ্ছে পুলিশ

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যেসব পুলিশ সদস্যদের নির্দেশে গুলি চালঅনো হয় এবং যারা গুলি চালান তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। অনেক পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার ও চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ঢাকার ৫০ থানাসহ ডিএমপির বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত ১৬ হাজারের বেশি পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। তাদের জায়গায় দেশের বিভিন্ন জেলা ও রেঞ্জ থেকে পুলিশ সদস্যদের ঢাকায় আনা হয়েছে বদলি করে। যাদের অধিকাংশের আগে ডিএমপিতে দায়িত্ব পালন করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। মাঠ পর্যায়ের এসব পুলিশ সদস্য রাজধানীর অলিগলি ও রাস্তাঘাট চেনেন না। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে রাজধানীর মাঠ পর্যায়ের পুলিশিংয়ে।

একটা বড় সমস্যা হলো, নতুন আসা পুলিশ কর্মকর্তাদের তেমন শক্ত কোনো সোর্স নেই। ফলে চোখের সামনে অপরাধীরা ঘুরতে থাকলেও তারা চিনতে পারছেন না। রাজধানীর যেসব এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় সেসব এলাকার মধ্যে মোহাম্মদপুর অন্যতম। সোর্স না থাকার কারণে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিষয়ে তেমন তথ্য নেই মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের কাছে।সরকার পতনের পর থানায় থানায় হামলা ও ভাঙচুরের কারণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পুলিশের যোগাযোগ ব্যবস্থাও। গাড়ির ঘাটতি থাকায় থানা পুলিশের টহল কমে গেছে। দিনের বেলায় পুলিশের টহল কিছু এলাকায় থাকলেও রাতে পুলিশের টহল নেই বললেই চলে। এ ছাড়া সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে বিট পুলিশিং কার্যক্রম। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাজধানীর কোনো এলাকায় আর বিট পুলিশিং দেখা যায়নি।

ছিনতাই-রাহাজানির ঘটনা প্রতিরোধে নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও জোনের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মোহাম্মদ জিয়া। শনিবার সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুর এলাকায় ছাত্র-জনতা ছিনতাই রোধে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে আপত্তি তুলে থানায় উপস্থিত হন। এসময় গণমাধ্যমকর্মীরাও উপস্থিত ছিলেন।

এডিসি ছাত্র-জনতার প্রশ্নের মুখে বলেন, ‘আমার থানায় জনবল কম আছে, এটা সবসময় থাকে, এখন হয়ত আরও একটু কম আছে, আমার গাড়ি কম আছে। এগুলো কোনো এক্সকিউজ হতে পারে না। আমি যখন এই পোশাকটা (পুলিশের পোশাক) পরে এসেছি, আমার দায়িত্ব হচ্ছে আপনাকে নিরাপত্তা দেওয়া। হ্যাঁ, আমি স্বীকার করছি, আমি সেক্ষেত্রে ব্যর্থ।’

এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান বলেন, প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় অর্ধেক জনবল নিয়ে কাজ করছে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। তবে পুলিশ জনতার সঙ্গে মিলে কাজ করতে চায়। এ বিষয়ে ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে পরামর্শ চেয়েছেন মোহাম্মদপুর থানার এই কর্মকর্তা।

তিনি আরও বলেন, ‘আমি এসে এই এলাকা খুব খারাপ অবস্থায় পেয়েছি। রায়েরবাজার এলাকার ছিনতাই রোধে আমরা কাজ করেছি, অনেকটা কমেছে। অন্য এলাকায় আমাদের টহল বাড়িয়েছি। সীমিত জনবল দিয়ে চেষ্টা করছি।’

ওসি আলী ইফতেখার হাসান জানান, অপরাধীদের ধরতে অনেক চেষ্টার পরও ব্যর্থ হচ্ছে পুলিশ। স্থানীয়দের সহযোগিতা না পাওয়ায় অপরাধীদের বাসা কোথায় তা শনাক্ত করা কঠিন হচ্ছে।

