জেনেভা ক্যাম্প, পর্ব-২
থানা লুটের অস্ত্রে নিয়ন্ত্রণ মাদকের কারবার!
রাতভর উত্তেজনা, ভোরবেলা শুরু গোলাগুলি। কোথাও দেওয়া হয় আকস্মিক আগুন। বুধবারের (৪ সেপ্টেম্বর) সকালটা যেন ভয়াল রূপে হাজির হয় জেনেভা ক্যাম্পের সাধারণ মানুষের মাঝে। মাদক কারবারি দুই গ্যাংয়ের গোলাগুলিতে ঘটনাস্থলে নিহত হন নিরীহ রিকশাচালক সাদ্দাম হোসেন সনু (৩০)।
প্রত্যক্ষদর্শী সাকিব বলছিলেন, ‘ওই দিন ভোর থেকে শুরু হওয়া ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া রূপ নেয় গোলাগুলিতে। থেমে থেমে চলা গুলিতে চারদিকে বিরাজ করছিল আতঙ্ক। মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের কলেজ গেট এলাকায় হঠাৎ গুলিবিদ্ধ হন নিরীহ সনু। সকাল ৭টার দিকে গুলিবিদ্ধ হলেও ঘটনাস্থলেই পড়ে থাকে তার নিথর দেহ। ৮টার পর স্থানীয়দের সহযোগিতায় সনুকে যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল ততক্ষণে না ফেরার দেশে পাড়ি দেন তিনি। বাকি ছিল শুধু মৃত্যু ঘোষণার আনুষ্ঠানিকতা।’
বিজ্ঞাপন
নিহত সনু মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের বাবুল হোসেনের ছেলে। ক্যাম্পের ৫ নম্বর সেক্টরে পরিবার নিয়ে জীবনযুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন তিনি। ভাড়ায় অটোরিকশা চালিয়ে স্ত্রী আর দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে কোনো রকম চলছিল সনুর সংসার।
সনুর বাবা বাবুল হোসেন বলেন, ‘ওরা এখন শুধু বড়ির (ইয়াবা) কারবারই করছে না, ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে প্রতি রাতেই অস্ত্র-গুলির যুদ্ধে নামছে। ওদের কারবারের লড়াইয়ে আমার ছাওয়ালডা মারা পড়ল। বউ আর দুই বাচ্চার সঙ্গে অধম বাবা-মাকেও ভাসায়ে গেল।’
মাদক কারবারিদের গোলাগুলিতে নিহত ৪, আহত ৩৭
শুধুই কি সনু? গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জেনেভা ক্যাম্পের ‘মধুর’ কারবারের নিয়ন্ত্রণে নিতে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে ১১টি সশস্ত্র গ্যাং। এখন পর্যন্ত তাদের মধ্যে লড়াইয়ে নিহত হয়েছেন চারজন। আহত হয়েছেন ৩৭ জন।
গোয়েন্দা পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরের দিন রাতেই শুরু হয় আধিপত্যের লড়াই। দিন-রাত থেমে থেমে চলে গোলাগুলির ঘটনা। ৬ আগস্ট কলিম জাম্বুর গুলিতে মারা যান শাহেন শাহ নামের এক যুবক। একই দিন গলায় গুলিবিদ্ধ হন শুভ।
১৭ থেকে ২৩ আগস্ট, টানা পাঁচদিন চলে দ্বিতীয় দফার সংঘর্ষ। ৩০ আগস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তৃতীয় দফায় সংঘর্ষে লিপ্ত হয় গ্যাংগুলোর সদস্যরা। ৪ সেপ্টেম্বর সোহেল গ্যাংয়ের গুলিতে মারা যান অটোরিকশাচালক সাদ্দাম হোসেন সনু। আহত হন কুরাইশ নামের আরেকজন।
আরও পড়ুন
ওই দিন ভোর থেকে শুরু হওয়া ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া রূপ নেয় গোলাগুলিতে। থেমে থেমে চলা গুলিতে চারদিকে বিরাজ করছিল আতঙ্ক। মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের কলেজ গেট এলাকায় হঠাৎ গুলিবিদ্ধ হন নিরীহ সনু। সকাল ৭টার দিকে গুলিবিদ্ধ হলেও ঘটনাস্থলেই পড়ে থাকে তার নিথর দেহ। ৮টার পর স্থানীয়দের সহযোগিতায় সনুকে যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল ততক্ষণে না ফেরার দেশে পাড়ি দেন তিনি। বাকি ছিল শুধু মৃত্যু ঘোষণার আনুষ্ঠানিকতা
২২ সেপ্টেম্বর রাত থেকে ফের শুরু হয় সংঘর্ষ। চলে ২৩ তারিখ (সেপ্টেম্বর) ভোর পর্যন্ত। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি এবং থেমে থেমে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হন চুয়া সেলিমের স্ত্রী নাগিন বেগম ও চারকো ইরফান।
