মাতৃদুগ্ধের ‘বিকল্প’ শিশুখাদ্যে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি
শিশুসন্তান আবরারুল হককে জন্মের পর গত দুই বছর ধরে মাতৃদুগ্ধের বিকল্প হিসেবে ফর্মুলা দুধ দিচ্ছেন ফেনী শহরের ডাক্তারপাড়া এলাকার নাজমা আক্তার। শুরুতে সবকিছু স্বাভাবিক থাকলেও এক বছরের মাথায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দুই সপ্তাহ হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে শিশুটিকে। কয়েক মাস পর ফের অ্যালার্জি সমস্যায় বেশ কয়েকবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়েছে।
একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন জেলার পরশুরাম উপজেলার কালীকৃষ্ণ নগরের চার বছরের শিশু মাহদি হাসানের মা নাহিদা সুলতানা। তিনি বলেন, সিজারিয়ান অপারেশনের পর ঠিকভাবে বুকের দুধ খাওয়াতে পারিনি। সেজন্য সন্তানের শারীরিক গঠন ও পুষ্টির কথা চিন্তা করে বাজার থেকে কিনে প্যাকেটজাত গুঁড়া দুধ খাওয়ানো শুরু করি। কিছুদিন পর দেখা গেল, ছেলের পেট খারাপ হচ্ছে। তার বয়সী অন্য শিশুরা হামাগুড়ি দেওয়া কিংবা হাঁটার মতো শারীরিক সক্ষমতা অর্জন করলেও মাহদি কিছুটা দেরিতে শুরু করে। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে এসব খাবার খাওয়ানো থেকে সরে আসি।
বিজ্ঞাপন
দাগনভূঞার মো. ইউছুফ আলী বলেন, আমার চার সন্তান। প্রথম মেয়ের জন্মের পর তার মায়ের পরামর্শে বাজার থেকে সেরেলাক (শিশুখাদ্য) কিনেছিলাম। এটি খাওয়ানোর পর প্রথম প্রথম খুব দ্রুত তার শারীরিক বৃদ্ধি লক্ষ করি। কিন্তু বেশিদিন এটি স্থায়ী হয়নি। বিষয়টি আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়নি। তখন থেকে আর কখনও এসব বিকল্প শিশুখাদ্য ক্রয় করিনি।
আরও পড়ুন
শুধু আবরার বা মাহদি নয়, মাতৃদুগ্ধের বিকল্প খাদ্য হিসেবে বিভিন্ন কোম্পানির ফর্মুলা দুধ গ্রহণ করে শারীরিক জটিলতায় পড়েছে অনেক শিশু। চিকিৎসকরা বলছেন, বাজারের বিকল্প শিশুখাদ্যে অতিরিক্ত চিনি ও মধু মেশানো থাকে। এটি জীবাণুমুক্তও নয়। যথাযথ প্রক্রিয়া ও নির্দিষ্ট মাত্রা না মেনে খাওয়ানোর ফলে শিশুদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে এসব খাবার গ্রহণ করলে ভবিষ্যতে দীর্ঘস্থায়ী নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগতে পারে শিশু।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নানা কারণে বাজারে বিক্রি হওয়া বিকল্প শিশুখাদ্যের প্রতি ঝোঁক বেড়েছে অভিভাবকদের। আইনানুযায়ী মাতৃদুগ্ধের বিকল্প শিশুখাদ্য বাণিজ্যিকভাবে প্রদর্শন, প্রচার বা প্রকাশে বিধিনিষেধ থাকলেও তা মানছেন না কেউ। চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখন ফার্মেসি বা ওষুধের দোকান থেকে শুরু করে সুপার শপ, মুদি দোকান কিংবা পাড়া-মহল্লার দোকানেও নিয়মিত বিক্রি হচ্ছে এসব খাদ্য। অতিরিক্ত লাভের আশায় অনেকে বিক্রি করছেন ভেজাল ও নিম্নমানের শিশুখাদ্য। খাদ্য সংরক্ষণে মানা হচ্ছে না নির্দিষ্ট তাপমাত্রাও।
মাতৃদুগ্ধের বিকল্প খাবার হিসেবে বাজার থেকে এসব খাদ্য ক্রয় করছেন অভিভাবকরা। ফলে নিউমোনিয়া, অ্যালার্জি, মেনিনজাইটিস ও নেক্রোটাইজিং এন্টারোকোলাইটিসের মতো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে শিশুদের।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নানা কারণে বাজারে বিক্রি হওয়া বিকল্প শিশুখাদ্যের প্রতি ঝোঁক বেড়েছে অভিভাবকদের। আইন অনুযায়ী মাতৃদুগ্ধের বিকল্প শিশুখাদ্য বাণিজ্যিকভাবে প্রদর্শন, প্রচার বা প্রকাশে বিধিনিষেধ থাকলেও তা মানছেন না কেউ। চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখন ফার্মেসি বা ওষুধের দোকান থেকে সুপার শপ, মুদি দোকান কিংবা পাড়া-মহল্লার দোকানেও নিয়মিত বিক্রি হচ্ছে এসব খাদ্য
