জেনেভা ক্যাম্প, বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারিদের সবচেয়ে বড় আবাসস্থল। রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরে এটির অবস্থান। খুবই ঘিঞ্জি ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাটি সবার জন্য যেন বিস্ময়ের ‘বিস্ময়’। কী নেই সেখানে? আছে বিহারিদের নিরন্তর জীবনযুদ্ধ। ক্ষুদ্রশিল্পে তাদের দক্ষতা ঢাকা শহরজুড়ে প্রসিদ্ধ। আর ভোজনরসিকদের রসনাতৃপ্ত করতে আছে বাহারি সব কাবাব ও বিরিয়ানি হাউজ।

মোহাম্মদপুরের মাত্র ১৭ একর জায়গাজুড়ে অবস্থান জেনেভা ক্যাম্পের। এখানে ব্যাপক উদ্দীপনা ও প্রাণচাঞ্চল্যের চিত্র যেমন আছে, ঠিক এর উল্টোটা যেন ঘুটঘুটে অন্ধকারময়। বাংলাদেশ তথা ঢাকার জন্য বিষফোড়া হিসেবে বিবেচিত হয় স্থানটি। কারণ, এখানে বসে জমজমাট মাদকের হাট। সব ধরনের মাদকের পসরা বসে জেনেভা ক্যাম্পে। মাদক কেনা থেকে সেবন— সব যেন চলে নির্বিঘ্নে।

ঢাকাসহ সারা দেশে মাদক কারবারে জড়িত বড় বড় ডনের জন্ম এখানে। জেনেভা ক্যাম্প ঘিরে চলে তাদের আধিপত্যের লড়াই। আগে দেশীয় ধারাল অস্ত্র, লাঠিসোঁটা ও হকিস্টিক দিয়ে হতো লড়াই, এখন হয় আগ্নেয়াস্ত্রে। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ক্যাম্পের দখল কিংবা বেদখল ঠেকাতে আগ্রাসী হয়ে ওঠে ১১টি গ্যাং। এখানে পৌনে দুই মাসের সংঘাতে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন চারজন, আহত অর্ধশতাধিক

সরকার আসে, সরকার যায়; শুধু জেনেভা ক্যাম্প থেকে যায় স্বমহিমায়। দেশের সব স্থান থেকে মাদক নির্মূল করা সম্ভব হলেও ক্যাম্পটি থেকে যায় মাদক কারবারিদের দখলে।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) তথ্য অনুযায়ী, মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ৪৫নং ওয়ার্ডের অধীনে। এখানে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের বসবাস। ক্যাম্পটি দুই অংশে বিভক্ত। এক পাশে ব্লক ‘এ’ ও ‘বি’, অপর পাশে ‘সি’ থেকে ‘আই’ পর্যন্ত সাতটি ব্লক। সবচেয়ে বড় ব্লক ‘সি’, সবচেয়ে ছোট  ‘আই’। ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি (আইসিআরসি) বিদায় নিলে ক্যাম্পটির দায়িত্ব নেয় বাংলাদেশ সরকার ও বিডিআরএস (বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি)। ১৯৭৫ সালে ক্যাম্পের দায়দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে আসে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৩ সালে হাইকোর্টের এক রায়ে ১৯৭১ সালের পরে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের বিহারিরা ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। পরবর্তীতে দেওয়া হয় জাতীয় পরিচয়পত্র। নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকারপ্রাপ্তির পরই জেনেভা ক্যাম্পকেন্দ্রিক মূল সমস্যা শুরু হয়। রাজনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তার, রাজনৈতিক দমন-পীড়নে ভাড়াটে হিসেবে যেমন বিহারিদের ব্যবহার করা হয়, তেমনি মাদক কারবারের হাব (কেন্দ্র) হিসেবে ব্যবহৃত হয় ক্যাম্পটি।