২৪ সেপ্টেম্বরও সংঘর্ষ হয়। ওই দিন গুলিবিদ্ধ সাগর চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত শনিবার ভোর ৫টার দিকে মারা যান। তিনি পেশায় কসাই ছিলেন। সর্বশেষ গত ২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর রাতেও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে কেউ নিহত না হলেও আহত হন ছয়জন।
স্থানীয়রা জানান, কলিম জাম্বু, ভূঁইয়া সোহেল ও মোহাম্মদ আলী ছাড়াও চুয়া সেলিম ও শুটার আকরামকে গুলি ছুড়তে দেখা গেছে মাদক কারবারিদের আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে।
আগেও সংঘর্ষ হতো, তবে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার দেখেনি ক্যাম্পবাসী
স্থানীয়রা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরদিন থেকে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো সময় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে। মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘর্ষের উত্তাপ বাড়িয়েছে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার। সংঘর্ষের সময় কারও হাতে পিস্তল, কারও হাতে শটগান দেখা গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এর ভিডিও ফুটেজ স্পষ্ট।
বিহারিদের সবচেয়ে বড় আবাসস্থল জেনেভা ক্যাম্পের সাধারণ বাসিন্দারা বলছেন, মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আগেও মারামারি-সংঘর্ষ হয়েছে। তবে, এমন অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার আগে দেখা যায়নি এখানে।
থানা থেকে লুট করা অস্ত্রের ঝনঝনানি জেনেভা ক্যাম্পে
জেনেভা ক্যাম্পে হঠাৎ এত আগ্নেয়াস্ত্র এলো কোথা থেকে— এমন প্রশ্নের উত্তর যেন খুব সহজেই দিলেন মিনহাজ। মোটরসাইকেল গ্যারেজের এ মিস্ত্রি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে গেলে জেনেভা ক্যাম্পের মানুষই প্রথম গণভবনে লুটপাটে অংশ নেয়। বিকেলে গণভবন আক্রান্তের পর জনতার ঢল নামে মোহাম্মদপুর থানায়। ৫ আগস্ট সূর্য ডোবার মুহূর্ত থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত থানার সব কিছু লুট হয়ে যায়। অস্ত্র ও গোলাবারুদের পাশাপাশি লুট করা হয় চেয়ার, টেবিল ও আসবাবপত্র।
মিনহাজের দাবি, ‘গত কয়েকদিনে জেনেভা ক্যাম্প ঘিরে যেসব সংঘর্ষ হয়েছে এবং যারা মারা গেছেন তারা ওই লুট করা অস্ত্রের গুলির শিকার। থানার অস্ত্রগুলো এখন মাদক কারবারিদের হাতে।’ তার মতো একই অভিমত ব্যক্ত করেন জেনেভা ক্যাম্পের একাধিক বিহারি ও বাঙালি।
শুধুই কি সনু? গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জেনেভা ক্যাম্পের ‘মধুর’ কারবারের নিয়ন্ত্রণে নিতে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে ১১টি সশস্ত্র গ্যাং। এখন পর্যন্ত তাদের মধ্যে লড়াইয়ে নিহত হয়েছেন চারজন। আহত হয়েছেন ৩৭ জন
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তাও একই অভিমত ব্যক্ত করেন। তাদের মতে, ৫, ৬ ও ৭ আগস্ট মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানা থেকে যে সব অস্ত্র লুট করা হয় তার বেশির ভাগই ছিল জেনেভা ক্যাম্পে। এর মধ্যে কিছু হাত বদল হয়ে পাচার হয়েছে। কিছু উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আর কিছু পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। তবে, এখনও ৫৫ শতাংশ অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। যা জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণের লড়াইয়ে ব্যবহার হচ্ছে।
৫ আগস্ট ও পরের দুদিনে মোহাম্মদপুর থানার ৬৮২ অস্ত্র লুট
