দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি মৃত্যুর তালিকাও দীর্ঘ হচ্ছে। চলমান ডেঙ্গুর প্রকোপ ডিসেম্বরের আগে কমছে না বলেও জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সেপ্টেম্বরে আগের মাসের (আগস্ট) চেয়ে তিনগুণ বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন, এমনকি চলতি মাসের দুই সপ্তাহেই প্রায় ১৩ হাজার রোগী আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও তার পরিবারগুলোতে প্লাটিলেট নিয়ে এক ধরনের ভয়-ভীতি ও সংশয় তৈরি হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে প্লাটিলেটের ভূমিকা প্রধান নয়। তাই অযথা প্লাটিলেট নিয়ে ভয় না পেয়ে অন্য বিষয়গুলোর দিকে নজর রাখা জরুরি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর ব্লাড ব্যাংক ও স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে রোগীর জন্য রক্ত ও প্লাটিলেটের চাহিদা বেড়েছে দ্বিগুণ। ডেঙ্গুর বাড়তি প্রকোপে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান।

ডেঙ্গু রোগীদের জন্য প্লাটিলেট দুভাবে সংগ্রহ হয়। প্রথমত— চারজন ব্যক্তি থেকে এক ব্যাগ প্লাটিলেট সংগ্রহ করা। দ্বিতীয়ত— শক্ত-সামর্থ্য মানুষ হলে এবং প্লাটিলেট বেশি থাকলে এক ব্যক্তির কাছ থেকেও এক ব্যাগ প্লাটিলেট নেওয়া যায়

রিদম ব্লাড ব্যাংকের পরিচালক ডা. মামুন বলেন, ‘এখন প্রতিদিন আমাদের প্লাটিলেট যাচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ ব্যাগ। একমাস আগেও যা ছিল ১০ থেকে ১৫ ব্যাগ। ডেঙ্গু তো আছেই আবার আসছে শীত। এ সময়ে মানুষের অপারেশন একটু বেশি হবে। সেই কারণে রক্তের চাহিদা বেড়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগীদের জন্য প্লাটিলেট সংগ্রহ দুই ভাবে হয়। প্রথমত, চারজন ব্যক্তি থেকে এক ব্যাগ প্লাটিলেট সংগ্রহ করা হয়। দ্বিতীয়ত, শক্ত-সামর্থ্য মানুষ হলে এবং প্লাটিলেট বেশি থাকলে এক ব্যক্তির কাছ থেকেও এক ব্যাগ প্লাটিলেট নেওয়া যায়। এজন্য প্লাটিলেট সংগ্রহ করতে বাছাই করা বিশেষ ডোনার লাগে। সবকিছু মিলিয়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেক বেড়েছে। আমি মনে করি, অবস্থা ভয়াবহ।’

ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার কারণে মানুষের রক্তনালী আক্রান্ত হয়, রক্তনালীতে যেসব ছোট ছিদ্র থাকে সেগুলো বড় হয়ে যায় / ঢাকা পোস্ট

প্লাটিলেট নয়, রোগীর চিকিৎসা নির্ভর করে এইচসিটি’র ওপর

চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার কারণে মানুষের রক্তনালী আক্রান্ত হয়। রক্তনালীতে যেসব ছোট ছিদ্র থাকে সেগুলো বড় হয়ে যায়। এমনকি তা দিয়ে রক্তের জলীয় উপাদান বের হয়ে আসে। ফলে রক্তচাপ কমতে থাকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে প্লাটিলেটের ভূমিকা প্রধান নয়, রোগীর চিকিৎসা নির্ভর করে এইচসিটি নামের লোহিত কণিকার ওপর

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও বিশিষ্ট ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিশেষজ্ঞ ডা. আশরাফুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ডেঙ্গু জ্বরে যে সমস্যাটা মূলত হয় তা হলো প্লাজমা লিকেজ। এর ফলে রক্তনালী থেকে রক্তের জলীয় অংশ বের হয়ে যায়। এতে এইচসিটি (Hct) নামের লোহিত কণিকা যেটি রয়েছে, তা বেড়ে যায়। এটি দেখেই আসলে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা নির্ধারণ হয়। অর্থাৎ ওই রোগীর কতটুকু ফ্লুইড প্রয়োজন, কতটুকু দিতে হবে বা কীভাবে দেবে।’

তিনি বলেন, ‘প্লাটিলেট নিয়ে বেশি ভয়ের কিছু নেই। কারণ, জ্বরে আক্রান্ত হলে এটি কমে যাওয়া স্বাভাবিক এবং এটি নিজ থেকেই ঠিক হয়ে যায়। যাদের ২০ হাজারের নিচে নেমে যায় এবং শরীরের কোনও অংশ থেকে রক্তপাত হয়, তখনই এটি বাইরে থেকে দিতে হয়। অর্থাৎ রোগীর প্লাটিলেট কত কমে গেল তার ওপর আসলে চিকিৎসা নির্ভর করে না। রোগীর চিকিৎসা নির্ভর করে মূলত এইচসিটি’র অবস্থা কেমন তার ওপর।’

এ বছর ডেঙ্গু সংক্রমণের তুলনায় মৃত্যুর হার বেশি, দিন দিন রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে / ঢাকা পোস্ট

প্লাটিলেট পাঁচ হাজার কাউন্টেও অনেক রোগী ভালো থাকে

ডা. আশরাফুল হক বলেন, ‘প্লাটিলেট ৫ হাজার কাউন্টেও অনেকে ভালো থাকেন। কোনো ধরনের লক্ষণ থাকে না, কোনো প্রকার রক্তক্ষরণ থাকে না। প্লাটিলেটের সঙ্গে কিন্তু রক্তক্ষরণের সম্পর্ক নেই। তার মানে হলো প্লাটিলেট ৫ হাজার কাউন্টেও যেমন রোগীকে খারাপ বলা যায় না, আবার এক লাখ থাকলেও ভালো বলা যায় না। অর্থাৎ কারো ক্ষেত্রে এক লাখেও রক্তক্ষরণ হতে পারে, আবার কারো ক্ষেত্রে ৫ হাজারেও রক্তক্ষরণ হয় না।’

