মিতু হত্যার অন্যতম আসামি কামরুল ইসলাম শিকদার মুছা। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী তিনি এখন নিখোঁজ

মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ডের প্রথম মামলার বাদী ছিলেন সাবেক পুলিশ সুপার স্বামী বাবুল আক্তার। ‘কিলার’ মুছার প্রশ্নে মামলাটি প্রায় থমকে গিয়েছিল। তবে তদন্তে অনেকটা নাটকীয়ভাবে এখন স্বামী বাবুল আক্তারই অভিযুক্ত। নতুন করে দায়ের হওয়া হত্যা মামলায় প্রধান আসামিও তিনি। তবে তার ঘনিষ্ঠ ‘সোর্স’ কামরুল ইসলাম শিকদার মুছা কোথায়? তা জানেন না কেউ।

স্বামীর ফেরার অপেক্ষায় স্ত্রী পান্না আক্তারও। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে তার কথা হয় ঈদের আগের দিন রাতে।  তিনি বলেন, ‘ঈদের আগের রাতে আমি মিনতি করছি, আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। ২০১৬ সালের ২২ জুনের পর থেকে আমি ও আমার সন্তানরা তাকে পাইনি। অনেক দিন মুখ বন্ধ রেখেছি। আর নয়, আমার স্বামীকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। দোষী হোক, নির্দোষ হোক, আগে স্বামীকে ফেরত চাই।’

২০১৬ সালের ৫ জুন বন্দরনগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুলের বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় খুন হন চট্টগ্রামের বিভিন্ন জঙ্গিবিরোধী অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু। ওই হত্যাকাণ্ডের পর পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন বাবুল। শুরুতে জঙ্গিদের সন্দেহ করা হলেও ২৬ জুন মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম ও আনোয়ার নামের  দুজন গ্রেফতারের পর এবং ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ভিডিও ফুটেজ দেখে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছিলেন, খুনিরা ‘পেশাদার অপরাধী’। চিহ্নিত কিলারদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন বাবুলের দীর্ঘদিনের পরিচিত ও ‘সোর্স’ মুছা।

শুরুতে জঙ্গিদের সন্দেহ করা হলেও ২৬ জুন মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম ও আনোয়ার নামের  দুজন গ্রেফতারের পর এবং ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ভিডিও ফুটেজ দেখে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছিলেন, খুনিরা ‘পেশাদার অপরাধী’। চিহ্নিত কিলারদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন বাবুলের দীর্ঘদিনের পরিচিত ও ‘সোর্স’ মুছা

পুলিশের ভাষায়, কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুছাই মিতু হত্যায় নেতৃত্ব দেন। যদিও এখন পর্যন্ত সেই মুছার সন্ধান দিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

মিতু হত্যার অন্যতম আসামি মুছা। তার স্ত্রীর দাবি, ডিবি পরিচয়ে তাকে তুলে নেওয়া হয়। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ

গতকাল বৃহস্পতিবার (১৩ মে) রাতে যোগাযোগ করা হলে মুসার স্ত্রী পান্না আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিজের কথা ভেবে, স্বামীর ফিরে আসা এবং সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ভয়ে এতদিন চুপ থেকেছি। মুখ খুলিনি। কিন্তু এতদিনেও স্বামীকে ফিরে পাইনি। আজ যেহেতু সুযোগ এসেছে। আমি ভীত-সন্ত্রস্ত, আতঙ্কে আছি। তবুও জানতে চাই, আমার মুছা কোথায়?

মিতু হত্যায় মুছার জড়িত থাকার বিষয়টি আপনি বিশ্বাস করেন কি না— জানতে চাইলে পান্না আক্তার বলেন, ‘প্রথমে তো আমি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু ঘটনার পর অনেক বেশি উদ্বিগ্ন ছিল মুছা। কয়েকবার বাবুল আক্তারের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে দেখেছি। দু-একদিন পরই টের পেয়েছিলাম মুসা কোনো না কোনোভাবে মিতু হত্যায় জড়িত। আমি জানতে চয়েছিলাম মুছার কাছে। ও বলেছিল, আমি করিনি, করাইছি। এছাড়া কোনো পথ ছিল না। নইলে আমার নিজেরই ক্ষতি হয়ে যেত।’

অভিযোগ উঠেছে, পরকীয়ার জেরে নিজ স্ত্রী মিতুকে খুন করান সাবেক এসপি বাবুল আক্তার   

মিতু হত্যায় মুছাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন বাবুল আক্তারই

পান্না আক্তার বলেন, মিতু ভাবি দুই সন্তানের মা। আমিও দুই সন্তানের মা। আমি বুঝি বাবা-মাহারা সন্তানদের কী কষ্ট! আমিও প্রতিনিয়ত কষ্ট করছি। মিতু ভাবিকে খুন করতে হবে— এমন কোনো শত্রুতা বা কারণ ছিল না। এরপরও ওই হত্যায় বাবুল আক্তারের চাপে জড়িয়ে পড়েছিল মুছা। বাবুল আক্তারের পূর্বপরিচিত ও সোর্স হিসেবে কাজ করেছে সে।

