মরফোলজিক্যাল পরিবর্তনের প্রভাবে তীব্র ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে পদ্মা নদীর বাম তীর। এজন্য বাম তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনীতে নকশা পরিবর্তন করতে চায় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। সেইসঙ্গে দ্বিতীয় সংশোধনীতে প্রকল্পের ৫০ কোটি টাকা ব্যয় এবং দুই বছর সময়ও বাড়াতে চায় তারা। পরিকল্পনা কমিশনে এরকম একটি প্রস্তাব পেশ করেছে পাউবো।

সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগে মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পদ্মা নদীর বাম তীর সংরক্ষণ প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধনী চেয়ে প্রস্তাব করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রস্তাবের ভিত্তিতে পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা করে।

সভায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান জানান, পদ্মা নদীর অস্বাভাবিক মরফোলজিক্যাল পরিবর্তনের কারণে চলমান প্রকল্প এলাকা তীব্র ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। এর প্রেক্ষিতে পাউবো চলতি বছর একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে। কমিটি যাচাই-বাছাই করে পদ্মা নদীর বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নকশা সংশোধন করে কাজ বাস্তবায়ন করার পক্ষে মত দেয়।

তিনি জানান, প্রস্তাবিত সংশোধিত নকশা অনুযায়ী প্রায় ১২০ ঘনমিটার জিও ব্যাগ ও ব্লক ডাম্পিং করা প্রয়োজন। যা সর্বশেষ অনুমোদিত প্রকল্পে ছিল ৪০ থেকে ৪৫ ঘনমিটার। ১২০ ঘনমিটার ডাম্পিং ম্যাটেরিয়াল হিসেবে প্রকল্প ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়া সম্ভব নয়। এই অবস্থায় চলমান প্রকল্পের কাজ টেকসই করার লক্ষ্যে ন্যূনতম ২৫ থেকে ৩০ ঘনমিটার অতিরিক্ত জিও ব্যাগ ডাম্পিংয়ের মাধ্যমে চলমান কাজকে শক্তিশালী করার জন্য কারিগরি কমিটি সুপারিশ করেছে। কারিগরি কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে চলমান কাজের শক্তিশালীকরণ কাজ অন্তর্ভুক্ত করে নতুন ৬টি প্যাকেজ এবং ২টি সম্পূর্ণ নতুন দৈর্ঘ্যে তীর প্রতিরক্ষা কাজ অন্তর্ভুক্ত করে প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে।

পরিবর্তিত নকশা অনুযায়ী প্রস্তাবিত শক্তিশালীকরণ কাজে শুধু জিও ব্যাগ ডাম্পিংয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য সিসি ব্লক ডাম্পিংয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়নি বলে জানান প্রধান প্রকৌশলী।

পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রধান মো. ছায়েদুজ্জামান জানান, এই প্রকল্পটির প্রস্তাবিত দ্বিতীয় সংশোধনীতে সর্বমোট ২৬টি প্যাকেজ অন্তর্ভুক্ত করে ডিপিপি প্রণয়ন করা হয়েছে। যার মধ্যে ১৮টি প্যাকেজের কাজ সর্বশেষ অনুমোদিত ডিপিপি অনুযায়ী চলমান রয়েছে এবং ৮টি নতুন প্যাকেজের প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুন ৮টি প্যাকেজের মধ্যে ৬টি প্যাকেজ আগের চলমান কাজের শক্তিশালী করার কাজ এবং ২টি সম্পূর্ণ নতুন কাজ।

এই ছয়টি প্যাকেজের কাজ প্রসঙ্গে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তাওহীদুল ইসলাম জানান, এই ৬টি প্যাকেজের মাধ্যমে প্রস্তাবিত শক্তিশালীকরণ কাজ পূর্বের চলমান কাজের একই স্থানে বাস্তবায়িত হবে বিধায় নতুন ঠিকাদার নিয়োগ না করে চলমান ঠিকাদার দ্বারা কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। চলমান ঠিকাদারদের সঙ্গে ২০১৯-২০ অর্থবছরের রেট শিডিউল অনুযায়ী দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের সমন্বিত রেট শিডিউল হালনাগাদ করা হয় যা বর্তমানে চলমান রয়েছে। পূর্বের রেট শিডিউল হতে হালনাগাদ রেট শিডিউলের সংশ্লিষ্ট কাজের আইটেমে প্রায় ১৮ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলশ্রুতিতে চলমান ঠিকাদাররা পূর্বের রেটে অর্থাৎ ২০১৯-২০ সালের রেট শিডিউল মোতাবেক নতুন প্রস্তাবিত কাজ করতে আগ্রহী নয়।

