গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরই দুষ্কৃতিকারীরা মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানায় হামলা চালায়। লুট হয় থানার আগ্নেয়াস্ত্রসহ সব জিনিসপত্র, করা হয় ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ। পুলিশশূন্য দুই থানার কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হতেই লুট করা পুলিশের অস্ত্রে আধিপত্য বিস্তারের নামে মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে সক্রিয় হয় মাদক কারবারিরা।

গত ১৮ ও ১৯ আগস্ট সংঘর্ষে জড়ায় জেনেভা ক্যাম্পের বি ব্লকের কুতুব উদ্দিনের ছেলে চুয়া সেলিম (৩৮) ও ৭নং সেক্টরের জি ব্লকের আব্দুস সালামের ছেলে ভূইয়া সেলিমের (৩৫) গ্যাং। সংঘর্ষে তাদের হাতে পুলিশের ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র দেখা যায়। যা ক্যাম্পবাসীর মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। ঘটনার ছবি ও জড়িতদের তথ্য মালিবাগে গোয়েন্দা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিসে পাঠিয়েছেন মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা।

শুধু ওই ঘটনা নয়, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দুটি গোয়েন্দা সংস্থা থেকে মোট সাতটি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এর মধ্যে পরপর দুটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়— ‘যেকোনো মুহূর্তে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে।’ একই সঙ্গে অস্ত্র উদ্ধারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এরপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

লুট করা পুলিশের অস্ত্রে আধিপত্য বিস্তারের নামে মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে সক্রিয় মাদক কারবারিরা / ছবি-সংগৃহীত

গোয়েন্দা পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দা সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরের দিন রাতেই শুরু হয় আধিপত্যের লড়াই। ৬ আগস্ট কলিম জাম্বুর গুলিতে মারা যান শাহেন শাহ নামের এক যুবক। পরে ১৭ থেকে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত টানা পাঁচদিন, দ্বিতীয় দফায় ৩০ আগস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংঘর্ষ হয়। ৪ সেপ্টেম্বর সোহেল গ্যাংয়ের গুলিতে মারা যান অটোরিকশাচালক সাদ্দাম হোসেন সনু। ২২ সেপ্টেম্বর রাত থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর ভোর পর্যন্ত দু’পক্ষের গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে শীর্ষ মাদক কারবারি চুয়া সেলিমের স্ত্রী নাগিন বেগম এবং ২৩ সেপ্টেম্বর চারকো ইরফান গুলিবিদ্ধ হন। এ ছাড়া ২৪ সেপ্টেম্বর গুলিবিদ্ধ সাগর নামে এক কসাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

গত ৩১ মে ককটেল বিস্ফোরণে মারা যায় রাসেল নামের এক শিশু। সর্বশেষ গত ২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর রাতেও গোলাগুলি হয়। তাতে কেউ নিহত না হলেও আহত হয়েছেন ছয়জন।

মাঠপর্যায়ের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, এখানকার পরিস্থিতি আগের তুলনায় অনেক খারাপ। যেনতেন অভিযানে রয়েছে নিরাপত্তাহীনতা। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সেসব বিস্তারিত জানানো হয়েছিল। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হলে জেনেভা ক্যাম্প থেকে অস্ত্র যেমন উদ্ধার হতো, তেমনি মৃত্যু বা হতাহতের ঘটনা ঠেকানো যেত।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি দল টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকায় অনেক স্থানীয় নেতা, থানার পুলিশ ও প্রভাবশালীরা জেনেভা ক্যাম্পে মাদকের কারবার টিকিয়ে রেখেছে মাসোহারার বিনিময়ে। বিহারিদের সবচেয়ে বড় আবাসস্থল হিসেবে জেনেভা ক্যাম্প যতটা না পরিচিত, তার চেয়ে বেশি পরিচিত মাদকের হাব হিসেবে। সেখানে নানা সময় অভিযানেও কাজ হয়নি। রয়ে গেছে মাদকের কারবার। এর মধ্যে দেশে পরিবর্তিত নতুন পরিস্থিতিতে থানা লুটের অস্ত্র মাদক কারবারিদের হাতে যাওয়ায় জেনেভা ক্যাম্পের সার্বিক নিরাপত্তা ভয়ংকর হয়ে পড়েছে। সহসা সেখানে সাঁড়াশি অভিযান ও অস্ত্র উদ্ধার করা না গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির শঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন গোয়েন্দারা

