১২ বছর আগে লাক মিয়ার তেমন কোনো সম্পদ ছিল না। এমনকি নিজের নামে আয়কর ফাইলই খুলেছেন ২০১২ সালে। তবে গত এক যুগে তিনি গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় তার নামে রয়েছে ৪৫০ বিঘা জমি। ঢাকায় আছে ১১টি বহুতল বাড়ি। ব্যাংক হিসাবে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা লেনদেনের প্রমাণও পাওয়া গেছে। 

লাক মিয়া এত সম্পদ গড়েছেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার পর। গত ১০ বছর নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজার উপজেলার ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকার সময় তিনি যেন ‘আলাদিনের চেরাগ’ হাতে পান।   

নিজের আয়কর নথিতে স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে ১৪ কোটি ৫১ লাখ টাকার সম্পদের হিসাব দিয়েছেন তিনি। তবে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে থলের বিড়াল। মিলেছে অবৈধ হাজার হাজার কোটি টাকা ও সম্পদের সন্ধান।

সম্পদের অহমিকায় দুর্নীতি দমন কমিশনকেও (দুদক) তিনি পাত্তা দেন না। গত ২৭ আগস্ট, ২ সেপ্টেম্বর ও ২২ সেপ্টেম্বর তিন দফায় তাকে হাজির হতে বললেও হাজির হননি। এমনকি দুদক উপ-পরিচালক মো. সোহানুর রহমান ও সহকারী পরিচালক আশিকুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত অনুসন্ধান টিম পুলিশের থানা বা ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে তলব করে চিঠি দিলেও যোগযোগ করেননি লাক মিয়া। তার অফিসিয়াল ফোন সচল থাকলেও কেউ কল রিসিভ করেনি। যার প্রমাণ পাওয়া যায় ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানেও। কয়েক দফায় তার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তার জবাব মেলেনি।

দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা (মহাপরিচালক) ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের একজন চেয়ারম্যান কীভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন সেটাই অবাক হওয়ার বিষয়। আমরা মনে করছি তার অবৈধ ব্যবসা রয়েছে। এছাড়া ক্ষমতাসীন এক এমপির ক্যাশিয়ার হিসেবে তার কাজ করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। যেহেতু তিনি দুদককে কোনো সহযোগিতা করছেন না, তাই আইন অনুযায়ী এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি বলেন, লাক মিয়ার পুরো পরিবার যেন দেশ ছেড়ে যেতে না পারেন সেজন্য দেশের বন্দরগুলোতে দুদক চিঠি দিয়েছে। এছাড়া তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক ও ফ্রিজ করার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।

সূত্রে জানা গেছে, মো. লাক মিয়া, তার স্ত্রী মাহমুদা বেগম, মেয়ে মিনজু আক্তার ও হাফসা আক্তারকে গত ১৪ অক্টোবর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।

লাক মিয়ার যত সম্পদ

অনুসন্ধানে ইউপি চেয়ারম্যান মো. লাক মিয়া ও তার পরিবারের নামে-বেনামে প্রায় ৪৫০ বিঘা সম্পদের সন্ধান পেয়েছে দুদক। তার স্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে- মারুয়াদী মৌজায় ৪৫৭ শতাংশ, মুড়ালদী মৌজায় ৪৮৫ শতাংশ, লস্করদীতে ৬০২ শতাংশ, গুলপান্দীতে ১২২ শতাংশ, যাত্রাবাড়ীতে ৫২২ শতাংশ, দিঘলদীতে ৩১০ শতাংশ, উজান গোবিন্দীতে ১৮৫৪ শতাংশ, ফাউসায় ১৩৫০ শতাংশ, বড় মনোহরদীতে ১২২৮ শতাংশ, রিষেরচরে ৩২৭ শতাংশ, বিনাইরচরে ৭০৫০ শতাংশ ও ছোট মনোহরদী মৌজায় ২৪ শতাংশসহ মোট ৯ হাজার ১৬৯ শতাংশ বা ২৭৮ বিঘা জমি।

এছাড়া লাক মিয়া ও তার স্ত্রী মাহমুদা বেগমের নামে নারায়ণগঞ্জের কামরাঙ্গীরচর, আড়াইহাজার ও ঝাইগাড়া মৌজায় প্রায় ৫৫ বিঘার জমির দলিল পাওয়া গেছে।  

লাক মিয়া ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানার গোলাকান্দাইল মৌজায় ৩৩৮০ নং দাগে ৫৫ শতাংশ জমি কিনেছেন। ২০২৩ সালের ৫ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার বাঘবের মৌজায় ৭৮ শতাংশ জমি, বাঘবের মৌজায় ৯৩ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৫২ শতাংশ এবং রূপগঞ্জ থানার বাঘবের ও গুতিয়াব মৌজায় ৬২ শতাংশ নাল জমি কিনেছেন।