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবরে জনস্রোত নামে গণভবনে। ওই দিন বিকেল ৩টার দিকে জনতার সংঘবদ্ধ হামলায় আক্রান্ত হয় মোহাম্মদপুর থানা। জীবন বাঁচাতে পুলিশ সদস্যরা থানাত্যাগ করেন। এ সুযোগে লুট করা হয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ। ৬ ও ৭ আগস্ট ধরে চলে লুটপাট।
মোহাম্মদপুর থানা থেকে কত অস্ত্র লুট হয়েছিল— জানতে চাইলে থানার অস্ত্রাগারের দায়িত্বে থাকা উপ-পরিদর্শক (এসআই) সাদিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, থানায় পিস্তল, চায়না পিস্তল, শটগান, রাইফেল, শট রাইফেল, এসএমজি ও এলএমজিসহ মোট অস্ত্র ছিল ১৮২টি। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান, নিজ উদ্যোগে ফেরত এবং পরিত্যক্ত অবস্থায় ১০০টি অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে, থানায় গচ্ছিত ছিল মানুষের ৫০০টি অস্ত্র। এর মধ্যে মাত্র শ-খানেক অস্ত্র উদ্ধার করা গেছে। বাকিগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
আরও পড়ুন
থানার অস্ত্র লুট ঠেকাতে এগিয়ে আসেনি কেউ
মোহাম্মদপুর থানায় কর্মরত এবং অস্ত্র লুটের সময় প্রত্যক্ষদর্শী এক এসআই নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ৫ আগস্ট থানায় কর্মরত ছিলাম। দুপুর আড়াইটার দিকে মেসেজ আসে নিরাপদে সরে যাবার। টানা দুদিনের ক্লান্তি কাটাতে ওই সময় আমি ওয়াশরুমে ছিলাম। বের হবার পর দেখি অধিকাংশ পুলিশ সদস্যই চলে গেছেন। তখন পর্যন্ত বুঝিনি সরকারের পতন ঘটেছে। টিভি চালু করে দেখি গণভবনে জনতার স্রোত। বুঝতে আর বাকি রইল না। বাইরে দলবদ্ধ জনতার স্লোগান দেখে ভয় পেয়ে যাই। পুলিশের পোশাক ছেড়ে কোনো রকমে বের হই। বাইরে যাদের দেখি তাদের বেশির ভাগই জেনেভা ক্যাম্প, রায়ের বাজার ও চাঁদ উদ্যান এলাকার বিহারিরা।
‘বেশি মারমুখী ও লুটপাটে সক্রিয় ছিল চিহ্নিত অনেক মাদক কারবারি। পুলিশশূন্য হওয়ায় ওই সময় অস্ত্র লুট ঠেকাতে কেউ এগিয়ে আসেনি। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না আমার।’
এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার বর্তমান অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘খোঁজ নিয়েছি, থানায় লুটপাটে জড়িতরা বেশির ভাগই জেনেভা ক্যাম্পের। থানার অস্ত্রাগার ভাঙার মতো যন্ত্রপাতি সাধারণ মানুষের কাছে ছিল না। অন্যদিকে, জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের বেশির ভাগই কারিগরি কাজে দক্ষ। বেশকিছু অস্ত্র আমরা জেনেভা ক্যাম্প থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করেছি। বাকি অস্ত্র উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের সহযোগিতা করছে।’
আদাবর থানা থেকে লুট ৩০০ অস্ত্র
মোহাম্মদপুর থানার মতো একই দিনে আক্রান্ত হয় আদাবর থানা। থানার অস্ত্রাগারের দায়িত্বে থাকা এসআই দিপঙ্কর হালদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, থানা থেকে ৩০০টি অস্ত্র লুট করা হয়। এর মধ্যে রাইফেল ২০টি, শটগান ৬০টি, শট রাইফেল ১৩টি, এসএমজি ৪টি, এলএমজি ২টি, পিস্তল ৭০টি, টিয়ার গ্যাস গান ১টিসহ পুলিশের মোট ১৯০টি অস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটে। এখনও উদ্ধার হয়নি ৪৬টি অস্ত্র। এ ছাড়া মানুষের জমা রাখা অস্ত্র ছিল ১১০টি। এর মধ্যে মাত্র একটি অস্ত্র উদ্ধার করা গেলেও বাকিগুলো সম্ভব হয়নি। এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি সাত হাজার পিস গুলি।
এসবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেনেভা ক্যাম্পে সবচেয়ে প্রভাবশালী ভূঁইয়া সোহেলের গ্যাং। তবে, বিএনপিমনা সৈয়দপুরিয়া গ্যাং সরকার পতনের পর নতুন করে সেখানে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। গ্যাংগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র আছে ভূঁইয়া গ্রুপের হাতে। তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে আটটি অস্ত্র। এর মধ্যে তিনটি বিদেশি। অস্ত্র তিনটি মিরপুরের কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পের মোহাম্মদ আলীর মাধ্যমে জনৈক আরমানের কাছ থেকে কেনা হয়েছে। তবে, তাদের কাছে লুট করা অস্ত্রই বেশি আছে
জেনেভা ক্যাম্পে কার কাছে কত অস্ত্র
ঢাকাসহ সারা দেশে মাদক কারবারে জড়িত বড় বড় ডনের জন্ম জেনেভা ক্যাম্পে। আগে এ জেনেভা ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ করত নাদিম ওরফে পঁচিশ ও ইশতিয়াক। ২০১৮ সালে র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নাদিম নিহত হন। শীর্ষ এ দুই মাদক কারবারির মৃত্যুর পর জেনেভা ক্যাম্প ঘিরে সক্রিয় অন্তত ১১টি গ্যাং। গ্যাংগুলো হলো- ভূঁইয়া সোহেল গ্যাং, সৈয়দপুরিয়া গ্যাং, আরমান গ্যাং, ছটু/ছটা মাসুদ রানা গ্যাং, মনু গ্যাং, চারকু গ্যাং, কোপ-মনু গ্যাং, রাজু গ্যাং, কামাল বিরিয়ানি গ্যাং, চুয়া সেলিম গ্যাং ও পলু কসাই গ্যাং।
থানার অস্ত্র লুট এবং জেনেভা ক্যাম্পে সেই অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে বলে এসবির (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সেই প্রতিবেদনের একটি কপি ঢাকা পোস্টের হাতে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, জেনেভা ক্যাম্পে সবচেয়ে প্রভাবশালী ভূঁইয়া সোহেলের গ্যাং। তবে, বিএনপিমনা সৈয়দপুরিয়া গ্যাং সরকার পতনের পর নতুন করে সেখানে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। গ্যাংগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র আছে ভূঁইয়া গ্রুপের হাতে। তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে আটটি অস্ত্র। এর মধ্যে তিনটি বিদেশি। অস্ত্র তিনটি মিরপুরের কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পের মোহাম্মদ আলীর মাধ্যমে জনৈক আরমানের কাছ থেকে কেনা হয়েছে। তবে, তাদের কাছে লুট করা অস্ত্রই বেশি আছে।
সোহেলের সহযোগীরা আদাবর ও মোহাম্মদপুর থানা থেকে অস্ত্রগুলো লুট করে। ৫ আগস্টের পর মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ নিতে সোহেল নিজে এবং তার ভাই টুনটুন, রানা, রাজন ওরফে কালু, কলিম জাম্বু, মোহাম্মদ আলী, আহম্মদ আলী ও বানর আরিফ অস্ত্রগুলো ব্যবহার করে।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, সোহেলের সহযোগী হিসেবে কাজ করা সৈয়দপুরিয়া বাবুর কাছে আছে তিনটি অস্ত্র। এর মধ্যে দুটি পুলিশের, যা থানা থেকে লুট করা। অপরটি দেশে তৈরি পিস্তল, যা তারা অর্থের বিনিময়ে সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া তার সহযোগী সাজ্জাদ, ইরফান ও তিল্লি শাহীদের কাছেও আছে অবৈধ অস্ত্র।
জানা যায়, চুয়া সেলিম হচ্ছে ভূঁইয়া সোহেলের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। চুয়া সেলিমের গ্যাং ব্যবহার করে চারটি অস্ত্র। এর মধ্যে দুটি থানা থেকে লুট করা। বাকি দুটি বিদেশি পিস্তল, টাকা দিয়ে সংগ্রহ করা। এগুলোও লুট করা অস্ত্র বলে সন্দেহ গোয়েন্দাদের। চুয়া সেলিম ছাড়াও তার সহযোগী উল্টা সালাম, শান্ত, পিচ্চি রাজা, ফাট্টা আবিদ, পিস্তল নাঈম ও শাহজাদা অস্ত্র চালাতে বেশ দক্ষ বলে জানা গেছে। তার অপর সদস্য আকরাম ও গেইল হীরার অধীনে আছে সাতটি অস্ত্র। কোপ মনু গ্যাংয়ের কাছেও একাধিক অস্ত্র আছে বলে জানা গেছে।
