প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় ছিল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ। দেশের স্বাধীনতা অর্জনে যে দলের অবদান ছিল, সেই দলেরই শীর্ষ নেতৃত্বকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হলো। টানা চারবার যে দল ক্ষমতায় ছিল তাদের কেন পালাতে হলো?

এমন প্রশ্নের জবাব নিজ দলের নেতারাই দিচ্ছেন। তারা বলছেন, ‘দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার ফলে দলের সবকিছু কিছু এলিট শ্রেণির কাছে জিম্মি ছিল। তারা সবকিছুতে টাকাকে প্রাধান্য দিত। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলোতে মনোনয়নপ্রাপ্তিতে ব্যবসায়ীরা ছিলেন এগিয়ে। ক্ষমতা ভোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। বিপদের দিনে তারাই আগে পালিয়েছেন। তারা আওয়ামী লীগের ক্ষমতা টিকাতে পারেননি।’

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ীদের প্রায় ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ী এবং প্রায় ৯০ শতাংশই কোটিপতি ছিলেন। ২৯৯ এমপির মধ্যে বার্ষিক শীর্ষ ১০ জন আয় করা ব্যক্তির তালিকায় আওয়ামী লীগের পাঁচ, স্বতন্ত্র চার এবং জাতীয় পার্টির একজন ছিলেন। একাদশ জাতীয় সংসদের তুলনায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ী ও কোটিপতি সংসদ সদস্যের সংখ্যা বেড়ে যায়

জানা গেছে, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতার আসনে বসে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ সালের দশম, ২০১৮ সালের একাদশ এবং ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ক্ষমতা আসে দলটি। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে দলের ত্যাগীদের অবমূল্যায়ন করা হয়। সেখানে দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী ও আমলারা রাজনীতির মাঠ দখল করেন। এতে স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ জনসাধারণে দল থেকে ব্যবসায়ীদের দলে পরিণত হয়।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ীদের প্রায় ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ী এবং প্রায় ৯০ শতাংশই কোটিপতি ছিলেন। ২৯৯ এমপির মধ্যে বার্ষিক শীর্ষ ১০ জন আয় করা ব্যক্তির তালিকায় আওয়ামী লীগের পাঁচ, স্বতন্ত্র চার এবং জাতীয় পার্টির একজন ছিলেন। একাদশ জাতীয় সংসদের তুলনায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ী ও কোটিপতি সংসদ সদস্যের সংখ্যা বেড়ে যায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের এক সাংগঠনিক সম্পাদক ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজনীতির দরজা সবার জন্য খোলা। যে কেউ করতে পারেন। কিন্তু সেটি হতে হবে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য। মানুষের জন্য রাজনীতি করলে কেউ অপকর্ম করতে পারেন না। ব্যবসায়ীরাও রাজনীতি করবেন, ঠিক আছে। কিন্তু দলকে বিক্রি করে নিজের আখের গোছানোর জন্য নয়।

‘আওয়ামী লীগকে গিলে খেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। দলের একনিষ্ঠ কর্মী ও সমর্থক যারা ছিলেন, দুঃসময় যদি তাদের কাছে দায়িত্ব থাকত তাহলে আজ দলকে এত বড় বিপদে পড়তে হতো না। আমরা জানি ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়, তাই বলে কেউ পালিয়ে যাবেন— এটা মেনে নেওয়া যায় না। রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতে না থাকলে তার খেসারত তো দিতেই হবে।’

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। সেখানে একতরফা নির্বাচন, আসন ভাগাভাগির নির্বাচন, অভিযোগের নির্বাচন, সবচেয়ে কম দলের সংসদ, ভোটার উপস্থিতির হার নিয়ে প্রশ্ন, বিপুল সংখ্যক ভোটারের অনুপস্থিতি, কিংস পার্টির ভরাডুবি, হলফনামা বাছাই, আচরণবিধি লঙ্ঘন ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে শিথিলতা, সহিংসতার চিত্র, নির্বাচনে পরিবারতন্ত্রের প্রভাব, সীমিত পর্যবেক্ষণসহ নানা দিক তুলে ধরা হয়।

সুজনের বিশ্লেষণে দেখা যায়, নির্বাচিত এমপিদের মধ্যে শীর্ষ ১০ আয়কারীর তালিকায় প্রথমেই ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের গোলাম দস্তগীর গাজী। তার বার্ষিক আয় ৮৩ কোটি ২৯ লাখ ২৫ হাজার ৩২৩ টাকা। দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের স্বতন্ত্র সদস্য এস এ কে একরামুজ্জামান। তার বার্ষিক আয় ৫৪ কোটি ১ লাখ ৪২ হাজার ২৭৬ টাকা। তৃতীয় অবস্থানে ছিলেন কুমিল্লা-৮ আসনের আবু জাফর মোহাম্মদ শফিউদ্দিন। তার বার্ষিক আয় ৩৫ কোটি ২৯ লাখ ৫১ হাজার ৮২১ টাকা। পরের অবস্থানে ছিলেন ঢাকা-১ আসনের সালমান ফজলুর রহমান। তার বার্ষিক আয় ২৫ কোটি ৩১ লাখ ২১ হাজার ২৭৩ টাকা। এ ছাড়া ঝিনাইদহ-২ আসনের মো. নাসের শাহরিয়ার জাহেদীর বার্ষিক আয় ১৯ কোটি ৬০ লাখ; লক্ষ্মীপুর-১ আসনের আনোয়ার হোসেন খানের বার্ষিক আয় ১৯ কোটি ৬ লাখ; বরিশাল-৩ আসনের গোলাম কিবরিয়া টিপুর বার্ষিক আয় ১৮ কোটি ৮০ লাখ; নরসিংদী-৩ আসনের মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লার বার্ষিক আয় ১৬ কোটি ৬৮ লাখ; ঢাকা-১৮ আসনের মো. খসরু চৌধুরীর বার্ষিক আয় ১৬ কোটি ৬৬ লাখ এবং যশোর-৩ আসনের কাজী নাবিল আহমেদের বার্ষিক আয় ১৪ কোটি টাকার ওপরে।

