যানজট নিরসনে ঢাকার সড়কে বসবে দেশীয় প্রযুক্তির সিগন্যাল বাতি/ ঢাকা পোস্ট

অপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনা, মেগা প্রকল্পগুলোতে কালক্ষেপণ, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো, রিকশার অবাধ বিচরণ, অনিয়ন্ত্রিত গাড়ি পার্কিংসহ বিভিন্ন কারণে ঢাকা এখন বিশ্বের অন্যতম বিশৃঙ্খল ও যানজটের নগরী। বসবাসের প্রায় অযোগ্য এই শহরে দিনে ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে নাগরিকদের।

এ নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদরা একের পর এক নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। বাজেট পাশ করে প্রকল্প বাস্তবায়নও করেছেন। কিন্তু অর্থের অপচয় ছাড়া সেসব প্রকল্পে কাজের কাজ কিছু হয়নি। মাঝেমধ্যে কিছু লোক দেখানো প্রকল্প অল্পসময় স্থায়ী হলেও কোনোটাই শেষ পর্যন্ত টেকেনি। 

এবার এই মেগা শহরের যানজট নিরসনে দেশীয় প্রযুক্তি নিয়ে এগিয়ে এসেছেন বাংলাদেশ প্রকোশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তারা এমন একটি সিগন্যাল সিস্টেম উদ্ভাবন করেছেন যেটি ঢাকার মতো জনবহুল শহরের জন্য বেশি প্রযোজ্য। এই পদ্ধতিতে অটোমেটিকের পাশাপাশি ম্যানুয়াল অপশনও রাখা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকার ২২টি মোড়ে দেশীয় প্রযুক্তির এই সিগন্যাল সিস্টেম ও বাতি লাগানোর পরিকল্পনার কথা ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন ও অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান। ডিসেম্বরের শুরুতে প্রাথমিকভাবে চারটি মোড়ে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হবে এই পাইলট প্রকল্প।

এই প্রকল্প চালু হলে ‘অকাজে' ব্যয় হওয়া কোটি কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী— প্রাথমিক ধাপে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার ও ফার্মগেট মোড়ে লাগানো হবে এই সিগন্যাল বাতি

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বুয়েটের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন ও অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামানের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে যানজট নিরসনের জন্য পরিকল্পনা নেওয়া হয়। বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা ঢাকার যানজট নিরসনে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কিছু পরামর্শ তুলে ধরেন।

জানা যায়, রাজধানী ঢাকার সড়কের সংযোগগুলোতে মোট ট্রাফিক সিগন্যাল আছে ১১০টি। তবে এগুলোর কোনোটিই কাজ করছে না। ঢাকা শহরে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য গত ১৯ বছরে নানা উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ ও সিটি করপোরেশন। এসব উদ্যোগের প্রথম ধাপে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭০ কোটি টাকা। এরপর বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০১২-২৩ অর্থবছরে ‘ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট’ (কেস) প্রকল্পের আওতায় ১১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৯টি মোড়ে বসানো হয় সিগন্যাল বাতি। ২০১৬ সালে ঢাকার চারটি মোড়ে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিস্টেম বসানোর আরেকটি উদ্যোগ নেয় ডিটিসিএ। শুরুতে ব্যয় ছিল ৩৭ কোটি টাকা, পরে বেড়ে হয় ৫২ কোটি টাকা। কিন্তু কোনো কিছুই কাজে আসেনি। ফলে নগরীর সব জায়গায় ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা ম্যানুয়ালি যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছেন।

ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত কেন?