কম যাচ্ছে না অন্য কারবারিরাও
ক্যাম্পের শীর্ষ মাদক কারবারি শেখ আরশাদ ওরফে মোল্লা আরশাদের নিয়ন্ত্রণে এক বা একাধিক অস্ত্র ও গুলি রয়েছে। অপর শীর্ষ মাদক কারবারি কামরান হোসেন ওরফে কামরানের নিয়ন্ত্রণে আছে তিনটি অস্ত্র ও একাধিক গুলি। আনোয়ার হোসেন ওরফে তোতলা আনোয়ারের কাছেও অস্ত্র ও গুলি রয়েছে। কারবার নিয়ন্ত্রণে তার ছেলে এসব অস্ত্র ব্যবহার করেন বলেও অভিযোগ আছে।
জেনেভা ক্যাম্পে নিয়োজিত এসবি’র এসআই পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, শীর্ষ মাদক কারবারি আসলাম ওরফে মেন্টাল আসলাম, মাহতাব ওরফে ছিন্দ্রা মাহতাব, পারভেজ, রহমত হোসেন ওরফে জয়ের নিকট পুলিশের লুট করা একাধিক অস্ত্র ও গুলি রয়েছে। তাদের নেতৃত্বে আদাবর থানার অস্ত্র ও গুলি লুট করা হয়। সেগুলোর কিছু কিছু তারা বিক্রিও করে দেয়। এখনও তাদের জিম্মায় একাধিক অস্ত্র ও গুলি রয়েছে। মাহতাবের ঘাটারচর শান্তিনগরের ঠিকানায় অভিযান চালিয়ে একটি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। তবে, তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।
ছাত্র আন্দোলন দমনে ব্যবহার মাদক কারবারিদের
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সখ্যতা ও যোগাযোগ ছিল ভূঁইয়া সোহেলের। বিগত বছরগুলোতে ক্যাম্পে শক্ত অবস্থান তৈরিতে ঢাকা-১৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের ব্যক্তিগত সহকারী বিপ্লব ও জয়নাল আবেদীন জয়ের সহযোগিতা নেয় সোহেল। নানকের ঘনিষ্ঠ ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের নেতা আরমানও মাসোহারার বিনিময়ে সোহেলকে সহায়তা করেছেন। জুলাইয়ে শুরু হওয়া ছাত্র-আন্দোলন দমাতে সোহেল ও তার গ্যাংয়ের সদস্যরা মাঠে সক্রিয় ছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) পরিচালক (অপারেশনস ও গোয়েন্দা) অতিরিক্ত ডিআইজি তানভীর মমতাজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্যাম্প এলাকায় প্রায়ই অভিযান চালানো হয়। কিন্তু জেনেভা ক্যাম্পে ঢোকা আমাদের জন্য একটু বিপজ্জনক। কারণ, ডিএনসির মাঠপর্যায়ের সদস্যরা নিরস্ত্র। তাই সেখানে অভিযানে গেলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা নিতে হয়।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেনেভা ক্যাম্পে গত রাতেও সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছে যৌথ বাহিনী। অভিযানে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গুলি ও মাদক উদ্ধার, শীর্ষ মাদক কারবারি পিচ্চি রাজাসহ গ্রেপ্তার করা হয় ৩৫ জনকে। অভিযানে একটি পিস্তল, একটি রিভলবার, ২০ রাউন্ড পিস্তলের গুলি উদ্ধার করা হয়। মাদক ও অস্ত্র উদ্ধারের ক্ষেত্রে র্যাব এখন অনেক বেশি তৎপর বলেও জানান তিনি।
পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকার পতনের পরবর্তী পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা কার্যক্রম পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। বিভিন্ন থানার অস্ত্র লুট হয়। সেই সব অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারসহ অপরাধীদের গ্রেপ্তারে গত বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) থেকে মাঠে নামে যৌথ বাহিনী। ৪ সেপ্টেম্বর থেকে সর্বশেষ আজ ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৪২টি অস্ত্র উদ্ধার এবং ৯৭ মামলায় ১১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পুলিশের লুট হওয়া ৭৫ শতাংশ অস্ত্রই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
জেইউ/