গোয়েন্দা প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট পুলিশশূন্য অবস্থায় মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানার কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। এ সুযোগে মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের সক্রিয় মাদক কারবারিরা আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দফায়-দফায় সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত ১৮ ও ১৯ আগস্টের সংঘর্ষে চুয়া সেলিম ও ভূঁইয়া সোহেল গ্যাংয়ের সদস্যদের হাতে পুলিশের ব্যবহৃত পিস্তল দেখা যায়, যা দুই থানা থেকে লুট করা।

এ অবস্থায় আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের জন্য বিশেষ অভিযান পরিচালনাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা না গেলে মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প ও ক্যাম্পের আশপাশের এলাকায় হত্যাসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়েছিল গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।

জেনেভা ক্যাম্প ও এর আশপাশের এলাকায় হত্যাসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটতে পারে বলা আশঙ্কা করা হচ্ছে / ফাইল ছবি

এ ছাড়া মোহাম্মদপুর থানা ও ফাঁড়ির কোন কোন সদস্য, কাউন্সিলর রাষ্টন, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাসহ স্থানীয় প্রভাবশালীদের কার কী ভূমিকা এবং কে কত মাসোহারা পান, জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবার পরিচালনায় কারা কারা জড়িত— এসবের ফিরিস্তি তুলে ধরে ৫ আগস্টের আগে আরেকটি প্রতিবেদন দিয়েছিল এসবির মোহাম্মদপুর টিম। প্রতিবেদনে উল্লিখিতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও ৫ আগস্ট পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেটা আর সম্ভব হয়নি।

গেল আগস্ট মাসের আরেকটি প্রতিবেদনে জেনেভা ক্যাম্পে মাদক কারবারে জড়িত ও লুট করা অস্ত্র কাদের কাছে আছে— সেটির একটি খসড়া তালিকা প্রস্তুত করা হলেও অধিকাংশ অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার সম্ভব হয়নি।

পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (চলতি দায়িত্বে) মো. শাহ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিবেদন জমা হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেক প্রতিবেদনই এসেছে। মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানার লুটের অস্ত্র মাদক কারবারিদের হাতে যাওয়ার ঘটনায় কোনো প্রতিবেদন আসছে কি না, তা না দেখে বলা সম্ভব না। আমলযোগ্য হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তখন সম্ভব হয়নি এখন সম্ভব, তালিকা ধরে কাজ চলছে

পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের কনফিডেনশিয়াল অ্যান্ড কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিবেদন আমলে নিয়ে তখন ব্যবস্থা নেওয়া গেলে হয়তো লুটের সব অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হতো। উদ্ভূত ও পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে তখন পুলিশের মনোবল দুর্বল ছিল, ছিল জনবল সংকট। যে কারণে সম্ভব হয়নি। তবে, এখন সম্ভব। প্রতিবেদনের আলোকেই কাজ চলছে। স্বেচ্ছায় অস্ত্র জমা দেওয়ার সময় শেষ। পুলিশের অস্ত্র লুটকারীসহ অবৈধ অস্ত্রধারীদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।

সারা দেশে মাদক কারবারের অন্যতম হাব হিসেবে ব্যবহৃত হয় রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরে অবস্থিত জেনেভা ক্যাম্প / ফাইল ছবি

জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, থানার লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহযোগিতা করছে। বেশি অস্ত্র গেছে জেনেভা ক্যাম্পে। সেখানে বিশেষ কাজ চলছে।

