বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ। গ্রুপটির কর্ণধার মো. সাইফুল আলম ও তার পরিবারের সদস্য এবং তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে বিভিন্ন সময়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ জমা হয়েছে। এর মধ্যে কেবল সাইফুল আলমের গৃহকর্মীর ব্যাংক হিসাবে প্রায় ১৬ কোটি টাকা জমা হওয়ার তথ্য মিলেছে।

এ ছাড়া গ্রুপটির চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের পরিবারের সদস্য ও বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা ছয়টি ব্যাংকের হিসাবে এক লাখ ৮০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা জমা হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বিগত পাঁচ বছরের হিসাব পর্যালোচনা করে ওই লেনদেনের তথ্য পেয়েছে এনবিআরের কর অঞ্চল-১৫।

হিসাবগুলোর সর্বশেষ স্থিতিতে মিলেছে ৩২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। যেখানে গত ৩০ জুন পর্যন্ত ছয় হাজার ৮০০ কোটি টাকা জমা ছিল

হিসাবগুলোর সর্বশেষ স্থিতিতে মিলেছে ৩২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। যেখানে গত ৩০ জুন পর্যন্ত ছয় হাজার ৮০০ কোটি টাকা জমা ছিল। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এনবিআরের আওতাধীন কর অঞ্চল-১৫ এস আলম গ্রুপের আর্থিক লেনদেন ও কর ফাঁকির বিষয়টি অনুসন্ধান করছে। কর অঞ্চলটির অনুসন্ধানে এখন পর্যন্ত এস আলম গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও মালিকদের নামে ৬৫টি আয়কর নথির অস্তিত্ব মিলেছে। যার যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলমান।

এনবিআর সূত্র বলছে, ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের মাধ্যমে হিসাবগুলো পরিচালিত হতো। এর মধ্যে পাঁচটি ব্যাংক ছিল এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে।

এ বিষয়ে ট্যাক্স জোন-১৫ এর কমিশনার আহসান হাবিব ঢাকা পোস্টকে বলেন, এস আলমের পরিবারের সদস্য ও গ্রুপের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে লেনদেনের তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলমান। আমাদের আওতাধীন সব হিসাব যাচাই করা হচ্ছে। কর ফাঁকির বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কর অঞ্চল-১৫ এর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত পাঁচ বছরের তথ্য যাচাই-বাছাই করে ঋণ ও বিক্রির অর্থসহ ব্যাংকগুলোতে এখন পর্যন্ত তাদের এক লাখ ৮০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা জমার সন্ধান মিলেছে। আমরা ওই অর্থের বিপরীতে সরকারি ফান্ডে প্রদত্ত কর পরিশোধ হয়েছে কি না, তা যাচাই করছি। আমাদের প্রধান লক্ষ্য টাকা যেন বেহাত না হয়ে যায়।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে আহসান এইচ মনসুরকে নিয়োগ দেওয়ার পর থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে।

এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলমের গৃহকর্মীর ব্যাংক হিসাবে ১৫ থেকে ১৬ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পেয়েছে আয়কর বিভাগ। গৃহকর্মীর নাম মর্জিনা আকতার। কর অঞ্চল-১৫ এর একটি অনুসন্ধানী দল এস আলম পরিবারের কর ফাঁকির বিষয়টি অনুসন্ধান করছে

গত ১৪ আগস্ট এনবিআরের অধীন কর অঞ্চল-১৫ থেকে ৯১টি ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এস আলম, তার পরিবার এবং তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক সত্তাগুলোর ব্যাংক হিসাবের বিস্তারিত তথ্য দিতে বলা হয়েছে।

কাজের মেয়ে মর্জিনার হিসাবে ১৬ কোটি টাকা

এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলমের গৃহকর্মীর ব্যাংক হিসাবে ১৫ থেকে ১৬ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পেয়েছে আয়কর বিভাগ। গৃহকর্মীর নাম মর্জিনা আকতার। কর অঞ্চল-১৫ এর একটি অনুসন্ধানী দল এস আলম পরিবারের কর ফাঁকির বিষয়টি অনুসন্ধান করছে।