“স্ত্রী মিতুকে হত্যায় মুছাকে ব্যবহার করেছে সাবেক এসপি বাবুল আক্তার। এজন্য কোনো কিছু হবে না মর্মে ‘শেল্টার’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন বাবুল আক্তার”— বলেন মুছার স্ত্রী।

আত্মসমর্পণের দিন সকালেই তুলে নেওয়া হয় মুছাকে

পান্না বলেন, ‘মিতু হত্যার পর থেকে টেনশনে ছিল মুছা। গ্রেফতার হতে পারেন এবং পুলিশি তল্লাশির কারণে আমরা দুই সন্তানসহ আত্মগোপনে যাই। চলে যাই রাঙ্গুনিয়ায়। মুছা ২২ জুন আদালতে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে তার আগেই ২২ জুন সকাল ৭টার দিকে আমার সামনে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে মুছার সন্ধান মেলেনি।’

ভিডিও ফুটেজ দেখে ঘটনাস্থলে বাবুল আক্তারের সোর্স ও সহযোগী মুছার উপস্থিতি নিশ্চিত করেন তদন্ত কর্মকর্তারা

মুছার স্ত্রী আরও বলেন, মিতু হত্যায় নতুন মামলা হয়েছে। বাবুল আক্তারের সংশ্লিষ্টতার কথা শোনা যাচ্ছে। এখন তো আমাকে কথা বলতেই হবে। বাবুল আক্তারের জন্যই আজ আমার স্বামী অভিযুক্ত ও নিখোঁজ। নতুন হত্যা মামলার তদন্তের স্বার্থেই মুছাকে খুঁজে বের করা জরুরি।

তিনি বলেন, আমার বড় ছেলে ক্লাস নাইনে পড়ে। ছোট ছেলে ক্লাস ফাইভে। বিগত পাঁচ বছর ধরে আমি সন্তানদের তাদের বাবা সম্পর্কে কোনো সদুত্তর দিতে পারিনি। মুছা মিতু হত্যায় জড়িত, অপরাধ অনুযায়ী তার বিচার হোক সেটা আমিও চাই। কিন্তু আমি তো স্বামীকে ফিরে পাব। জানতে তো পারব আমার স্বামী জীবিত আছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ, দোষ-নির্দোষ ও বিচার যাই হোক আমি মাথা পেতে নেব। কিন্তু আমার স্বামীকে আগে খুঁজে দিন।

মিতু হত্যায় গত বুধবার তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই দায়ের হওয়া প্রথম মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। এছাড়া নতুন করে দায়ের হওয়া হত্যা মামলায় ১নং আসামি করা হয় স্বামী বাবুল আক্তারকে

মিতু হত্যায় বাবুল আক্তরের সম্পৃক্ততার বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার

তবে মুছা এখন কোথায়— এমন প্রশ্নে গত বুধবার পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, মুছাকে মিতু হত্যার ঘটনাস্থলে দেখা যায়। তিনি বাবুল আক্তারের সোর্স এবং বর্তমানে পলাতক।

২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। ওই সময় এ ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত হয়। ঘটনার সময় মিতুর স্বামী পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার অবস্থান করছিলেন ঢাকায়। ঘটনার পর চট্টগ্রামে ফিরে তৎকালীন পুলিশ সুপার ও মিতুর স্বামী বাবুল আক্তার পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমের জন্য স্ত্রীকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বলে মামলায় অভিযোগ করেন তিনি। তবে দিন যত গড়িয়েছে মামলার গতিপথও পাল্টেছে। একপর্যায়ে সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে আসে স্বামী বাবুল আক্তারের নাম। তদন্তে তার বিরুদ্ধেই হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মঙ্গলবার (১১ মে) ডেকে তাকে হেফাজতে নেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

শেষ রক্ষা হয়নি বাবুল আক্তারের। স্ত্রী হত্যার অভিযোগে তিনি এখন রিমান্ডে আছেন

গতকাল বুধবার (১২ মে) দুপুরে বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন তার শ্বশুর অর্থাৎ মিতুর বাবা। মামলায় আসামি করা হয়েছে আরও সাতজনকে। তারা হলেন- কামরুল ইসলাম মুছা, কালু, ওয়াসিম, শাহজাহান, আনোয়ার, এহতেসামুল হক ভোলা ও সাকি।

এদিকে, স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলার প্রধান আসামি বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। বুধবার দুপুর আড়াইটার দিকে তাকে আদালতে এনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার চাকমা সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। পরে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার জাহান পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

জেইউ/জেডএস/এমএআর