গত ১০ বছরে লাক মিয়ার নামে শতাধিক ব্যাংক হিসাব খোলার তথ্য পাওয়া গেছে। যেখানে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য মিলেছে। যদিও দুদকের অনুসন্ধান শুরুর পর ব্যাংকের অধিকাংশ টাকা উত্তোলন করা হয়ে গেছে বলে জানা গেছে

দুদকে অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, লাক মিয়া ২০২১-২৪ সাল পর্যন্ত মাত্র তিন বছরে ঢাকায় ১১টি বাড়ি কিনেছেন। যার মধ্যে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এইচ ব্লকে পাঁচ কাঠায় ৯তলা বাড়ি, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এইচ ব্লকের ২ নম্বর রোডের ২৪ নম্বর বাড়ি এবং একই এলাকায় ডি ব্লকে ১১ নম্বর রোডের ৮ নম্বর বাড়ি তার কেনা। এছাড়া পিংক সিটির বি ব্লকে ডুপ্লেক্স বাড়ি, মতিঝিলের আরামবাগে কন্টিনেন্টাল কুরিয়ার সার্ভিসের ভবন, বাড্ডার টেকপাড়ায় ১০ কাঠা জায়গায় টিনশেড ঘর, পশ্চিম রামপুরায় ৮ তলা বাড়ি, আফতাবনগরে এল ব্লকের ৮ নং রোডে ৫ কাঠা প্লটে বাড়ি, আফতাবনগরের পাসপোর্ট অফিসের পাশে ১০ কাঠা জমির ওপর ৩৬টি ফ্ল্যাটসহ ১০তলা ভবন, মধ্য বাড্ডায় ৫ কাঠা জায়গায় ৬তলা বাড়ি ও পশ্চিম নাখালপাড়ায় ৬তলা একটি বাড়ি করেছেন।

এছাড়া মিরপুরের রূপনগরে ১৫ কাঠার ২টি প্লট, বাড্ডায় কাদেরিয়া হাউজিংয়ের পাশে ৩৫ কাঠার দুটি প্লট, পশ্চিম ধানমন্ডির বসিলায় ২০ কাঠার ২টি প্লট ও রাজধানীর পূর্বাচলে কমপক্ষে ১০টি প্লট ৬০-৭০ কোটি টাকায় কিনেছেন। আড়াইহাজারের ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়নে গত ৩ বছরে ১৫০ বিঘা জমি কিনেছেন তিনি।

ব্যাংক হিসাবে ২০ হাজার কোটি টাকা লেনদেন

গত ১০ বছরে লাক মিয়ার নামে শতাধিক ব্যাংক হিসাব খোলার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। যেখানে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য মিলেছে। যদিও দুদকের অনুসন্ধান শুরুর পর ব্যাংকের অধিকাংশ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সাড়ে ১১ কোটি টাকার স্থায়ী আমানতের প্রমাণ মিলেছে, যা ফ্রিজ করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ রয়েছে- এক্সিম ব্যাংকের পল্টন শাখায়। সেখানে নিজের নামে ৫ কোটি টাকা ডাবল বেনিফিট স্কিম, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের বেগম রোকেয়া সরণি শাখায় স্ত্রীর নামে দেড় কোটি টাকার ডাবল বেনিফিট স্কিম, ডাক বিভাগে স্ত্রীর নামে ৪৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, নিজ নামে ব্যাংকে রক্ষিত ৪৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র রয়েছে। এছাড়া ব্যাংক এশিয়ার কাজীপাড়া শাখায় ২ কোটি টাকা ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামিক ব্যাংকের পল্টন শাখায় স্ত্রীর নামে দেড় কোটি টাকা ডাবল বেনিফিট স্কিম ডিপোজিট রয়েছে।

জানা গেছে, ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে লাক মিয়া আয়কর নথিতে ১৪ কোটি ৫১ লাখ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব দিয়েছেন। যার মধ্যে নগদ বা ব্যাংক হিসাবে জমা হিসাবে দেখিয়েছেন ২ কোটি ২৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। আয়কর নথিতে আয়ের বড় অংশ তার মালিকানাধীন ভাই ভাই স্পিনিং মিলসের ৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা এবং বিভিন্ন কৃষি ও অকৃষি জমিতে বিনিয়োগ প্রায় ৫০ লাখ টাকা দেখিয়েছেন। 

লাক মিয়াকে নিয়ে স্থানীয় এক বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক দিন ধরে ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি নিজের প্রভাব খাটিয়ে সাধারণ মানুষের জমি ও বসতভিটা দখল করে আসছেন। কাউকে নামমাত্র মূল্য পরিশোধ করেন আবার কাউকে কোনো টাকা না দিয়েই জমি নিজের নামে করে নেন। জমি দখলে এলাকায় গড়ে তুলেছেন নিজস্ব পেটোয়া বাহিনী। তিনি নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবুর ঘনিষ্ঠদের একজন।

আরএম/এমএসএ