সরকারি হিসেবে ২১ হাজার হলেও বসবাস ৩০ হাজার

সরকারের সর্বশেষ সার্ভে অনুযায়ী, জেনেভা ক্যাম্পে পরিবারের সংখ্যা পাঁচ হাজার ৭২৫, জনসংখ্যা ২১ হাজার ৯১ জন। এর মধ্যে ১৩ হাজার ৬১৪ জন প্রাপ্ত বয়স্ক। শিশুর সংখ্যা সাত হাজার ৪৭৭ জন। ১০ হাজার ৮৫৪ জনের রয়েছে বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র। এখানে কাগজে-কলমে মাত্র ৩২৫ জন বাঙালির বসবাস বলা হলেও তা সংখ্যায় দুই হাজারের বেশি। সবমিলিয়ে ১৭ একরের এ ভূমিতে সরকারি হিসাবের বাইরে বসবাস প্রায় অর্ধলাখ উর্দুভাষী পাকিস্তানির।

সরেজমিনে জেনেভা ক্যাম্প ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ ঘর খুপরি বা গোডাউনের মতো। অনেকগুলো আবার দোতলা-তিনতলা-চারতলা। অপরিকল্পিতভাবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পাকা বাড়িগুলো ওপরের দিকে উঠে গেছে। দিন-রাত কর্মমুখর জেনেভা ক্যাম্পের গলিগুলো এতই সরু যে একজন মানুষের হাঁটতেই কষ্ট হয়। গলির ভেতর আরও আঁকাবাঁকা সরু একাধিক গলি। আট ফুট বাই আট ফুটের সাড়ে তিন হাজার কক্ষ।

বিহারিদের ক্ষুদ্রশিল্প, মোস্তাকিমের কাবাব ও বোবার বিরিয়ানির জনপ্রিয়তা ছাপিয়ে জেনেভা ক্যাম্পের বড় বিস্ময়, বছরের পর বছর এখানে বহাল আছে মাদকের কারবার। সরকারের পর সরকার বদল হচ্ছে, হচ্ছে আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণের বদল; শুধু থেকে যাচ্ছে মাদকের কারবার।

সারা দেশে মাদক কারবারের অন্যতম হাব হিসেবে ব্যবহৃত হয় রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরে অবস্থিত জেনেভা ক্যাম্প / ফাইল ছবি 

ক্যাম্প ঘিরে বছরে ১৫০ কোটি টাকার লেনদেন

“বছরে অন্তত ১৫০ কোটি টাকার মাদক বিক্রি হয় জেনেভা ক্যাম্পে। ফলে এটি এখন অনেকের কাছে ‘মধুর হাঁড়ি’র মতো। মাদকের কারবার নিয়ন্ত্রণে লড়াই-সংগ্রাম চলে অবিরত”— বলেন জাহিদ ওরফে ডিলার জাহিদ। এ মাদক কারবারি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আগে এ জেনেভা ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ করত নাদিম ওরফে পঁচিশ ও ইশতিয়াক। ২০১৮ সালে র‍্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নাদিম নিহত হন। দুই বছর পর জানা যায়, ভারতে পলাতক অবস্থায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান ইশতিয়াক। এখন ১১/১২টি গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করছে জেনেভা ক্যাম্প।’

শূন্যস্থান দখলে মরিয়া ১১ গ্যাং

ঢাকাসহ সারা দেশে মাদক কারবারে জড়িত বড় বড় ডনের জন্ম এখানে। জেনেভা ক্যাম্প ঘিরে চলে তাদের আধিপত্যের লড়াই। আগে দেশীয় ধারাল অস্ত্র, লাঠিসোঁটা ও হকিস্টিক দিয়ে হতো লড়াই, এখন হয় আগ্নেয়াস্ত্রে। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ক্যাম্পের দখল কিংবা বেদখল ঠেকাতে আগ্রাসী হয়ে ওঠে ১১টি গ্যাং। এখানে পৌনে দুই মাসের সংঘাতে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন চারজন, আহত অর্ধশতাধিক।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেনেভা ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে সক্রিয় অন্তত ১১টি মাদক কারবারি গ্যাং। তারা হলো- ভূঁইয়া সোহেল গ্যাং, সৈয়দপুরিয়া গ্যাং, আরমান গ্যাং, ছটু/ছটা মাসুদ রানা গ্যাং, মনু গ্যাং, চারকু গ্যাং, কোপ-মনু গ্যাং, রাজু গ্যাং, কামাল বিরিয়ানি গ্যাং, চুয়া সেলিম গ্যাং ও পলু কসাই গ্যাং।