তিনি আরও বলেন, ‘পুরো বিশ্বেই গাইডলাইন যেমনটি বলে— রক্তে প্লাটিলেট কাউন্ট ১০ হাজারে নেমে এলে প্লাটিলেট দেওয়ার ব্যাপারে চিন্তা করা হয়। কারণ, শরীরের ভাইটাল যে অর্গানগুলো আছে, বিশেষ করে ব্রেনে রক্তক্ষরণ হলে সেটি রিকভার করা যায় না। এজন্যই বলা হয়ে থাকে ১০ হাজারের নিচে এলেই প্লাটিলেটের বিষয়ে চিন্তা করার জন্য। এর বাইরে প্লাটিলেট নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।’

ডা. আশরাফুল হক বলেন, ‘এখন অনেক ক্ষেত্রে প্লাটিলেটের প্রয়োজন না থাকলেও এর ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। চিকিৎসক না বললেও অনেকে নিজেদের উদ্যোগে প্লাটিলেট ব্যবহার করছেন। বিষয়টি প্লাটিলেট প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নতুন জটিলতা তৈরি করছে।’

সেপ্টেম্বরে আগের মাসের (আগস্ট) চেয়ে তিনগুণ বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন / ঢাকা পোস্ট

ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেই চিকিৎসকের পরামর্শের আওতায় আসা উচিত

ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেই প্রত্যেক রোগীকে চিকিৎসকের পরামর্শের আওতায় আসা উচিত বলে মনে করেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্লাটিলেট দেখে রোগীকে বাসায় নিয়ে বসে থাকলে হবে না। আমি মনে করি কেউ ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেই তার চিকিৎসকের কাছে আসা উচিত। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া উচিত। প্লাটিলেট ২০ হাজার বা পঞ্চাশ হাজারে এলে এরপর হাসপাতালে ভর্তি হব, এমন চিন্তা করা কখনো উচিত হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘একজনের প্লাটিলেট ঠিক থাকলেও ব্লাড প্রেসার অনেক কমে যেতে পারে, সেটা কিন্তু একজন চিকিৎসক বুঝবে। এর বাইরে কেউ বিষয়টি ধরতে পারবে না। গত বছর থেকে ডেঙ্গুতে রক্তক্ষরণের কোনো চিহ্ন নাই, রোগীর শরীরে লাল লাল সোপ হচ্ছে না। এমনকি প্লাটিলেট কাউন্টও কমছে না, কিন্তু হঠাৎ করেই তার ব্লাড প্রেসার কমে যাচ্ছে। এজন্য আমি মনে করি রোগীকে অবজারভেশনে রাখা দরকার। চিকিৎসকের কাছে থাকলে দিনে নিয়মিত তিনবার ব্লাড প্রেশারটা দেখতে পারে, এ ছাড়া অন্যান্য লক্ষণ থাকলে সেটিও ধরা পড়ে।’

মুশতাক হোসেন আরও বলেন, ‘এ বছর ডেঙ্গু সংক্রমণের তুলনায় মৃত্যুর হার বেশি। দিন দিন রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। এখন আমাদের স্বাস্থ্য সেবা নিয়েও ভাবতে হবে। হাসপাতালকেন্দ্রিক চিন্তা না করে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া এডিস মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের আরো বেশি সক্রিয় হওয়া জরুরি। না হলে সামনের দিনগুলোতে ডেঙ্গুর প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।’

আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু, শয্যার তুলনায় দ্বিগুণ রোগী / ঢাকা পোস্ট

প্লাটিলেট সর্বনিম্ন কত হলে ভয়ের কারণ

দেশের প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখি রক্তে প্লাটিলেট ৪০ থেকে ৫০ হাজারের মধ্যে এলেই রোগীর স্বজনদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা যায়। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো, প্লাটিলেট যদি ২০ থেকে ১০ হাজারের মধ্যেও নেমে আসে, এমন অবস্থায়ও রোগীর প্লাটিলেট নাও লাগতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘প্লাটিলেট নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। রোগীর যদি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয় সেক্ষেত্রে নতুন করে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। এছাড়া ডেঙ্গু রোগীর রক্তেরও প্রয়োজন হয় না।’

অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘রক্তের প্লাটিলেটের সঙ্গে খাবার-দাবারের কোনো সম্পর্ক নেই। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে স্বাভাবিক খাবার দিতে হবে। অতিরিক্ত কোনো খাবারের প্রয়োজন নেই। বেশি করে পানি খাওয়াতে হবে। লিকুইড জাতীয় খাবার বেশি খাওয়ানো যেতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে প্লাটিলেট নিয়ে ভয়ে থাকেন, এমন অধিকাংশ রোগীরই প্লাটিলেটের প্রয়োজন হয় না। এমনকি অনেক রোগীকে রক্ত দিতে বলা হয়, আমি মনে করি সেটিও দেওয়া লাগে না। রোগী এবং তাদের স্বজনদের এসব নিয়ে এত ভয়ের কোনো কারণ নেই। কিছু সংখ্যক রোগীর ক্ষেত্রে প্লাটিলেট এবং আলাদা রক্তের প্রয়োজন হলেও সেটি অবশ্যই কোনো চিকিৎসক নির্ধারণ করবেন।’

টিআই/এমজে