গত ২৫ আগস্ট মোহাম্মদপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের এক সহকারী শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দায়ের করেন আব্দুল মালেক। এক মাসের বেশি সময় পার হলেও সেই অভিযোগের বিষয়ে কিছুই জানতে পারেননি তিনি। সংশ্লিষ্ট তথ্যপ্রমাণ জমা দেওয়ার পরও এ নিয়ে তদন্তের আবেদন আলোর মুখ দেখেনি বলে দাবি করেন অভিযোগকারী।

একই অভিযোগ ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী কালাম মুহাম্মদের। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তার অভিযোগ ছিল— সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংবাদ শেয়ার দেওয়া নিয়ে মুচলেকা ও বহিষ্কারের হুমকি প্রসঙ্গে। এ নিয়ে ২০২৩ সালের ৮ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেন ওই শিক্ষার্থী। কিন্তু তার অভিযোগ এখনও আলোর মুখ দেখেনি।

সম্প্রতি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) এক হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদের তথ্য দিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে তদন্তের আবেদন করেন এক ভুক্তভোগী। সেই আবেদনেরও দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি বলে জানান অভিযোগকারী।

এ ছাড়া এক মাস আগে নড়াইলের কালিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা রুনু সাহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে তদন্তের আবেদন করেন স্থানীয়রা। কিন্তু সে আবেদনও আলোর মুখ দেখেনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দিনের পর দিন মন্ত্রণালয়ে এমন হাজারও অভিযোগ জমা নেওয়া হয়। তার সবই লোক দেখানো, কোনোটিই আলোর মুখ দেখে না। আবেদনের কী হলো— সে বিষয়েও কিছু জানতে পারেন না অধিকাংশ অভিযোগকারী।

অভিযোগ তদন্তের গতি নিয়ে হতাশ খোদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মন্ত্রণালয়ে করা অধিকাংশ অভিযোগই কাগজে থেকে যায়। অভিযোগ গ্রহণ করার পর এর কোনো অগ্রগতি চোখে পড়ে না। অনেকে তদবির করে এসব অভিযোগ গতিশীল করেন, ফলোআপ রাখেন। তাদের কিছু অভিযোগের তদন্ত হয় বা বিভিন্ন অধিদপ্তরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

‘অনেকে আবার অভিযোগ জমা দেওয়ার পর মন্ত্রণালয়ে আসতে পারেন না। নিয়মিত খোঁজখবর নিতে পারেন না। ফলে তাদের অভিযোগ আর গতি পায় না। এটা তিক্ত বাস্তবতা।’

ওই কর্মকর্তার মতে, ‘এসব অভিযোগের আসলে কোনো মূল্য নেই। যে অভিযোগ করে আপনি তদন্তই পাবেন না, সেখানে অভিযোগ করে কী লাভ? তবুও মানুষ না বুঝে অভিযোগ করেন। আর মন্ত্রণালয় এগুলো গ্রহণ করে ফেলে রাখে। এভাবেই চলতে থাকে। এমন ঘটনা সব মন্ত্রণালয়েই। মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছা ছাড়া এসব অভিযোগ কখনও আলোর মুখ দেখে না।’

ভুক্তভোগীদের আশার গুড়ে বালি

আব্দুল মালেক নামের এক ভুক্তভোগী ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাধারণ মানুষ অনেক আশা নিয়ে মন্ত্রণালয়ে গিয়ে অভিযোগ দায়ের করেন, যেন তদন্তের মাধ্যমে সঠিক বিচার পাওয়া যায়। মন্ত্রণালয়ে তো সবাই প্রবেশ করতে পারেন না। তাই কষ্ট করে ভিজিটর পাস সংগ্রহ করে অনেকে অভিযোগ জানান।

‘একজন সাধারণ মানুষ তো প্রতিদিন এটার ফলোআপ রাখতে পারেন না। প্রতি সপ্তাহে পাসও পাবেন না, সচিবালয়ে প্রবেশও করতে পারবেন না।’

তার অভিযোগ, ‘অভিযোগপত্রের সঙ্গে ফোন নম্বর দেওয়া হয়। সেখানে কল দিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অগ্রগতির তথ্য জানাতে পারে। কিন্তু তারা সেটি জানায় না। অভিযোগ নিয়ে কোনো কাজ হচ্ছে কি না, কিছুই আমরা জানতে পারি না। এমনকি অধিকতর তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজন আছে কি না, সেটিও তারা জানায় না। অভিযোগ নিয়ে যদি তদন্তই না হয় তাহলে মন্ত্রণালয় অভিযোগ জমা নেওয়া বন্ধ করে দিক। এতে অন্তত আমাদের ভোগান্তি হবে না, আমরা নিরাশ হব না।’

ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী কালাম মুহাম্মদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘদিন পরও অভিযোগের বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে কিছুই জানানো হয়নি। পরবর্তীতে আমরা নিজেরাই বিষয়টি সুরাহা করেছি। 

যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা

এ বিষয়ে সাবেক পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় সচিব ড. প্রশান্ত কুমার রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, মন্ত্রণালয় তো নবাবি হালে চলে। আমি দায়িত্বপালনকালে এ বিষয়ে একটি উদ্যোগ নিয়েছিলাম। অনেকেই কষ্ট করে মন্ত্রণালয়ে এসে অভিযোগ দেন। আর আমরা সেটা যথাযথভাবে আমলে নেই না। অবশ্যই তদন্ত আবেদনের গতিবিধি অভিযোগকারীদের জানানো উচিত।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টা অবশ্যই প্রাসঙ্গিক। আমি এ বিষয়ে খোঁজখবর নেব। মানুষ যেসব আবেদন করেন, অবশ্যই এর জবাব দেওয়া উচিত। তবে, এত বেশি অভিযোগ জমা পড়ে যে এর মধ্যে অধিকাংশের শক্ত তথ্যপ্রমাণ থাকে না। তবুও কোনটা আমলে নেওয়া হচ্ছে, আর কোনটা আমলে নিতে আরও শক্ত তথ্যপ্রমাণ প্রয়োজন, সেটা জানানো উচিত। এ বিষয়ে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক কোষাধ্যক্ষ ব্যারিস্টার মাসুদ আহমেদ সাঈদ বলেন, বিচার পাওয়া মানুষের অধিকার। কারও সঙ্গে যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে, অবশ্যই তিনি মন্ত্রণালয়ের কাছে অভিযোগ জানাতে পারেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই মন্ত্রণালয়কে সাড়া দিতে হবে। শুধু অভিযোগ দিলেন আর সেখানেই সব শেষ হয়ে গেল, এমন তো হতে পারে না। যত অভিযোগ জমা হচ্ছে, তা নিয়ে ধাপে ধাপে কাজ করা উচিত। এটা এক ধরনের সাধারণ ডায়েরি (জিডি)। জিডিতে যেমন রিপোর্ট দেওয়া হয়, তেমনি এসব অভিযোগেও পজিটিভ-নেগেটিভ রিপোর্ট দেওয়া উচিত।

এমএম/এমএসএ