সৈয়দপুরিয়া গ্যাংয়ের অধিকাংশই নারী সদস্য। তাদের অন্যতম বিউটি। মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের করা অন্তত তিনটি মাদক মামলার আসামি তিনি। তবে, ধরা পড়েছেন মাত্র একবার। তিনি ঢাকা পোস্টকে জানান, গত ৫ আগস্টের পর পৌনে দুই মাসে ৫৫ লাখ টাকার মাদক কেনাবেচায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন। জেনেভা ক্যাম্পে এখন চারটি গ্রুপ (গ্যাং) খুবই আধিপত্য বিস্তার করছে। তারা হলো- ভূঁইয়া সোহেল গ্যাং, সৈয়দপুরিয়া গ্যাং, ছটু/ছটা মাসুদ রানা গ্যাং ও চুয়া সেলিম গ্যাং।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেনেভা ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে সক্রিয় অন্তত ১১টি মাদক কারবারি গ্যাং। তারা হলো- ভূঁইয়া সোহেল গ্যাং, সৈয়দপুরিয়া গ্যাং, আরমান গ্যাং, ছটু/ছটা মাসুদ রানা গ্যাং, মনু গ্যাং, চারকু গ্যাং, কোপ-মনু গ্যাং, রাজু গ্যাং, কামাল বিরিয়ানি গ্যাং, চুয়া সেলিম গ্যাং ও পলু কসাই গ্যাং

ধরা পড়ে চুনোপুঁটি, শীর্ষ কারবারিরা আড়ালে

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শীর্ষ মাদক কারবারিদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ভূঁইয়া সোহেল ওরফে বুনিয়া সোহেল। তার হয়ে কাজ করেন তার ভাই টুনটুন, রানা, রাজন ওরফে কালু, কলিম জাম্বু, মোহাম্মদ আলী, আহম্মদ আলী ও বানর আরিফ।

চুয়া সেলিম গ্যাংয়ের সদস্যরা হলেন- মোল্লা আরশাদ, পেলু আরমান, কোপ মনু, আকরাম ও গেইল হীরা। সহযোগী হিসেবে আছেন উল্টা সালাম, শান্ত, পিচ্চি রাজা, ফাট্টা আবিদ, পিস্তল নাঈম ও শাহজাদা।

সৈয়দপুরিয়া গ্যাংয়ের সদস্যরা হলেন- বাবু ওরফে আমজাদ আলী বাবু ও তার ভাই আলতাফ, তিল্লি শাহিদ ও তার ভাগনে ইরফান বিরিয়ানি, বাবা কামাল বিরিয়ানি, মোল্লা জাহিদ ও সাজ্জাদ।

র‌্যাবের অভিযানে জেনেভা ক্যাম্প থেকে আটক মাদক কারবারিরা / ফাইল ছবি

সপরিবারে মাদক কারবারে অনেকে

জেনেভা ক্যাম্পের পাশাপাশি কৃষি মার্কেট ক্যাম্প ও সেন্টার কমিটি ক্যাম্পে মাদক কারবারের প্রধান মাফিয়া এরশাদ ওরফে ডিলার সোনারু এরশাদ (৩৮)। ক্যাম্পের এ ব্লকে রংপুর আয়ান অটোমোবাইল সার্ভিসিংয়ের আড়ালে তিনি হেরোইন, ইয়াবা ও ফেনসিডিলের রমরমা ব্যবসা চালিয়ে আসছেন। আর মাদক মজুত রাখেন হুমায়ুন রোডের বাসায়। বছরখানেক আগে একবার ডিবি পুলিশের হাতে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হওয়া সোনারু এরশাদ এখন আছেন বহাল তবিয়তে।