বিকল্প শিশুখাদ্যে মায়েদের ভাবনা
শিশুর জন্মের পর থেকে মায়ের দুধই একমাত্র পূর্ণাঙ্গ খাদ্য— এমন কথা কয়েক দশক আগেও ছিল অমোঘ সত্য। তবে, সময়ের সঙ্গে পাল্টে গেছে এ চিত্র। এখন বিভিন্ন কারণে অভিভাবকদের মধ্যে বাজারে বিক্রি হওয়া বিকল্প শিশুখাদ্যের প্রতি বেশি ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। মায়েদেরই এ বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে।
জানতে চাইলে ফেনী শহরের পুরাতন পুলিশ কোয়ার্টার এলাকার বাসিন্দা তামান্না রহিম বলেন, মেয়ের ছয় মাস শেষ হওয়ার পর থেকে বুকের দুধের পাশাপাশি সম্পূরক খাদ্য হিসেবে অন্যান্য খাবার দিচ্ছি। বিকল্প খাদ্য হিসেবে বাজার থেকে ফর্মুলা দুধ কিনছি। এগুলো খেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে আমার মেয়ে।
বিজয়সিংহ এলাকার সানজিদা চৌধুরী বলেন, আশপাশের অনেকে এখন বাচ্চাদের এসব খাবার দিচ্ছে। মূলত ছেলের পুষ্টি ও স্বাস্থ্য ভালো হবে শুনে বাজার থেকে দুধের কৌটা ক্রয় করি। আইন বা স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে কখনও কিছু শুনিনি।
একই প্রসঙ্গে সোনাগাজীর বগাদানা ইউনিয়নের হালিমা আক্তার বলেন, সন্তানের বাড়তি পুষ্টির কথা চিন্তা করেই বাজার থেকে সেরেলাক ক্রয় করেছি। তবে, কোনো চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে কখনও পরামর্শ গ্রহণ করিনি।
ব্রেস্ট ফিডিংয়ে অনীহা মায়েদের
শিশুর প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ প্রাকৃতিকভাবেই সে পেয়ে থাকে মায়ের দুধ থেকে। শিশুর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায় মায়ের দুধের মাধ্যমে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কথিত আধুনিক সমাজের ছোঁয়ায় এমন ভাবনা যেন ফিকে হতে বসেছে।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দেশের একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং (ইবিএফ)-এর হার ছিল প্রায় ৬৫ শতাংশ, যা ২০২২ সালে কমে ৫৫ শতাংশে দাঁড়ায়। শিশুর জন্মের প্রথম বছরে অপুষ্টির কারণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতি বছর ৬০ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ফেনী মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের পরিবার কল্যাণ পরিদর্শক খায়রুন্নেছা সুমি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা সবসময় সন্তানকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর প্রতি জোর দিচ্ছি। অনেক নতুন মা বুকের দুধ খাওয়ালে নিজের স্বাস্থ্যহানি ঘটে— এমন ভুল ধারণা পোষণ করেন। আবার সন্তান জন্মের পর অনেকে বিভিন্ন সমস্যায় ঠিকভাবে দুধ পান না। সেক্ষেত্রেও বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে, কখনও বিকল্প শিশুখাদ্যের পরামর্শ দেওয়া হয় না।
পরশুরাম উপজেলার বীরচন্দ্র নগর এলাকার ষাটোর্ধ্ব মঞ্জুনা আক্তার বলেন, যৌথ পরিবারে আমার তিন ছেলে ও তিন মেয়ে বড় হয়েছে। কখনও বুকের দুধ ছাড়া অন্য কোনো খাবারের কথা চিন্তা করিনি। সংসারের সব কাজ সামলে সন্তানদেরও সময় দিয়েছি। কিন্তু এখন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মায়েদের ভাবনাও পাল্টে গেছে। মায়েরা আরামপ্রিয় হয়ে পড়েছেন। এজন্য বুকের দুধের পরিবর্তে বিকল্প খাবারে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
