বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর গুলি, হত্যার নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার হতে যাচ্ছে। এই বিচার কার্যক্রম সামনে রেখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশন সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়েছে। চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে প্রসিকিউশন সংস্থা এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। এ ছাড়া সাবেক অ্যাডিশনাল ডিআইজি মাজহারুল হককে কো-অর্ডিনেটর করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ১০ সদস্যের তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়েছে।

ট্রাইব্যুনালের তদন্ত ও প্রসিকিউশন সংস্থায় গত বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত হত্যা-গণহত্যার ২৮টি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এগুলোতে আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিপরিষদের প্রভাবশালী সদস্যদের। এ ছাড়া গণহত্যার নির্দেশদাতা ও গণহত্যায় অংশ নেওয়া পুলিশ কর্মকর্তা এবং গণহত্যায় উসকানিদাতা সাংবাদিকদেরও নাম আছে এ তালিকায়। চলতি সপ্তাহেই বিচারক নিয়োগ দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য এই ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হবে বলে জানা গেছে। এরপর শুরু হবে আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রেক্ষাপট

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ। মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার পর গত ১৪ বছরে ট্রাইব্যুনাল ৫৫টি মামলার রায় দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে বেশ কয়েকজনের দণ্ডও কার্যকর হয়েছে।

গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। এরপর দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান তিনি। গত ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরপর ১৪ আগস্ট সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল জানান, গত ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোর বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা হবে।

যে আইনে হবে বিচার

১৯৭৩ সালে প্রণীত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীনেই শেখ হাসিনাসহ অভিযুক্তদের তদন্ত ও বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মূলত ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্যই আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল। এ আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতের নেতাদের বিচার করা হয়েছে।

১৯৭৩ সালে প্রণীত আইনের ৩ (১) ধারায় বলা আছে, আইনের ২নং উপ-ধারায় উল্লিখিত যেকোনো অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা সংস্থা বা কোনো সশস্ত্র, প্রতিরক্ষা বা সহায়ক বাহিনীর কোনো সদস্যের জাতীয়তা যাই হোক না কেন, তা যদি এই আইন প্রবর্তনের আগে বা পরে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সংঘটিত হয়, তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিচার এবং শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা থাকবে।

অর্থাৎ মানবতাবিরোধী অপরাধ, শান্তিবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, জেনেভা কনভেনশনবিরোধী কাজসহ আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে যেকোনো অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা দল, সেনাবাহিনী কিংবা তাদের সহযোগী সশস্ত্র বাহিনীর বিচারের ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালকে দেওয়া হয়েছে।

যে প্রক্রিয়ায় এগোবে বিচার

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রসিকিউটর (প্রশাসন) গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম। সার্বিক বিষয়ে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করার দুটি পদ্ধতি আছে। একটি হলো সরাসরি তদন্ত সংস্থায় কোনো অভিযোগ দায়ের করা। এটা কোনো আইনজীবীও করতে পারেন অথবা কোনো জ্ঞাত ব্যক্তি, যিনি ঘটনা সম্পর্কে জানেন। আর আমরা প্রসিকিউটর নিয়োগ হওয়ার পরে আরেকটি পথ ওপেন করেছি, সেটি হচ্ছে প্রসিকিউশন সংস্থায় কেউ চাইলে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। তদন্ত সংস্থায় বা প্রসিকিউশনে দাখিল করা অভিযোগগুলো তদন্ত সংস্থার অধীনে প্রসিকিউশনের তত্ত্বাবধানে তদন্ত হবে। এই তদন্ত কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর তদন্ত সংস্থা একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে চিফ প্রসিকিউটর বরাবর। চিফ প্রসিকিউটর এই তদন্ত প্রতিবেদনকে একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ, যেটাকে আমরা আইনের ভাষায় বলি ফরমাল চার্জ। ফরমাল চার্জ আকারে চিফ প্রসিকিউটর ট্রাইব্যুনাল বরাবর দাখিল করবেন। তখন ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা ফরমাল চার্জ শুনানির দিন ধার্য করবেন। ট্রাইব্যুনাল যদি ফরমাল চার্জের ভেতরে যে তথ্য-উপাত্ত দেওয়া আছে, সাক্ষীদের নাম দেওয়া আছে তা সঠিক বলে মনে করেন তাহলে ট্রাইব্যুনাল ওই অভিযোগ আমলে নেবেন। অর্থাৎ আসামিদের বিরুদ্ধে যেসব অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে তা আমলে নেবেন। আমলে নিয়ে একটি অভিযোগ গঠনের দিন ধার্য করবেন, যেটাকে আমরা বলি চার্জ হেয়ারিং।