অভিযোগ আছে, তার আট ভাই ও দুই বোন মাদক কারবারে জড়িত। এক ভাই মাদক সেবন করে মারা গেছেন। বাকিরা কেউ পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি, ডিএনসি বা এসবির সোর্স হিসেবে পরিচয় দেন। তবে তারা হোন্ডা সার্ভিসের দোকান, বোবা বিরিয়ানি ও স্বর্ণের ব্যবসার আড়ালে হেরোইন, ইয়াবা ও ফেনসিডিলের কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন।

পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) সূত্রে জানা যায়, কিছুদিন আগে সোনারু এরশাদের শ্বশুর ইসমাইল ওরফে ভিসিয়ার ইসমাইল (৫৭) ও শাশুড়ি রাজিয়া বেগম পৃথক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার হন। মোহাম্মদপুর থানার শীর্ষ মাদক কারবারিদের অন্যতম সোনারু এরশাদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত শীর্ষ মাদক কারবারিদের তালিকায় ৭৫২ নম্বরে আছেন। তার নামে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় একাধিক মাদক মামলা রয়েছে।

এ ছাড়া ভূঁইয়া সোহেল ওরফে বুনিয়া সোহেল, চুয়া সেলিম, সৈয়দপুরিয়া গ্রুপের বাবু ওরফে আমজাদ আলী বাবু, আসলাম ওরফে মেন্টাল আসলাম ও শেখ গোলাম জিলানি মূলত পারিবারিকভাবে ইয়াবা ও হেরোইনের কারবারে জড়িত।

জেনেভা ক্যাম্পের পাশাপাশি কৃষি মার্কেট ক্যাম্প ও সেন্টার কমিটি ক্যাম্পে মাদক কারবারের প্রধান মাফিয়া এরশাদ ওরফে ডিলার সোনারু এরশাদ (৩৮)। ক্যাম্পের এ ব্লকে রংপুর আয়ান অটোমোবাইল সার্ভিসিংয়ের আড়ালে তিনি হেরোইন, ইয়াবা ও ফেনসিডিলের রমরমা ব্যবসা চালিয়ে আসছেন। আর মাদক মজুত রাখেন হুমায়ুন রোডের বাসায়। বছরখানেক আগে একবার ডিবি পুলিশের হাতে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হওয়া সোনারু এরশাদ এখন আছেন বহাল তবিয়তে

কারবার ভেতরে, কারবারিদের বসবাস বাইরে

পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ কর্তৃক জমা দেওয়া গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী, জেনেভা ক্যাম্পের বড় বড় মাদক কারবারিরা ক্যাম্পের বাইরে বসবাস করেন। কিন্তু তাদের মাদকের কার্যক্রম চলে ক্যাম্পে। মূলত কারবারিদের মধ্যে মাদক ডিলিংস ও আনা-নেওয়ার কাজ করেন তারা। এ জন্য মাসোহারা দেওয়া হয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, কাউন্সিলর, মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানা পুলিশকে।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগসাজশের কারণে বিগত বছরগুলোতে ক্যাম্পে শক্ত অবস্থান ছিল সোহেলের। ঢাকা-১৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচিত বিপ্লব ও জয়নাল আবেদীন জয় এ চক্রকে সহায়তা করতেন। বিনিময়ে বিপ্লব প্রতিদিন পাঁচ হাজার টাকা পেতেন। এ ছাড়া নানকের ‘ঘনিষ্ঠজন’ হিসেবে পরিচিত স্থানীয় ৩২ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগনেতা মো. আরমানও নানাভাবে সোহেলকে সহায়তা করতেন।