বাধা যখন সামাজিক ‘ট্যাবু’
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরাও। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সফল পদচারণা থাকলেও জনসমক্ষে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো— বিষয়টি এখনও সামাজিকভাবে ‘ট্যাবু’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। গ্রামের তুলনায় শহুরে জীবনে এমন চিত্র বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে ঘরের বাইরে গেলে বিকল্প শিশুখাদ্যের ওপর নির্ভর হচ্ছেন মায়েরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ফাহিমা আক্তার নামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, বাসায় কেউ না থাকায় ছেলেকে প্রতিদিন কর্মস্থলে আনতে হয়। সেখানে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার বা তেমন জায়গাও নেই। এজন্য বাসা থেকে ফিডারে করে ছেলের জন্য খাবার নিয়ে আসি।
জাকিয়া সুলতানা নামের আরেকজন বলেন, বাসার বাইরে সব জায়গায় ব্রেস্ট ফিডিং করানোর সুযোগ থাকে না। অনেকে জনসমক্ষে এটি ভালোভাবে গ্রহণ করেন না। সবমিলিয়ে পরিবার বা সমাজের দৃষ্টিতে বিষয়টি ইতিবাচক নয়। এজন্য ঘরের বাইরে গেলে বিকল্প খাদ্যেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।
আরও পড়ুন
এ প্রসঙ্গে ফজিলাতুন নূর নামে এক সমাজকর্মী ঢাকা পোস্টকে বলেন, শহুরে জীবনে মানুষের মধ্যে অনেকটা প্রাইভেসি ধারণা থাকে। ফলে অনেক মা ঘরের বাইরে গেলে জনসমক্ষে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। তবে, গ্রামে এ সমস্যা খুব একটা নেই বললেই চলে।
মায়েদেরও রয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি
সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে অনীহায় মায়েদের সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কথা হয় ফেনী জেনারেল হাসপাতালে প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. তাহেরা আক্তার রুজির সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে এমন কিছু সচরাচর দেখা যেত না। তবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বুকের দুধের বিপরীতে বিকল্প শিশুখাদ্যের ওপর নির্ভরের প্রবণতা বাড়ছে। বিশেষ করে নতুন মায়েরা সন্তানদের বুকের দুধ খাওয়াতে কিছুটা অনীহা প্রকাশ করছেন।
‘সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ানো মায়েদের স্তন ক্যানসার, জরায়ু ক্যানসার, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা বেড়ে যায়। জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে মায়ের দুধ দিতে পারলে সহজে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়। এতে মা রক্তস্বল্পতা থেকেও রক্ষা পান। এজন্য প্রত্যেক মাকে যেকোনোভাবে ব্রেস্ট ফিডিংয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।’
বয়সভেদে আলাদা হয় খাবারের ধরন
বাজারে মাতৃদুগ্ধের বিকল্প হিসেবে বিক্রি হচ্ছে নানা ধরনের শিশুখাদ্য। বয়সভেদে ৬ মাস, ৬-১২ মাস, ১২-১৮ মাস ও ২৪ মাসসহ নানা শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে এগুলো। এসব খাদ্যের মধ্যে রয়েছে- সেরেলাক, বায়োমিল, বেবি কেয়ার, ল্যাকটো ফিক্স, ল্যাকটোজেন, ন্যান, জুনিয়র হরলিক্স, মাদার স্মাইল, ম্যামি ল্যাক, সিমি ল্যাক, প্রাইমা, ডিল্যাকসহ হরেক নামে বিক্রি হচ্ছে বিকল্প শিশুখাদ্য।