অনুসন্ধান করতে গিয়ে এনবিআরের আয়কর বিভাগ দেখতে পায়, চট্টগ্রাম শহরে ইসলামী ব্যাংকের পাঁচলাইশের এসএফএ টাওয়ার শাখায় ২২টি স্থায়ী আমানত রয়েছে এস আলম পরিবারের। সেখানে গৃহকর্মী মর্জিনা আকতারের ২২টি এফডিআরে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ এক কোটি তিন লাখ টাকা। ওই হিসাব বাদেও মর্জিনার আরও বেশ কয়েকটি হিসাবের সন্ধান পাওয়া গেছে। সবমিলিয়ে মর্জিনা আকতারের হিসাবগুলোতে ১৫ থেকে ১৬ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছে কর বিভাগ।

এস আলমের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান

এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা পাচার করে সিঙ্গাপুরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অভিযোগ রয়েছে এস আলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলমের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছ থেকে এস আলম গ্রুপের ব্যাংক হিসাবের যাবতীয় লেনদেনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ চলমান।

সাইফুল আলম আওয়ামী লীগ সরকারের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তার প্রতিষ্ঠিত এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে অর্থপাচার ও ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সাধারণত বিদেশে বিনিয়োগ বা অর্থ স্থানান্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও গ্রুপটি কোনো নিয়মনীতি মানেনি। প্রতিষ্ঠানটি এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১২ হাজার কোটি টাকা পাচার করার মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়েছে। গত এক দশকে সিঙ্গাপুরে এস আলম অন্তত দুটি হোটেল, দুটি বাড়ি, একটি বাণিজ্যিক স্পেস এবং অন্যান্য সম্পদ গড়েছেন। সেখানেও বিভিন্ন উপায়ে কাগজপত্র থেকে তাদের নাম সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

২০১৬ সালে সিঙ্গাপুরের ১৯তলাবিশিষ্ট সেন্ট্রিয়াম স্কয়ারে ২৭ হাজার বর্গফুটের একটি বাণিজ্যিক স্পেস ১০০ দশমিক ৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে কিনে নেয় এস আলমের প্রতিষ্ঠান ক্যানালি লবিস্টিক প্রাইভেট লিমিটেড। অধিগ্রহণের এক বছর পর ক্যানালি লজিস্টিক নাম পরিবর্তন করে উইলকিনসন ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড রাখে

সিঙ্গাপুরের গণমাধ্যম দ্য বিজনেস টাইমসের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২০১৬ সালে সিঙ্গাপুরের ১৯তলাবিশিষ্ট সেন্ট্রিয়াম স্কয়ারে ২৭ হাজার বর্গফুটের একটি বাণিজ্যিক স্পেস ১০০ দশমিক ৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে কিনে নেয় এস আলমের প্রতিষ্ঠান ক্যানালি লবিস্টিক প্রাইভেট লিমিটেড। অধিগ্রহণের এক বছর পর ক্যানালি লজিস্টিক নাম পরিবর্তন করে উইলকিনসন ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড রাখে।

১৯৮৫ সালে সাইফুল আলম এস আলম গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। ধীরে ধীরে এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। ব্যবসার পরিধি বাড়াতে নির্মাণ সামগ্রী থেকে আবাসন ব্যবসা, টেক্সটাইল থেকে মিডিয়া, আন্তঃনগর বাস থেকে শিপিং, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ থেকে ব্যাংকিং, এমনকি বীমা খাতে রয়েছে তার বিচরণ।

সূত্র বলছে, ২০২৩ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশ থেকে ৪০ দশমিক ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে বিনিয়োগের জন্য পাচার করেছে এস আলম গ্রুপ। দুদক ও এনবিআর ছাড়াও বিএফআইইউ এবং সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা গ্রুপটির বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম খুঁজে বের করতে কাজ করছে। 

আরএম/কেএ