‘ট্রাইব্যুনালে চার্জ হেয়ারিং হবে। সেখানে বাদীপক্ষ, আসামিপক্ষ শুনানি করবেন। বাদীপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের আবেদন জানাবেন। আসামিপক্ষ চার্জ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার আবেদন জানাবেন। দুই পক্ষের শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল যদি অভিযোগের সত্যতা প্রাথমিকভাবে পেয়ে থাকেন তখন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করবেন। অথবা যদি আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অসত্য প্রমাণিত হয় তাহলে আসামিদের অব্যাহতি দিতে পারেন। যদি অব্যাহতি দেন তাহলে ওখানেই মামলা শেষ। আর যদি অভিযোগ গঠন করেন তখন ট্রাইব্যুনাল সাক্ষীদের ডাকবেন সাক্ষ্য দিতে। তারপর ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য প্রদান হবে। আসামিপক্ষ সাক্ষীদের জেরা করবেন। আসামিপক্ষও সাক্ষ্য প্রদানের সুযোগ পাবেন। আসামিপক্ষ তাদের পক্ষে সাফাই সাক্ষী দেওয়ার সুযোগ পাবেন। সাফাই সাক্ষ্য শেষে ট্রাইব্যুনাল যুক্তিতর্কের দিন ধার্য করবেন। উভয়পক্ষ সেখানে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবেন। যুক্তিতর্ক শেষে ট্রাইব্যুনাল একটি রায়ের দিন ধার্য করবেন। তারপর রায় প্রদান করবেন।’

তদন্ত শুরু হলেই আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন

প্রসিকিউটর (প্রশাসন) গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত চলাকালে তদন্ত সংস্থা যদি মনে করে, যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ আনা হয়েছে সেসব ব্যক্তি তদন্তকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেন, তদন্তকে প্রভাবিত করতে পারেন বা পালিয়ে যেতে পারেন– এগুলো যদি তদন্ত সংস্থা বা প্রসিকিউশনের কাছে মনে হয়, তাহলে তদন্ত চলাকালে ট্রাইব্যুনাল বরাবর গ্রেপ্তারি পরওয়ানা জারির আবেদন করতে পারে। আমরা দেখেছি ট্রাইব্যুনালে ৯০ শতাংশ মামলাতে তদন্ত চলাকালীন অবস্থায় বা তদন্ত শুরুর কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পরেই আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরওয়ানা জারি করা হয়। আর কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়। সেটা খুবই সামান্য। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার নজির আছে।

জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত হত্যা-গণহত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালে ২৮টি অভিযোগ জমা পড়েছে। সব আবেদনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম রয়েছে। আইনের বিধান অনুযায়ী তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন সংস্থার পর্যালোচনায় যাদের মূল আসামি মনে হবে, তাদের নাম ট্রাইব্যুনালে পেশ করা হবে। বাদীপক্ষ যেটা নিয়ে এসেছেন পর্যালোচনা করে তার সঙ্গে সংযোজন-বিয়োজন হতে পারে। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর যেটা দাখিল করব, সেটাই হবে প্রপার মামলা। ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ শুরু হওয়া মাত্র আমরা এ বিষয়ে যথাযথ আবেদন করব।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টকে কেন্দ্র করে সারাদেশে যেসব হত্যা মামলা হয়েছে, সেগুলো একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালে আনা হবে।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন সংস্থা পুনর্গঠন