আরও পড়ুন
যা বলছেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা
মাতৃদুগ্ধের বিকল্প খাদ্য গ্রহণে শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কথা হয় ফেনী জেনারেল হাসপাতালের জুনিয়র কনসালটেন্ট (শিশু) ডা. মুহাম্মদ ইকবাল হোসেন সিরাজীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ফর্মুলা দুধ খাওয়া শুরু করলে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ার প্রতি শিশুর অনীহা তৈরি হয়। বিকল্প শিশুখাদ্যে ব্যবহৃত ফিডারের মাধ্যমে খাবার খেতে শিশুদের জন্য অনেকটা সহজ হয়। পরবর্তীতে শিশুরা মায়ের বুকের দুধ খেতে আর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। আবার শুয়ে থাকা অবস্থায় ফিডারের মাধ্যমে খাওয়ালে তা পাকস্থলীতে না গিয়ে অনেক সময় ফুসফুসে চলে যায়। এতে শিশুর অ্যাসপিরেশন নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
‘ফর্মুলা দুধ বা বিকল্প এসব খাবারের কারণে শিশুদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। বুকের দুধ থেকে যে পরিমাণ পুষ্টিগুণ পাওয়ার কথা তা থেকে শিশু বঞ্চিত হয়। শিশুর জন্মের প্রথম ছয় মাসে মায়ের বুকের দুধ ছাড়া এক ফোটা পানি খাওয়ানোর প্রয়োজন নেই। এর গুণাগুণ কোনো ধরনের বিকল্প শিশুখাদ্যের মধ্যে নেই।’
তিনি বলেন, শিশুদের গুঁড়া দুধে মেলানিনসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর কেমিক্যাল মিশ্রিত থাকার তথ্য ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে এসেছে। এসব ফর্মুলা দুধ খাওয়ালে বিভিন্ন প্রকার জীবাণুর সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। অ্যালার্জি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, মেনিনজাইটিস ও নেক্রোটাইজিং এন্টারোকোলাইটিসসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে। এসব খাদ্য গ্রহণে অনেক শিশুর বুদ্ধিমত্তা কমে যায়। আবার হামাগুড়ি দেওয়া বা হাঁটার মতো শারীরিক সক্ষমতা কিছুটা দেরিতে অর্জিত হয়।
আরও পড়ুন
‘অনেক সময় ঠোঁট কাটা, শারীরিক দুর্বলতা বা মায়ের শারীরিক সমস্যাসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় শিশু বুকের দুধ খেতে চায় না। আবার অনেক সিজারিয়ান অপারেশনের পর শিশু ঠিকমতো দুধ পায় না। সেক্ষেত্রে ভিন্ন কোনো উপায়ে হলেও মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। ঠিকমতো বুকের দুধ না পেলে তখন মায়েদের জন্যও কিছু ওষুধ দেওয়া হয়।’
মিটছে না প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা
শিশুর জন্মের পর থেকে তার শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধির জন্য বাবা-মা সবসময় যত্নবান থাকেন। সন্তানকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর ক্ষেত্রে পছন্দের তালিকায় থাকে নানা শিশুখাদ্য। তবে, এসব শিশুখাদ্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা মিটছে না বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় রাজধানীর ইবনে সিনা হাসপাতালের ডায়েট কনসালটেন্ট ও স্থূলতা ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ পুষ্টিবিদ সিরাজাম মুনিরার সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, মায়ের দুধের মতো পুষ্টিগুণ বিকল্প কোনো খাদ্যে নেই। আবার ভেজাল মিশ্রিত খাবারের কারণে শিশুর মারাত্মক স্বাস্থ্যহানির শঙ্কা থাকে। মায়ের বুকের দুধ গ্রহণে প্রাকৃতিকভাবে শিশুর মধ্যে যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়, বিকল্প কোনো খাদ্যে তা সম্ভব হয় না।