তিনি জানান, চলমান ঠিকাদারদের চুক্তি ইতোমধ্যে একবার বর্ধিত করা হয়েছে। পুনরায় আবার চুক্তি সংশোধন করার অনুমোদন প্রক্রিয়ায় জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই সহজে কাজ বাস্তবায়ন করতে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ করাই ভালো হবে।

তিনি আরও জানান, শক্তিশালীকরণের জন্য প্রস্তাবিত ৬টি প্যাকেজের কাজের ভেরিয়েশন করা সম্ভব কি না তা পানি উন্নয়ন বোর্ড পরীক্ষা করে দেখবে। যদি ভেরিয়েশন করা সম্ভব না হয়, তবে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন-২০০৬ ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা-২০০৮ অনুসরণ করে হালনাগাদ রেট শিডিউল অনুযায়ী ব্যয় যৌক্তিকভাবে কমিয়ে দরপত্র আহ্বান করে নতুন ঠিকাদার দ্বারা কাজ বাস্তবায়ন করতে পিইসি সভা মত দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (সেচ) মুহা. এনামূল হক জানান, প্রস্তাবিত ৮টি প্যাকেজের মধ্যে ৬টি প্যাকেজের কাজ ইতোমধ্যে চলমান কাজের একই স্থানে হওয়ায় কাজের স্বচ্ছতা ও যৌক্তিকতা সুস্পষ্টভাবে জানতে চাওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় সংশোধনী ডিপিপিতে প্রস্তাবিত শক্তিশালী করার কাজের সংশ্লিষ্ট প্যাকেজের বিস্তারিত তথ্যসহ প্রস্তাবিত প্যাকেজে কেন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে হবে বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে।

তিনি জানান, প্রকল্পে চলমান ১৮টি প্যাকেজের মধ্যে যেগুলোতে শক্তিশালীকরণের প্রয়োজনীয়তা নেই, সেগুলোর প্রতিটি প্যাকেজের চলমান চুক্তি মোতাবেক দফাওয়ারি বিবরণ, ক্রমপুঞ্জিভূত ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি, চুক্তি সম্পাদন শুরু ও শেষ হওয়ার তারিখসহ ওই কাজে এ পর্যন্ত কী পরিমাণ জিও ব্যাগ/সিসি ব্লক ব্যবহার করা হয়েছে, তার বিস্তারিত তথ্য ডিপিপিতে উল্লেখ করতে হবে জানিয়েছে পিইসি। প্রস্তাবিত শক্তিশালীকরণ কাজের ৬টি প্যাকেজের ক্রমপুঞ্জিত ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি উল্লেখপূর্বক শক্তিশালীকরণের যৌক্তিকতা, ডিজাইনের শর্ত, প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত জিও ব্যাগ/সিসি ব্লকের সংখ্যা, সাইজ, ডাম্পিং ভলিউমসহ বিস্তারিত তথ্য ডিপিপিতে সংযোজন করতে বলেছি। এছাড়া, শক্তিশালীকরণ কাজ করার পর এর স্থায়িত্ব কতদিন হবে তা ডিপিপিতে স্পষ্ট করার জন্যও বলেছি।

উল্লেখ্য, প্রকল্পটি ২০২১ সালের ২৮ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পায়। প্রকল্পটির মূল ব্যয় ছিল ৪৪৬ কোটি টাকা এবং বাস্তবায়ন মেয়াদ ছিল অক্টোবর ২০২১ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত। এরপর প্রকল্পটির ৩২ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধি করে এবং বাস্তবায়ন মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে প্রথম সংশোধনী আনে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। বর্তমানে প্রকল্পের ডিজাইন পরিবর্তন ও ভৌত কাজের ব্যয় বৃদ্ধির কারণে দ্বিতীয় সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত দ্বিতীয় সংশোধনীতে ৪৯ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধি করে ২০২৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়াতে চায় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। দ্বিতীয় সংশোধনী অনুমোদিত হলে প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়াবে ৫২৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।