অন্যদিকে, চুয়া সেলিম চক্র রাজত্ব করে মূলত বিএনপির আমলে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ফের আধিপত্য বিস্তারে নেমেছে চুয়া সেলিম। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বেকায়দায় পড়লেও চুয়া সেলিম বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের সাধারণ সম্পাদক তামজিদ বিন রহমান তূর্যের সহায়তায় চালিয়ে যান মাদকের কারবার।

ধরা পড়ে চুনোপুঁটি, শীর্ষ মাদক কারবারিরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে- বলছেন সংশ্লিষ্টরা / ফাইল ছবি

শীর্ষদের তালিকায় জেনেভা ক্যাম্পের মাত্র পাঁচজন

সম্প্রতি বিভাগওয়ারি ৮৩ শীর্ষ মাদক কারবারির তালিকা করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। কাগজে-কলমে মাদক কারবার ও মাদকসহ ধরা পড়া দেড় হাজারের বেশি বিহারি আসামি হলেও শীর্ষ মাদক কারবারিদের তালিকায় রয়েছে মাত্র পাঁচজনের নাম। তারা হলেন- মো. সোহেল ওরফে ভূইঁয়া সোহেল, মো. সেলিম ওরফে সেলিম, মো. কালু ওরফে দাঁতভাঙ্গা কালু, মো. হীরা ও জাহাঙ্গীর হোসেন। এর মধ্যে দুজনের ঠিকানা দেওয়া আছে জেনেভা ক্যাম্প। তবে, আরও তিনজনের নাম শীর্ষ মাদক কারবারিদের তালিকাভুক্ত রয়েছে। যাদের বসবাসের ঠিকানা মোহাম্মদপুর বলা হলেও মূলত তাদের কারবার জেনেভা ক্যাম্পঘিরে। তারা হলেন- মো. কালু ওরফে দাঁতভাঙ্গা কালু, মো. হীরা ও জাহাঙ্গীর হোসেন। 

জেনেভা ক্যাম্প কেন মাদকের হাব

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাদক উদ্ধার, হতাহতের ঘটনায় গ্রেপ্তার কারবারিরা জামিনে বের হয়ে আসছেন। অথচ তাদের ওপর কোনো নজরদারি নেই।

স্থানীয় বাঙালি ও মাদকবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত আফজাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা চতুর্মুখী। হরহামেশা নানা ধরনের গাড়ি ঢোকে। কিন্তু কোথাও কোনো স্থায়ী চেকপোস্ট নেই। চিহ্নিত মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে আছে অনেক মামলা। অথচ তাদের গ্রেপ্তারে উদ্যোগ বলা যায় শূন্য। শুধু গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর কয়েকদিন তোড়জোড় শুরু হয়। এরপর বানরের পিঠা ভাগাভাগির মতো চলে মাদকের কারবার। পুলিশ কিংবা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) ভূমিকাও দৃশ্যমান নয়। মাঝেমধ্যে র‌্যাব এসে বাগড়া দেয়। সেই খবরও আগে পৌঁছে যায় কারবারিদের কাছে।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগসাজশের কারণে বিগত বছরগুলোতে ক্যাম্পে শক্ত অবস্থান ছিল সোহেলের। ঢাকা-১৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচিত বিপ্লব ও জয়নাল আবেদীন জয় এ চক্রকে সহায়তা করতেন। বিনিময়ে বিপ্লব প্রতিদিন পাঁচ হাজার টাকা পেতেন। এ ছাড়া নানকের ‘ঘনিষ্ঠজন’ হিসেবে পরিচিত স্থানীয় ৩২ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগনেতা মো. আরমানও নানাভাবে সোহেলকে সহায়তা করতেন