সেখানে আরও দেখা যায়, দ্বাদশে নির্বাচিতদের মধ্যে বার্ষিক এক কোটি টাকার বেশি আয় করেন ১১১ জন। আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে এ হার শতকরা ৩৯ দশমিক ৯১ শতাংশ, জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিতদের মধ্যে এ হার শতকরা ৩৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচিতদের মধ্যে এ হার ২৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। নির্বাচিত এমপিদের মধ্যে বিগত ১৫ বছরে সম্পদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এক নম্বরে ছিলেন মাদারীপুর-১ আসনের নূর-ই-আলম চৌধুরী। ২০০৮ থেকে বর্তমানে তার সম্পদ বৃদ্ধির হার ৯৫ গুণ, জামালপুর-৩ আসনের মির্জা আজমের ৯২ গুণ, দিনাজপুর-২ আসনের খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর ৯২ গুণ, জয়পুরহাট-২ আসনের আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের ৭২ গুণ, নাটোর-৩ আসনের জুনায়েদ আহমেদ পলকের ৬৯ গুণ, নওগাঁ-১ আসনের সাধন চন্দ্র মজুমদারের ৫৪ গুণ, ঢাকা-২ আসনের মো. কামরুল ইসলামের ৪২ গুণ, নরসিংদী-২ আসনের আনোয়ারুল আশরাফ খানের ৩৬ গুণ, দিনাজপুর-৪ আসনের আবুল হাসান মাহমুদ আলীর ৩৪ গুণ এবং সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের মো. শফিকুল ইসলামের সম্পদ বৃদ্ধির হার ৩০ গুণ।

সম্পদশালীদের মধ্যে শীর্ষে এক হাজার ৪৫৭ কোটি ৭০ লাখ ৬৩ হাজার ৩২৫ টাকার সম্পদ রয়েছে গোলাম দস্তগীর গাজীর। ১০ নম্বরে থাকা নোয়াখালী-২ আসনের মোরশেদ আলমের সম্পদ ছিল ১৭৪ কোটি ৩৪ লাখ ৪৩ হাজার ৯৬৬ টাকার। তালিকায় অন্যদের মধ্যে রয়েছেন– এস এ কে একরামুজ্জামান, আবু জাফর মোহাম্মদ শফি উদ্দিন, সালমান ফজলুর রহমান, আব্দুল মমিন মন্ডল, মোহাম্মদ সাঈদ খোকন, সিরাজুল ইসলাম মোল্লা ও আনোয়ার হোসেন খান।

অর্থাৎ ক্ষমতার উচ্চ আসনে ছিলেন ব্যবসায়ীরা। তারা কেন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে পারলেন না— এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের মহানগরের একাধিক নেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আওয়ামী লীগকে সব ‘সুযোগ-সুবিধা’ ভোগের বস্তু বানিয়েছিলেন ব্যবসায়ী ও আমলারা। যে যেভাবে পেরেছেন দলকে বদনামের ক্ষেত্র হিসেবে তৈরি করেছেন। ব্যাংক লোন, নামে-বেনামে প্রজেক্ট ও দুর্নীতি করার দিকে ছিল তাদের নজর। দলের নাম বিক্রি করে গড়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। ব্যবসায়ীরা এখন বিদেশে পালিয়ে গেছেন। আর দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকেও দল যাদের অবহেলা করেছে তারাই আজ খেসারত দিচ্ছে। মামলার আসামি হচ্ছে। তাদের বাড়িঘরে হামলা হচ্ছে, ভাঙচুর করা হচ্ছে। আমরা যে এখন কোথায় আছি, কেউ তো খোঁজ নিচ্ছে না।

তাদের ভাষ্য মতে, আওয়ামী লীগ বারবার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এখন কার কী দোষ, সেটা বিচারের সময় না। দল যখন ঘুরে দাঁড়াবে তখন কার কী দোষ, সেটা বিবেচনা করা হবে। কাদের কারণে আজ এই দশা সেটা আমরা ভুলে যাব না। আমাদের কী কী দুর্বলতা ছিল, সেগুলো খোঁজা হচ্ছে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। এখন বিভাজন করতে চাই না। সংকট কেটে গেল দলীয় বিষয়ে আলোচনা করা যাবে।

এমএসআই/