অস্ত্র উদ্ধার না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে : নূর মোহাম্মদ  

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেনেভা ক্যাম্প কিন্তু আগে থেকেই অপরাধীদের স্পট। বিশেষ করে মাদক কারবার, চুরি-ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা ধরনের অপরাধীরা সেখানে আশ্রয় নিয়ে থাকে। এবার অস্ত্র লুটের বিষয় যুক্ত হয়েছে। বিষয়টি খুবই আশঙ্কাজনক, যা ভবিষ্যতে অত্যন্ত খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।

থানা পুলিশের অস্ত্র লুট করতে সাধারণ কোনো মানুষ যায়নি— উল্লেখ করে নূর মোহাম্মদ বলেন, অস্ত্র লুট করেছে অপরাধীরা। কারণ, তারা লুট করা অস্ত্র ব্যবহার করবে। অবশ্যই অস্ত্রের ব্যবহার ঠেকাতে হবে। একটি অস্ত্রও যদি প্রতিনিয়ত ব্যবহার করা হয়, পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। 

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ / সংগৃহীত

সাবেক আইজিপি আরও বলেন, বাংলাদেশে অস্বাভাবিক ও নতুন ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যা আগে পুলিশ কখনও দেখেনি, ফেস করেনি। পুলিশ তো এখন নিজেরাই নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছে। তারা কোথায় অভিযানে যাবে, মামলার তদন্তে যাবে— সেটা এখন ভাবতে হচ্ছে। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশকে এখন সবাইকে নিয়ে কাজ করতে হবে।

মাদক কারবারিদের গ্রেপ্তার-অস্ত্র উদ্ধারে তিন পরামর্শ

এ অবস্থা থেকে উত্তরণে তিনটি পরামর্শ দিয়ে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, কাদের হাতে অস্ত্র আছে, তাদের তালিকা করে পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে হবে। পুলিশ নিজে জেনেভা ক্যাম্পে যেতে না পারলে সোর্স কাজে লাগিয়ে প্রতিনিয়ত সেখানকার পরিস্থিতি নজরদারিতে রাখতে পারে। পাশাপাশি তারা অস্ত্র উদ্ধারের পথ বের করবে। তৃতীয়ত, মাদকের কারবার ও অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধে স্থানীয় মানুষকে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে।

তালিকা হচ্ছে, অস্ত্র উদ্ধারে শিগগিরই সাঁড়াশি অভিযান

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মো.  রবিউল হোসেন ভুঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্রাইম কনফারেন্সে অস্ত্র উদ্ধার নিয়ে বিস্তারিত কথা হয়েছে। কী পরিমাণ অস্ত্র কীভাবে লুট হলো, বেহাত হলো— সেই তালিকা করা হয়েছে। কারা লুট করেছে, তাদের শনাক্ত করার কাজ চলছে। শিগগিরই সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হবে।

যৌথ বাহিনীর অভিযানে জেনেভা ক্যাম্প থেকে উদ্ধার হওয়া অস্ত্র ও মাদক / ছবি- ঢাকা পোস্ট 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) পরিচালক (অপারেশনস ও গোয়েন্দা) অতিরিক্ত ডিআইজি তানভীর মমতাজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাদক কারবারিদের হাতে অস্ত্রের বিষয়টি সহজভাবে দেখার সুযোগ নেই। অস্ত্র উদ্ধারে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। 

সুনির্দিষ্ট তথ্যে অভিযান হোক, ঘটা করে নয়

সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুলিশের অস্ত্র অন্য কারও কাছে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ। থানার লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারে ঘটা করে অভিযান চালালে তা আরও ঝুঁকি তৈরি করবে। সেজন্য সবগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ইন্টেলিজেন্স উইং ব্যবহার করে, তালিকা করে নির্দিষ্ট স্থান ধরে অস্ত্র তথা অস্ত্রধারীর অবস্থান শনাক্ত করে অভিযান পরিচালনা করতে হবে।

জেইউ/এমজে