পিইসি সভায় যেসব সিদ্ধান্ত হয়

১. প্রকল্পে চলমান ১৮টি প্যাকেজের মধ্যে যেগুলোতে শক্তিশালীকরণের প্রয়োজনীয়তা নেই, সেগুলোর প্রতিটি প্যাকেজের চলমান চুক্তি মোতাবেক দফাওয়ারি বিবরণ, ক্রমপুঞ্জিভূত ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি, চুক্তি সম্পাদন শুরু ও শেষ হওয়ার তারিখসহ উক্ত কাজে এ পর্যন্ত কি পরিমাণ জিও ব্যাগ/সিসি ব্লক ব্যবহার করা হয়েছে এর বিস্তারিত তথ্য ডিপিপিতে সংযুক্ত করতে হবে।

২. প্রস্তাবিত শক্তিশালীকরণ কাজের ৬টি প্যাকেজের ক্রমপুঞ্জিত ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি উল্লেখপূর্বক শক্তিশালীকরণের যৌক্তিকতা, ডিজাইন ক্রাইটেরিয়া, প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত জিও ব্যাগ/সিসি ব্লকের সংখ্যা, সাইজ, ডাম্পিং ভলিউমসহ বিস্তারিত তথ্য ডিপিপিতে সংযোজন করতে হবে। এছাড়া, শক্তিশালীকরণ কাজ করার পর এর স্থায়িত্ব কতদিন হবে তা ডিপিপিতে স্পষ্ট করতে হবে।

প্রস্তাবিত ৮টি প্যাকেজের মধ্যে ৬টি প্যাকেজের কাজ ইতোমধ্যে চলমান কাজের একই স্থানে হওয়ায় কাজের স্বচ্ছতা ও যৌক্তিকতা সুস্পষ্টভাবে জানতে চাওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় সংশোধন ডিপিপিতে প্রস্তাবিত শক্তিশালী করার কাজের সংশ্লিষ্ট প্যাকেজের বিস্তারিত তথ্যসহ প্রস্তাবিত প্যাকেজে কেন বৃদ্ধি পেয়েছে তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে হবে বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে

৩. প্রস্তাবিত সম্পূর্ণ নতুন ২টি প্যাকেজের তীর প্রতিরক্ষা কাজের পরিমাণ, ডিজাইন ক্রাইটেরিয়া, জিও ব্যাগ/সিসি ব্লকের সংখ্যা, সাইজ, ডাম্পিং ভলিউম ও স্ট্রেন্দসহ বিস্তারিত তথ্য ডিপিপিতে সংযুক্ত করতে হবে।

৪. শক্তিশালীকরণের জন্য প্রস্তাবিত ৬টি প্যাকেজের কাজের ভেরিয়েশন করা সম্ভব কি না তা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) পরীক্ষা করে দেখবে। যদি ভেরিয়েশন করা সম্ভব না হয় তবে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন-২০০৬ ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা-২০০৮ অনুসরণপূর্বক হালনাগাদ রেট শিডিউল অনুযায়ী ব্যয় যৌক্তিকভাবে হ্রাস করে দরপত্র আহ্বানপূর্বক নতুন ঠিকাদার দ্বারা কাজ বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

৫. নদী তীর প্রতিরক্ষা কাজের নতুন ২টি প্যাকেজের হালনাগাদ রেট শিডিউল অনুযায়ী ব্যয় প্রাক্কলন করে স্থান (জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন), নকশা ও ব্যয় প্রাক্কলন ডিপিপিতে উল্লেখ করতে হবে।

৬. প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বৃদ্ধি করে অক্টোবর ২০২১ হতে সেপ্টেম্বর ২০২৬ পর্যন্ত নির্ধারণ করতে হবে।

এসআর/পিএইচ