ক্যাম্পের এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেনেভা ক্যাম্পের নন-লোকাল রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান এস কে গোলাম জিলানীর বিরুদ্ধেও রয়েছে মাদক-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ। তিনি সরাসরি মাদক কারবারে সামনে না এলেও গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের ছাড়িয়ে নিতে তদবির করেন। তার ছেলে, ভাইসহ পরিবারের চারজন মাদক কারবারে যুক্ত। এর আগে গ্রেপ্তারও হয়েছেন তার দুই ছেলে। সরকার পতনের পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান।

স্থানীয় ৩২নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নূর ইসলাম রাষ্টন মোটা অঙ্কের মাসোহারা নিয়ে মাদক কারবার একরকম প্রকাশ্যে এনেছেন বলে অভিযোগ তার।

ক্যাম্পে ঢুকতে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন গোয়েন্দারা

জেনেভা ক্যাম্পকেন্দ্রিক মাদক কারবার নজরদারিতে রাখেন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ, ডিবি পুলিশ, এনএসআই ও র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা।

ক্যাম্পে নজরদারির দায়িত্বে থাকা একটি গোয়েন্দা শাখার উপ-পরিদর্শক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্যাম্পের অবস্থা আগের তুলনায় খারাপ। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর এখানকার হালচাল বোঝা মুশকিল হয়ে পড়েছে। প্রতি রাতেই কম-বেশি গোলাগুলি ও হতাহতের ঘটনা ঘটছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতনদের জানানো হয়েছে। ভেতরে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে সাঁড়াশি অভিযান ছাড়া নিজেরাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।

সম্প্রতি জেনেভা ক্যাম্পে সেনাবাহিনী, র‌্যাব ও পুলিশের যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হয় / ফাইল ছবি

মুখে কুলুপ বিহারি সংগঠনের নেতাদের

সাক্ষাতে ও মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও বক্তব্য মেলেনি বাংলাদেশে বসবাসকারী উর্দুভাষী অবাঙালিদের সংগঠন স্ট্রান্ড্রেড পাকিস্তানিজ জেনারেল রিপেট্রিয়েশন কমিটির (এসপিজিআরসি) নেতাদের। ক্যাম্পের নন-লোকাল রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান এস কে গোলাম জিলানীর সঙ্গে যোগাযোগ করা গেলেও তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এসপিজিআরসি সভাপতি শওকত আলী ও সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশীদের মোবাইল নম্বর খোলা পাওয়া গেলেও কেউ কথা বলতে চাননি। বরং সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর কেটে দেন কল।

যা বলছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) পরিচালক (অপারেশনস ও গোয়েন্দা) অতিরিক্ত ডিআইজি তানভীর মমতাজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্যাম্প এলাকায় প্রায়ই অভিযান চালানো হচ্ছে। সম্প্রতি তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক কারবারি কালুসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তালিকা ধরে এবং মাদক মামলায় পলাতকদের গ্রেপ্তারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে। যাকেই পাওয়া যাবে তাকেই গ্রেপ্তার করা হবে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ রুহুল কবির খান ঢাকা পোস্ট বলেন, মাদক কারবারিদের ওপর নজরদারি রাখতে এবং তাদের গ্রেপ্তার করতে ক্যাম্পের বাইরে চেকপোস্ট বসানো আছে। নিয়মিত অভিযানও চালানো হচ্ছে। সম্প্রতি ক্যাম্পে সেনাবাহিনী, র‌্যাব ও পুলিশের যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। একটি বিষয় আমরা নিশ্চিত হয়েছি, চিহ্নিত বা তালিকাভুক্ত অধিকাংশ মাদক কারবারির বসবাস ক্যাম্পের বাইরে।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাদক ও অস্ত্র উদ্ধারে র‌্যাবের তৎপরতা ও গোয়েন্দা নজরদারি চলমান। এটি এখন বাড়ানো হয়েছে। জেনেভা ক্যাম্পকেন্দ্রিক আমাদের গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। যৌথ অভিযানও পরিচালনা করা হচ্ছে। অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হবে।

জেইউ/