পুলিশের মনোবল ভাঙার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা, বলছেন বিশেষজ্ঞরা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ের পরিস্থিতিকে কাজে লাগাচ্ছে অপরাধীরা। পুলিশের মনোবল ভেঙে যাওয়াসহ পুলিশি কার্যক্রমে ধীরগতি আসার কারণে এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অপরাধীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তাদের থামাতে হলে এখনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ে এবং রাজনৈতিকভাবে সমন্বিত কার্যক্রম প্রয়োজন।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোহাম্মদপুর আগে থেকেই একটি অপরাধপ্রবণ এলাকা। পাশাপাশি নতুন কিছু বাস্তবতা যুক্ত হওয়ার কারণে বলা যায় মোহাম্মদপুর এলাকার পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে নতুন বাস্তবতা কী। এই নতুন বাস্তবতাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ৫ আগস্টের পর অনেক পেশাদার অপরাধী জামিনে মুক্ত হয়েছেন। তাদের ঢালাওভাবে জামিন দেওয়া হয়েছে, তাদের অনেকেই কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার মামলায় গ্রেপ্তার ছিলেন না। এসব অপরাধী জামিনে বের হয়ে পুনরায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের পুরোনো নেটওয়ার্ক আবারও সক্রিয় করে তুলছে। তারা নতুন করে অপরাধের পরিকল্পনা করছে।

মোহাম্মদপুরে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, নিরাপত্তা চেয়ে থানা ঘেরাও

‘এ ছাড়া জেনেভা ক্যাম্প কেন্দ্রিক মাদক ব্যবসা এখন কারা নিয়ন্ত্রণ করবে সেটা নিয়ে এক ধরনের সংঘাত-সহিংসতা চলছে। এটা করতে গিয়ে জেনেভা ক্যাম্প কেন্দ্রিক অনেকে আহত ও নিহত হয়েছেন।’

এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেন, মোহাম্মদপুরে আগে থেকেই চুরি, ছিনতাই ও কিশোর গ্যাংয়ের মতো অপরাধ বেশি ছিল। এখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যেসব ব্যবস্থা ছিল কমিউনিটি পর্যায়ে সেগুলো ৫ আগস্টের পর ভেঙে পড়েছে। এর মধ্যে জুলাই-আগস্টে যে বিপ্লব হয়েছিল সেই বিপ্লবে বিপরীত ভূমিকার কারণে পুলিশের মনোবল ভেঙেছে এবং তাদের নৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে কিন্তু পুলিশের নৈতিকতা ও মনোবল শক্ত অবস্থানে না থাকলে আইন প্রয়োগ করাটা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া অপরাধ ঘটলে পুলিশের যত দ্রুত রেসপন্স করার কথা ছিল সেরকমটা তারা করছেন না। তারা কিছুটা যাচাই-বাছাই করে ধীরগতিতে এগোচ্ছেন। পুলিশের এ অবস্থানের সুযোগটা অপরাধীরা কাজে লাগাচ্ছে।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণে আইন প্রয়োগ করতে হবে, যৌথ বাহিনীর অভিযান পরিচালনা করতে হবে। এ ছাড়া স্থানীয় লোকজন এবং রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে বলে জানান ড. তৌহিদুল হক।

নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

মোহাম্মদপুরে একের পর এক অপরাধমূলক ঘটনার পর এবং এসব ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসার পর ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। এরপরই নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে একের পর এক অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া ওই এলাকায় বসানো হয়েছে সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প।

গত শনিবার রাতে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে যৌথ বাহিনী। ঢাকা উদ্যান, চাঁদ উদ্যান ও নবোদয় হাউজিং এলাকায় চালানো যৌথ অভিযানে ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ ও কিশোর গ্যাংয়ে জড়িত থাকার অভিযোগে ৪৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এ বিষয়ে ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজধানীতে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যেসব পুলিশ সদস্য কাজ করছেন তারা সবাই প্রশিক্ষিত। অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও দমন করতে কী করতে হয় তাদের সেই জ্ঞান ও দক্ষতা রয়েছে। এমনিতেই মোহাম্মদপুর এলাকাটা একটু অপরাধপ্রবণ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের জনবল ও সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে মোহাম্মদপুর এলাকার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনতে আমরা কাজ করছি। তবে পুলিশের জনবল সংকট রয়েছে, আমরা সেখানে আরও লোকজন পাঠাচ্ছি। পরিস্থিতির কীভাবে উন্নতি করা যায় সেই বিষয়ে আমরা কাজ করছি।

এসএএ/এমএসি/এসএসএইচ