‘বিকল্প খাদ্য গ্রহণের ফলে দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়েই শিশুর জীবনের পথচলা শুরু হয়। পরবর্তীতে স্থূলতা বেড়ে যায়, যা শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। আবার এসব খাবার গ্রহণের পর অনেক শিশুর অতিরিক্ত ওজন বেড়ে যায়। সেটিও মারাত্মক ক্ষতিকর। বিকল্প নানা ধরনের খাদ্য গ্রহণের কারণে বর্তমানে ২২-২৩ বছর বয়সের তরুণ-তরুণীরা হাইপারটেনশনের মতো সমস্যায় ভুগছেন। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে।’
প্রভাব পড়ছে মানসিক স্বাস্থ্যেও
মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে নানা ধরনের শিশুখাদ্য গ্রহণে প্রভাব পড়ছে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যেও। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মায়ের বুকের দুধের ক্ষেত্রে মা ও শিশুর মধ্যে যে বন্ধন সৃষ্টি হয়, বিকল্প কোনো খাদ্যে তা হয় না। আবার সঠিকভাবে শিশুর সামাজিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশও হয় না। এতে পরবর্তীতে তার আবেগীয় ও আচরণগতসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়।
আরও পড়ুন
দেশের খ্যাতনামা এ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, মায়ের দুধের কোনো বিকল্প হয় না। একজন শিশুর জন্য এটিই সর্বোত্তম। কিন্তু বর্তমান সময়ে কর্পোরেট ও বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলো তথাকথিত কিছু বিকল্প খাদ্য বাজারজাত করছে। প্রথমত, এটি বেআইনি ও অনৈতিক। দ্বিতীয়ত, এসব কৃত্রিম খাবার শিশু ও মা কারও জন্যই স্বাস্থ্যকর নয়। এগুলোতে এমন কিছু উপাদান থাকে যা একেক শিশুর জন্য একেক রকম ক্ষতিকর। এক্ষেত্রে এ ধরনের তথাকথিত বিকল্প দুধে নিরুৎসাহিত করা এবং এর বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
পরামর্শ মানতে অনীহা উচ্চবিত্তের
শিশুর জন্য মায়ের বুকের দুধের গুরুত্ব সম্পর্কে মাসহ অন্য অভিভাবকদের সচেতন করতে সরকারি-বেসরকারিভাবে কাজ করছেন অনেকে। তবে, একটু বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতা ও উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোতে এসব পরামর্শ মেনে চলতে বেশ অনীহা রয়েছে বলে জানান মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরা।
মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা রাবেয়া আক্তার নামের এক মাঠকর্মী বলেন, এখানে কাজ করতে গিয়ে মাঝে মাঝে ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। অনেক সময় একটু বেশি পড়াশোনা জানা মায়েরা স্বাস্থ্যকর্মীদের ছোট করে দেখতে চান। কোনো ধরনের পরামর্শ দিলে তারা খুব একটা মানতে চান না, আবার গুরুত্বও দেন না।
১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে ‘মাতৃদুগ্ধ বিকল্প খাদ্য (বিপণনের নীতিমালা) আইন’ প্রণয়ন করা হয়। ২০১৩ সালের ২২ অক্টোবর আইনটি সংশোধন করা হয়। সংশোধিত আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি মাতৃদুগ্ধের বিকল্প শিশুখাদ্য, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত শিশুর বাড়তি খাদ্য বা তা ব্যবহারের সরঞ্জামাদির আমদানি, স্থানীয়ভাবে উৎপাদন, বিপণন, বিজ্ঞাপন মুদ্রণ, প্রদর্শন, প্রচার বা প্রকাশ করলে অথবা শিশু অসুস্থ বা মৃত্যু হলে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবেন
ফেনীর পরশুরামের সুবারবাজার উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দায়িত্বরত মিডওয়াইফ রহিমা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতি মাসে এখানে ৩০-৪০ জন নারীর সন্তান প্রসব করানো হয়। প্রসূতি অবস্থা থেকেই সন্তানকে দুধ খাওয়ানোর সময় কীভাবে ধরে রাখতে হবে, বুকে দুধ ঠিকমতো না আসলে কীভাবে পরিচর্যা করতে হবে, নবজাতকদের এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিংয়ের (ইবিএফ) আওতায় আনা এবং নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ানোসহ নানা বিষয়ে মায়েদের বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন
বাজারে পাওয়া বিকল্প শিশুখাদ্য খাওয়াতে পরামর্শ দেওয়া হয় কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেক সময় মায়েদের বুকের দুধ দিতে সমস্যা হয়। এ সমস্যার মূল কারণটা বুঝে সে অনুযায়ী পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করি। কখনওই বাজারের বিকল্প দুধ বা শিশুখাদ্য খাওয়ানোর পরামর্শ দেই না।
আইন জানেন না বিক্রেতা
এদিকে, আইন সম্পর্কে না জেনেই ফার্মাসি ও দোকানে বিকল্প গুঁড়া দুধ ও ফর্মুলা দুধ বিক্রি করছেন সাধারণ দোকানি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সুপার শপগুলো।
জানা যায়, শিশুদের সুষম পুষ্টি নিশ্চিত করতে ১৯৮১ সালে জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য দেশগুলো মাতৃদুগ্ধের বিকল্প খাদ্য বিপণন নিয়ন্ত্রণে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে যা ‘ইন্টারন্যাশনাল কোড অব মার্কেটিং অব ব্রেস্টমিল্ক সাবস্টিটিউটস’ নামে পরিচিত। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে ‘মাতৃদুগ্ধ বিকল্প খাদ্য (বিপণনের নীতিমালা) আইন’ প্রণয়ন করা হয়। ২০১৩ সালের ২২ অক্টোবর আইনটি সংশোধন করা হয়। সংশোধিত আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি মাতৃদুগ্ধের বিকল্প শিশুখাদ্য, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত শিশুর বাড়তি খাদ্য বা তা ব্যবহারের সরঞ্জামাদির আমদানি, স্থানীয়ভাবে উৎপাদন, বিপণন, বিজ্ঞাপন মুদ্রণ, প্রদর্শন, প্রচার বা প্রকাশ করলে অথবা শিশু অসুস্থ বা মৃত্যু হলে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবেন।
এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় ফেনীর বড় বাজারের আল আকসা সুপার শপের স্বত্বাধিকারী মো. ফয়জুল্লাহর সঙ্গে। তিনি বলেন, এসব খাবারের চাহিদা আগে থেকে অনেক বেড়েছে। লাভ কম হলেও ক্রেতার চাহিদা বিবেচনা করে এগুলো বিক্রি করছি। তবে, এসব পণ্য প্রদর্শন বা বিক্রির জন্য কোনো আইন রয়েছে কি না, জানি না। কখনও এ ব্যাপারে কেউ কিছু বলেনি।
ফেনী মডেল থানা-সংলগ্ন পলাশ ফার্মার স্বত্বাধিকারী মো. পলাশ বলেন, ফার্মাসিতে বিকল্প খাদ্যগুলো সরাসরি বিক্রির বিধান নেই। সেজন্য পৌরসভা থেকে ফার্মাসির পাশাপাশি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের লাইসেন্স নিয়েছি। এতে ফার্মাসিতে শিশুখাদ্য বিক্রিতে আমার আইনি বাধা নেই। এখন অনেক সময় চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রেও শিশুখাদ্যের নাম লেখা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফেনীর একটি সুপার শপ কর্তৃপক্ষ ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিশুখাদ্য বিক্রির জন্য চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রের প্রয়োজন নেই। বাচ্চার বয়স জানালে সে অনুযায়ী বিকল্প শিশুখাদ্য প্রদান করা হয়। এ ছাড়া এসব শিশুখাদ্য চেতনানাশক ওষুধ বা মাদকদ্রব্যের আওতায় পড়ে না। সেজন্য ক্রেতাদেরও এসব ক্রয় করার অধিকার রয়েছে।