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবীরা গত আগস্ট মাসে পদত্যাগ করেন। গত ৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনার জন্য প্রসিকিউটর নিয়োগের কথা জানিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সলিসিটর অনুবিভাগ। ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ তাজুল ইসলামকে নিয়োগ দেওয়া হয়। আইনজীবী মো. মিজানুল ইসলাম, গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম, বি এম সুলতান মাহমুদ ও আবদুল্লাহ আল নোমানকে প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অচিরেই ট্রাইব্যুনালে আরও প্রসিকিউটর নিয়োগ দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।

১০ সদস্যের তদন্ত সংস্থা গঠন, সমন্বয়ক মাজহারুল হক

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যা-গণহত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত পরিচালনার উদ্দেশ্যে ১০ কর্মকর্তার সমন্বয়ে তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়েছে। তাদের মধ্যে তদন্ত সংস্থায় কো-অর্ডিনেটর পদে মো. মাজহারুল হককে (অ্যাডিশনাল ডিআইজি, অবসরপ্রাপ্ত) এবং কো-কোঅর্ডিনেটর পদে মুহাম্মদ শহিদুল্যাহ চৌধুরীকে (পুলিশ সুপার, অবসরপ্রাপ্ত) যোগদানের তারিখ থেকে পরবর্তী দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে গত ১৮ আগস্ট এ সংক্রান্ত পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন এবং জনবল নিয়োগ, অন্তর্ভুক্তকরণ ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিষয়ে ইতোপূর্বে জারি করা প্রজ্ঞাপনগুলো বাতিল বলে গণ্য হবে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।

তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট, ১৯৭৩–এর ধারা ৮ (১)–এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ওই আইনের ৩ ধারায় বর্ণিত অপরাধগুলোর তদন্ত পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত তদন্ত সংস্থা নিম্নবর্ণিত কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে পুনর্গঠন করা হলো। ১০ কর্মকর্তা হলেন– মো. মাজহারুল হক (অ্যাডিশনাল ডিআইজি, অবসরপ্রাপ্ত), মুহাম্মদ শহিদুল্যাহ চৌধুরী (অবসরপ্রাপ্ত, পুলিশ সুপার), মো. আলমগীর (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট ঢাকা), মোহা. মনিরুল ইসলাম (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, পিবিআই হেডকোয়ার্টার্স), মো. জানে আলম (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, ঢাকা), সৈয়দ আবদুর রউফ (সহকারী পুলিশ সুপার, ট্র্যাফিক অ্যান্ড ড্রাইভিং স্কুল, ঢাকা), মো. ইউনুছ (পুলিশ পরিদর্শক–নিরস্ত্র, সিআইডি), মো. মাসুদ পারভেজ (পুলিশ পরিদর্শক–নিরস্ত্র, চারঘাট মডেল থানা, রাজশাহী), মুহাম্মদ আলমগীর সরকার (পুলিশ পরিদর্শক–নিরস্ত্র, আরআরএফ–ঢাকা) ও মো. মশিউর রহমান (পুলিশ পরিদর্শক–নিরস্ত্র, সিআইডি, ঢাকা মেট্রো–উত্তর)।

রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে উপসচিব ইসরাত জাহানের সই করা ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টের অধীনে পরিচালিত বিচার অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে তদন্তকাজ সম্পাদন ও ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনকে সহায়তা প্রদান করবেন। তদন্ত সংস্থায় অন্তর্ভুক্ত যেসব সদস্য বর্তমানে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত আছেন, তারা প্রেষণে নিয়োজিত আছেন মর্মে গণ্য হবেন। যেসব সদস্য বর্তমানে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত নন, তারা যে পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন এবং ওই পদে যে মূল বেতন ও ভাতাদি আহরণ করেছেন, বর্তমানে তারা অবসরকালীন আহরিত মূল বেতনের জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫–এর করেসপন্ডিং স্কেলে মূল বেতন ও ভাতাদি সাকল্য হিসেবে প্রাপ্য হবেন।

