জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক সংকটে বাংলাদেশকে ভাবাচ্ছে অসময়ের বন্যা। এটি বাংলাদেশের জন্য নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বদ্বীপ অঞ্চল হিসেবে ভৌগলিক অবস্থার কারণে এমনিতেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। এর সঙ্গে নদীর নাব্যতা সংকট ও প্রকৃতির স্বাভাবিক সার্কেল ভেঙে যাওয়ায় উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে।
 
এদিকে, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে আকস্মিক ও দীর্ঘ সময়ের বন্যা মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইকোনমিক্স এর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র ২০২২ সালের বন্যায় দেশে এক বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া ৭ দশমিক ৩ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। হঠাৎ বা দীর্ঘ সময়ের বন্যায় প্রতি বছর বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় ৫৫-৬০ শতাংশ অঞ্চল জলমগ্ন হয়। দেশের এ বন্যা পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় জুলাই মাসে। তবে, এ বছর বৃষ্টির পরিমাণ অন্য বছরের তুলনায় বেশি হয়েছে। ফলে এ মৌসুমে দেশের বিভিন্ন স্থানে স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদি বন্যা হয়েছে। কিন্তু জুলাই মাসের পর অতিবৃষ্টির কারণে মৌসুম ছাড়াই দীর্ঘমেয়াদি বন্যা হয়েছে। বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময়ের বন্যা দেশের জন্য বড় চিন্তার কারণ, যা আশঙ্কাজনক।

আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে দেশে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বৃষ্টি হয়েছে। তবে, দেশে যে বৃষ্টিপাত হয়, তা থেকে সৃষ্ট বন্যার প্রভাব কম। বন্যার আসল কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন। কারণ, দেশের নদীগুলোর উৎপত্তিস্থল ভারত, মিয়ানমার ও নেপাল। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে উষ্ণতা বাড়ছে। ফলে হিমালয়ের বরফ স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি গলছে। আবার ভারত ও মিয়ানমারে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়েছে। ফলে আমাদের দেশে ঘনঘন বন্যা হচ্ছে।’ 

‘জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতির স্বাভাবিক সার্কেল ভেঙে গেছে। ভারতের চেরাপুঞ্জি ও মেঘালয়ে এবার ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হয়েছে। ফলে এ পানির চাপ আমাদের এখানেও এসেছে।’ 

জলবায়ু অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ এম জাকির হোসাইন খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বন্যা আমাদের দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি করছে। এ ছাড়া বন্যা কখন হতে পারে, পানি কি পরিমাণ হতে পারে, পানি কোন চ্যানেল দিয়ে আসবে— এসব তথ্য যথাযথভাবে আমরা পাচ্ছি না। ভারত কোন সময় পানি ছাড়বে, এ নিয়ে যৌথ নদী কমিশনও কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না।’ 

বন্যা ব্যবস্থাপনায় আধুনিক চিন্তার পরামর্শ দিয়ে এ জলবায়ু বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমরা এখনও আদিকালের মতো বন্যা ব্যবস্থাপনা করছি। শুধু ত্রাণ দিয়ে বন্যা ব্যবস্থাপনা হবে না। বন্যার কারণগুলো বের করে সেগুলো বন্ধে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। এ ছাড়া বন্যার পর কৃষি ও মৎস্য অধিদপ্তর এবং এলজিইডিকে দ্রুত কাজ করতে হবে।’ 

বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় জুলাই মাসে। তবে, এ বছর বৃষ্টির পরিমাণ অন্য বছরের তুলনায় বেশি হয়েছে। ফলে এ মৌসুমে দেশের বিভিন্ন স্থানে স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদি বন্যা হয়েছে। কিন্তু জুলাই মাসের পর অতিবৃষ্টির কারণে মৌসুম ছাড়াই দীর্ঘমেয়াদি বন্যা হয়েছে। বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময়ের বন্যা দেশের জন্য বড় চিন্তার কারণ, যা আশঙ্কাজনক

‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এখন নতুন ঝুঁকি আসছে। এর মধ্যে রয়েছে অধিক বৃষ্টি, নদী ভাঙন, দীর্ঘদিন পানি জমে থাকা। এ জন্য সুন্দর ও বিন্যস্ত পরিকল্পনা দরকার।’

ঘূর্ণিঝড় ও উপকূলীয় ঝুঁকি বেড়েছে 

অসময়ের বন্যার সঙ্গে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে ঘূর্ণিঝড়। এতে উপকূলীয় এলাকায় ঝুঁকি বাড়ছে। গবেষণা বলছে, বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি ঝড়ের পরিবর্তিত ভয়াল রূপ দেখছেন উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দারা। বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় সিডর (২০০৭), আইলা (২০০৯), আম্পান (২০২০) ও রেমাল (২০২৪) জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আরও বিধ্বংসী হয়ে উঠছে।

এ ছাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে প্লাবন ও লবণাক্ততা বাড়ছে। যা কৃষি ও পানীয় জলের (মিঠা পানি) সংকট তৈরি করছে।

ইউনিসেফ বলছে, ঘূর্ণিঝড় রেমালসহ চলতি বছর বাংলাদেশে জরুরি পরিস্থিতিতে ৫০ লাখ শিশুসহ এক কোটি ৩০ লাখ মানুষের জীবন ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এমন পরিস্থিতিতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও বাংলাদেশের শিশুদের ভবিষ্যৎ রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে তারা।

তাপমাত্রা-খরা ও নদী ভাঙন বেড়েছে

তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও খরার কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। যা খাদ্য নিরাপত্তায় প্রভাব ফেলছে। আবার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু ঝুঁকির বহুমুখী সর্বনাশের কবলে বাংলাদেশ।  

তাদের মতে, তাপমাত্রা-খরা ও নদী ভাঙন— এ তিন চক্রের কবলে পড়ে উপকূলীয় এলাকা খুলনা, বরগুনা, সাতক্ষীরা ও পটুয়াখালী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে বাসস্থান হারানো, কৃষি জমি প্লাবিত হওয়া এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধির সমস্যাও তৈরি হচ্ছে। 

দুর্যোগ বাড়লেও বাজেটে জলবায়ু নিয়ে বরাদ্দ কম 

তীব্র দাবদাহ, শৈত্যপ্রবাহ ও মৌসুমের বাইরে বৃষ্টিপাতসহ বিভিন্ন দুর্যোগ বাড়লেও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে জলবায়ু বরাদ্দ অপ্রতুল বলে দাবি করেছেন পরিবেশবাদীরা। একইসঙ্গে বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের প্রকৃত বরাদ্দ উল্টো ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ কমেছে।

পরিবেশবাদী সংগঠন চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ-এর প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান বলেন, ‘২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে জলবায়ুর জন্য বরাদ্দ জিডিপির ১ শতাংশের কম। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় এবং মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় ২ দশমিক ৩৫ শতাংশেরও কম। অথচ জলবায়ু সহনীয়তা ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিতে বাজেটে জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ ব্যয় করা প্রয়োজন।’


 
‘২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় এবারের বাজেটে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ ৫২ কোটি টাকা বেড়েছে। কিন্তু বিদ্যমান মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় প্রকৃত বরাদ্দ কমেছে। দুর্যোগ বাড়লেও কৃষি, স্বাস্থ্য ও পানি সম্পদ খাতে জলবায়ু সম্পর্কিত বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেক বা তার সামান্য বেশি।’ 

জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে ঘূর্ণিঝড় রেমালে ২০ জেলায় তিন লাখ ৮৩ হাজার ৮১৫ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ভবিষ্যতে এমন দুর্যোগ আরও ভয়াবহ হতে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হারে বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ, যা উদ্বেগজনক। প্রতি বছর ৩ দশমিক ৪২ মিলিমিটারের বেশি হারে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে।’

এমন অবস্থায় জল, বন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে ২০২৫ সালের মধ্যে প্রকৃতিভিত্তিক টেকসই সমৃদ্ধি কৌশলপত্র প্রণয়ন করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
 
আরএইচটি/এমএসএ