যা বলছেন সচেতন সমাজ
বাজারে অবাধে শিশুখাদ্য বিক্রি ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মতৎপরতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ফেনীর সমাজকর্মী নাজমুল হক শামীম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজারে বিকল্প শিশুখাদ্য এখন খুবই সহজলভ্য। কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পাড়ার দোকান থেকে শুরু করে ফার্মাসি বা সুপার শপ, সব জায়গায় এসব বিক্রি হচ্ছে। কিছু খাদ্য নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণের কথা থাকলেও তা কেউ মানছে না। আবার যাদের এসব দেখভাল করার কথা তাদেরও এটি নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই। সবমিলিয়ে আগামী প্রজন্মকে অভিভাবকরা টাকা খরচ করে বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলছেন।
একই প্রসঙ্গে ফেনী জেলা ন্যাশনাল চিলড্রেনস টাস্ক ফোর্সের (এনসিটিএফ) সাবেক সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সন্তানের ভালো করতে গিয়ে অভিভাবকরা এখন উল্টো বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। বিকল্প শিশুখাদ্যের বিষয়টি খুব একটা আলোচনায় আসে না। কিন্তু এটিই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নীরব মহামারি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি এখনই বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে তাহলে বড় একটি গোষ্ঠী উপকৃত হবে।
প্রশাসনের দায়সারা বক্তব্য
আইনানুযায়ী মাতৃদুগ্ধের বিকল্প হিসেবে কোনো প্রকার ফুড বা ফুড সাপ্লিমেন্ট সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন, বিক্রয় ও বিতরণ নিষিদ্ধ হলেও ফেনীতে তা মানছেন না কেউই। অন্যদিকে, এ আইনের প্রয়োগ ও তদারকির ব্যাপারে দায়সারা বক্তব্য দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ফেনী শহরের বিভিন্ন ফার্মাসি, মুদি দোকান, সুপার শপে আইনের তোয়াক্কা না করেই বিক্রি হচ্ছে মাতৃদুগ্ধের বিকল্প শিশুখাদ্যগুলো।
ফার্মাসিতে অবাধে শিশুখাদ্য বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মৌসুমী আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটি ওষুধ প্রশাসনের কাজ নয়। সরকারের অন্য বিভাগ এটি নিয়ে কাজ করছে।
একই সুরে কথা বলেন জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (অ. দা.) কাউছার মিয়া। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিকল্প শিশুখাদ্য সংক্রান্ত ২০১৩ সালের একটি আইন রয়েছে। তবে, এটি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের আওতায় না। এ আইনে জেলা প্রশাসন কাজ করছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফেনী জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ ধরনের শিশুখাদ্যের ব্যাপারে ওষুধ প্রশাসন ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে জরিমানার প্রয়োজন হলে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে সহযোগিতা করা হয়। তবে, সাম্প্রতিক সময়ের বন্যার কারণে জেলায় এ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, ফেনীতে বছরে প্রায় ৩০ কোটি টাকার ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রি হয়।
এমএআর/