পাইলট প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, অতীতে ইউরোপ কিংবা অন্যান্য দেশের উন্নত প্রযুক্তি বাংলাদেশে ব্যবহার করা হয়েছে। দেশের রাস্তা, ট্রাফিক সিস্টেম ও ব্যবহারকারী কিছুই উন্নত দেশের সঙ্গে মিল নেই। যার ফলে সেসব উন্নত প্রযুক্তি আমাদের দেশের সঙ্গে মানানসই হয়নি।

তিনি আরও বলেন, উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো সহায়ক বা বিকল্প (ব্যাকআপ সাপোর্ট) ব্যবস্থা থাকে না। অথচ ট্রাফিক সিগন্যাল ২৪ ঘণ্টাই প্রয়োজন হয়। তাই এক ঘণ্টার জন্যও ওই ব্যবস্থা ব্যাহত হলে পুরো ব্যবস্থাপনাই অকার্যকর হয়ে যায়। এখন সিস্টেমে নিয়ন্ত্রণ ও ব্যাকআপ সাপোর্ট রাখতে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, শুধু এই সিগন্যালের মাধ্যমেই জ্যাম কমে যাবে এমনটা নয়। আমাদের আরও পাঁচটি পাইলট প্রজেক্ট উপদেষ্টার কাছে পাঠিয়েছি। সবগুলো ধীরে ধীরে চালু করতে পারলে ঢাকার যানজট অনেকটাই কমে যাবে। তবে এই সিগন্যাল ব্যবহারের ফলে ব্যবহারকারীদের মধ্যে অনেক পরিবর্তন আসবে।

ঢাকার ২২টি মোড়ে দেশীয় প্রযুক্তির সিগন্যাল সিস্টেম ও বাতি লাগানোর পরিকল্পনার কথা ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন ও অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান। ডিসেম্বরের শুরুতে প্রাথমিকভাবে চারটি মোড়ে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হবে এই পাইলট প্রকল্প

কোথায় কোথায় বসবে নতুন সিগন্যাল বাতি?

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী— প্রাথমিক ধাপে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার ও ফার্মগেট মোড়ে লাগানো হবে এই সিগন্যাল বাতি।

পরবর্তীতে শিক্ষা ভবন মোড়, কদম ফোয়ারা ও মৎস্য ভবন মোড়, শাহবাগ মোড়, কাকরাইল মসজিদ মোড় হয়ে মিন্টো রোডের মোড়ে বসবে। পরে বিজয় সরণি, জাহাঙ্গীর গেট, মহাখালী, খিলক্ষেত, বিমানবন্দর হয়ে আবদুল্লাহপুর মোড় পর্যন্ত বসানো হবে।

ড. হাদিউজ্জামান বলেন, পাইলট প্রকল্পের আওতায় মোট ২২ জায়গায় এই সিগন্যাল বাতি লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে। তবে প্রথম ধাপে একসঙ্গে সব জায়গায় বসানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আপাতত টেস্টিংয়ের জন্য আমরা চারটি মোড়ে লাগাব।

তিনি আরও বলেন, আমাদের ল্যাব টেস্ট হয়েছে। তবুও সেসব স্থানে এগুলোর কার্যকারিতা ও আপগ্রেডেশনের বিষয় পর্যবেক্ষণ করে বাকি মোড়গুলোতে পরে লাগানো হবে।

কবে চালু হবে এই প্রকল্প?

সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ঢাকার চার স্থানে এই সিগন্যাল বাতি লাগানো সম্ভব বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক হাদিউজ্জামান।

তিনি বলেন, আমাদের নিজস্ব প্রযুক্তিতে অত্যন্ত কম খরচে আমরা সবকিছু তৈরি করেছি। সেগুলোর ল্যাব টেস্টও সম্পন্ন হয়েছে। সব ঠিক থাকলে এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে এটা চালু করা সম্ভব।

যেভাবে কাজ করবে দেশি ট্রাফিক সিগন্যাল সিস্টেম

অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, এই সিগন্যাল বাতি দুইভাবে কাজ করবে। এটি ‘সেমি অটোমেটেড সিগন্যাল এইড’। একটা বাটনের (বোতাম) মাধ্যমে এই ব্যবস্থাকে ম্যানুয়াল আবার অটোমেটেড (স্বয়ংক্রিয়) করা যাবে। কম যানবাহন থাকলে নির্ধারিত সময়ের জন্য ‘অটোমেটেড মুডে’ চলবে। বেশি থাকলে ‘ম্যানুয়ালি’ সময় পরিবর্তন করে নেওয়া যাবে।