প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, তদন্ত সংস্থায় উল্লিখিত কর্মকর্তাদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা যোগদানের তারিখ থেকে পরবর্তী দুই বছর পর্যন্ত ওই পদে বহাল থাকবেন। প্রেষণে নিয়োজিত কর্মকর্তারা পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তদন্ত সংস্থায় কর্মরত থাকবেন।

ট্রাইব্যুনালে হত্যা-গণহত্যার ২৮টি অভিযোগ, আসামি উসকানিদাতা সাংবাদিকরাও

প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যা-গণহত্যার ঘটনায় ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২৭টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় ১৩টি এবং চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে ১৪টিসহ মোট ২৭টি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে গণহত্যার ঘটনায় একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। সবগুলো আবেদনে প্রধান আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনাকে। এ ছাড়া অধিকাংশ আবেদনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদ, হাসানুল হক ইনু, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সালমান এফ রহমান, মোহাম্মাদ আলী আরাফাত, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম, দক্ষিণের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপস, পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক র‌্যাবের প্রধান মো. হারুন আর রশিদ, ডিবির সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদ, যুবলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান, স্থানীয় এমপি, আওয়ামী লীগ নেতা, স্থানীয় থানার ওসিকে আসামিকে করা হয়েছে।

৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনে নিহত নাসিব হাসান রিয়ানের বাবা আবদুর রাজ্জাক গত ২৯ আগস্ট একটি অভিযোগ দায়ের করেন। এতে শেখ হাসিনাসহ ৫৩ জনকে আসামি করা হয়। সেখানে গণহত্যায় উসকানি দেওয়ায় ২৯ জন সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন– সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, একাত্তর টেলিভিশনের সিইও ও প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু, সাংবাদিক ও টিভি সঞ্চালক নবনীতা চৌধুরী, এবিনিউজ২৪ডটকমের সম্পাদক সুভাষ সিংহ রায়, সময় টেলিভিশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ যোবায়ের, সাবেক বার্তাপ্রধান তুষার আব্দুল্লাহ, যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম, সমকালের সাবেক সম্পাদক আবেদ খান, এটিএন নিউজের বার্তাপ্রধান প্রভাষ আমিন, একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপা, বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদ, হেড অব কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স মিথিলা ফারজানা, ডিবিসি নিউজের সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু, ডিবিসির প্রধান সম্পাদক মঞ্জুরুল ইসলাম, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক আশীষ সৈকত, এশিয়ান টেলিভিশনের হেড অব নিউজ মানষ ঘোষ, বাংলাদেশের তথ্য কমিশনের সাবেক তথ্য কমিশনার মাসুদা ভাট্টি, ডিবিসির প্রণব সাহা, এটিএন নিউজের সাবেক প্রধান নির্বাহী সম্পাদক মুন্নি সাহা, এটিএন বাংলার সাবেক প্রধান নির্বাহী সম্পাদক জ ই মামুন, দৈনিক জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়, চ্যানেল আইয়ের সোমা ইসলাম, ইত্তেফাকের শ্যামল সরকার, সমকালের অজয় দাশ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন।

এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আইনজীবী ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নিঝুম মজুমদার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজবাহ কামালকে আসামি করা হয়েছে।

অভিযোগে সাংবাদিকদের অপরাধ সম্পর্কে বলা হয়, ২০ থেকে ৪৯ নম্বর আসামিরা (অভিযোগ অনুযায়ী) আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যাকে বৈধতা দিতে প্ররোচনা ও উসকানি দেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাদের দাবি এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে মিথ্যা খবর প্রচার করেছেন। পাশাপাশি আহত ও নিহতদের সঠিক তথ্য গোপনের উদ্দেশ্যে টকশো, কলাম লিখে এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সত্য আড়াল করে গুজব ও মিথ্যা সংবাদ ছড়িয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করেছেন।

এমএইচডি/এসএসএইচ