এ ব্যবস্থা সনাতন (ম্যানুয়াল) পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে। অর্থাৎ সংকেত বাতি (লাল, সবুজ ও হলুদ) জ্বলা-নেভার বিষয় সনাতন পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। পরে ধাপে ধাপে এ পদ্ধতিকে স্বয়ংক্রিয়তার (অটোমেশন) দিকে উন্নীত করা হবে।

পুলিশকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ট্রাফিক পুলিশ যে ধরনের কাজ করে, সেই ধরনের সুবিধা এতে থাকবে। তাদের আর হাত দেখাতে হবে না। সিগন্যালের মাধ্যমে ট্রাফিক বাতি দেখানো হবে। পুলিশ চাইলে যেকোনো সময় যেকোনো সিগন্যালের সময় নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। সেখানে কিছু সতর্কতার ব্যবস্থা থাকবে। যেমন- কোনো সিগন্যালে বেশি সময় লাগলে সেটিও জানা যাবে। পথচারী পারাপারের জন্যও আলাদা সিগন্যাল থাকবে। এটা যেকোনো সময় আপডেট করা যাবে।

বুয়েটের তৈরি সিস্টেমে খরচ কত?

অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, ঢাকার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে আগে যেসব পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করার ফলে খরচ ছিল অনেক বেশি। সেগুলো চালানোর জন্য লোকবলের অভাব, উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় সব বাজেট জলে গেছে। আবার এগুলো নষ্ট হলে পুনরায় আমদানি করতে হতো। সেটাও অনেক সময়সাপেক্ষ বিষয়। অনেক সময় দেখা যায় এক বছর সময় লাগিয়ে নির্দিষ্ট যন্ত্রাংশ আমদানি করা হলেও পূর্বের যন্ত্রাংশগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে পুরো সিস্টেমই অচল হয়ে পড়ে। তবে বর্তমান ব্যবস্থাটি দেশীয় প্রযুক্তিতে বুয়েটেই তৈরি করা হবে। ফলে এর রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের কাজও এখান থেকে দেখা হবে। 

তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে পাইলট প্রকল্পের জন্য প্রতিটি ট্রাফিক সিগন্যাল তৈরি ও বসানোর জন্য সাড়ে ১০ লাখ টাকা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসে দেড় লাখ টাকা চাওয়া হয়েছিল। তখন আমাদের প্রপোজাল পূর্ণাঙ্গ ছিল না। আমাদের কাছে আনুমানিক হিসাব জানতে চাওয়া হয়েছিল বলে আমরা একটা ধারণা দিয়েছিলাম।

তিনি আরও বলেন, সিটি করপোরেশন মূলত বাজেট অ্যারেঞ্জড করবে আর সব টেকনিক্যাল সহায়তা আমরা প্রদান করছি। সামনের সপ্তাহে আমরা সার্বিক খরচের একটা হিসাব করে কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করব। অ্যাগ্রিমেন্টে পৌঁছাতে পারলে আমরা ফাইনাল বাজেটটা বুঝতে পারব।

হাদিউজ্জামান বলেন, এই খাতে এতদিনে ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বুয়েট থেকে তৈরি এই ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা খুবই স্বল্প খরচে সড়কের যানজটের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ সমস্যা সমাধান করতে পারবে। বুয়েটের ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং শাখা থেকে এটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

নিতে হবে না প্রশিক্ষণ

নতুন এই প্রযুক্তি পরিচালনায় ট্রাফিক পুলিশকে কোনো ট্রেনিং নিতে হবে না বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক হাদিউজ্জামান।

তিনি বলেন, কোনো ট্রাফিক পুলিশকে এটার জন্য ট্রেনিং নিতে হবে না। সিগন্যালগুলোতে একজন পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি বুয়েটের একজনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। ফলে একজন আরেকজন থেকে শিখে নিতে পারবে। পরবর্তীতে বুয়েটের কর্মীকে সরানো হলেও সেই পুলিশ কর্মকর্তা নিজেই সব পরিচালনা করতে পারবেন। তবুও আমরা বেশি প্রয়োজন হলে প্রশিক্ষণ দেব।

এ পদ্ধতিটি অত্যন্ত সহজ হওয়ায় যে কেউ দ্রুত বুঝতে পারবে এবং পরিচালনা করতে পারবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

কেএইচ/এমজে