চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষককে উপাচার্য করা হচ্ছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এখনো এ সংক্রান্ত কোনো প্রজ্ঞাপন দেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ভিসি হিসেবে যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে, তার নাম ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া। প্রায় দুই বছর আগে তিনি অবসরে গিয়েছেন। এখন তাকে পুনরায় ক্যাম্পাসে ফেরাতে একটি পক্ষ তৎপর বলে অভিযোগ উঠেছে। 

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৬৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় ড. ইয়াহ্ইয়াকে অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। সরকারি চাকরিতে নির্দিষ্ট বয়স শেষে অবসরে পাঠানোর প্রধান কারণই হলো, তার কর্মক্ষমতা লোপ পাওয়া। এখন তিনি উপাচার্যের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহীর চেয়ার কীভাবে সামলাবেন সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

আবার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি সাধারণত কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। কারণ, দায়িত্ব শেষ করেই তারা সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পাস ছাড়তে পারেন। অতীতে আওয়ামী লীগ সরকার ড. শিরীণ আখতারকেও অবসরের পর উপাচার্য পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা না থাকায় তিনি চবির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। টাকার বিনিময়ে নিয়োগ কেলেঙ্কারিতেও জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত হওয়ায় বিদায়ের পর শিরীণের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এমনকি গুরুতর এসব অভিযোগ তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের একটি দল চবি ক্যাম্পাসে আসলেও তাদের সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করেননি শিরীণ আখতার।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) / ঢাকা পোস্ট

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক বলেন, চবির ভিসি পদে যাকে নিয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা করেছেন। তারপর চবিতে শিক্ষকতা করেছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে প্রায় হাজারখানেক শিক্ষক রয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই চবির সাবেক শিক্ষার্থী ছিলেন। তাদের মধ্য থেকে কাউকে উপাচার্য নিয়োগ দিলে বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যেত।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সহকারী অধ্যাপক পদমর্যাদার এক শিক্ষক বলেন, ড. ইয়াহ্ইয়া চবিতে কোনো প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেননি। হঠাৎ করে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ চেয়ারে বসানোর তেমন কোনো যৌক্তিকতা নেই। তাছাড়া উনাকে আমরা কাছ থেকেই দেখেছি। স্বভাবগত কারণে তিনি মানুষের সঙ্গে একেবারে কম মেশেন। বিশেষ করে বয়স হওয়ায় শিক্ষকতাকালীন সময়ের শেষ দিকে তার মেজাজ খিটখিটে ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে অনেকের সমন্বয়ে প্রশাসন পরিচালনা করতে হয়। কিন্তু ইয়াহ্ইয়ার পক্ষে সেটি সম্ভব হবে না বলে মনে হচ্ছে।

জানা গেছে, গত জুলাই-আগস্টে সারা দেশের ন্যায় চবিতেও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হয়েছে। ওই সময় শিক্ষার্থীদের ওপর একাধিকবার হামলা হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এসব হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। আন্দোলনের শুরুর দিকে সরকার পতনের তেমন সম্ভাবনাও ছিল না। তারপরও ক্ষমতাসীনদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এ কারণে কয়েকজন শিক্ষকের বাড়িতে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সরাসরি কয়েকজন শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্তের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এসবের পরও তারা শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।

ড. ইয়াহ্ইয়া আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগ দেওয়া ভিসি ড. শিরীণ আখতারের কাছ থেকে নানা সুবিধা নিয়েছেন, শিরীণের সঙ্গে তার সখ্য ছিল / ঢাকা পোস্ট

আসকর আলী নামে চবির সাবেক এক শিক্ষার্থী বলেন, ইয়াহ্ইয়া স্যার ছাত্রদের আন্দোলনে দৃশ্যমান কোনো ভূমিকা রাখেননি। তারপরও ঘুরেফিরে কেন তার নাম আসছে বুঝতে পারছি না। অথচ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত ছিল সাম্প্রতিক আন্দোলনে ভূমিকা রাখা শিক্ষকদের মধ্যে থেকে কাউকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া।

চবির এক শিক্ষক বলেন, ড. ইয়াহ্ইয়া আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগ দেওয়া ভিসি শিরীণের কাছ থেকে নানা সুবিধা নিয়েছেন। শিরীণের সঙ্গে তার সখ্য ছিল। এককথায় কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী ছিলেন ড. ইয়াহ্ইয়া। সবমিলিয়ে এখনো যেহেতু প্রজ্ঞাপন হয়নি, সেহেতু বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ রয়েছে।

একাধিক শিক্ষক অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে চবিতে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী পদে শত শত লোক নিয়োগ পেয়েছে। তাদের যেন কোনো অসুবিধা না হয়, সেই রকম একজনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিতে তৎপর ছিলেন আওয়ামীপন্থিরা। এখনো তাই হয়েছে।

ইয়াহ্ইয়া আখতারের লেখা কবিতা ভাইরাল

মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতারের লেখা ‘ভিসি হবো’ শিরোনামে একটি কবিতা সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এই কবিতায় তিনি লেখেন—

খায়েশ জেগেছে মনে
ভিসি আমি হতে চাই,
এর মধ্যে যোগ্যতা আর
লেখাপড়ার ব্যাপার নাই

তিয়াত্তোরের আইনে কেউ
হবেন নাতো ভিসি,
সে জন্যই সুযোগ পেয়ে
এই রেসে নেমেছি।

আমায় যদি বলো হতে
এমনভাবে ভিসি
আমি কেবল উচ্চারিবো
ছি ছি ছি ছি ছি ছি...

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক জানান, এই কবিতার মানে হলো তিনি ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ মোতাবেক ভিসি নিয়োগ চান। এ আদেশ অনুযায়ী সিনেট কর্তৃক মনোনীত তিনজনের প্যানেল থেকে নির্ধারিত শর্তে আচার্য একজনকে চার বছরের জন্য নিয়োগ দেবেন। এখন তাকে এ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। তাহলে তিনি কী কবিতা অনুযায়ী ছি ছি বলে প্রত্যাখ্যান করবেন? 

উপাচার্য হওয়ার বিষয়টি নিজেই নিশ্চিত করেছেন ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা বিষয়টি আমাকে জানিয়েছেন। তবে প্রজ্ঞাপন জারি হতে একটু সময় লাগবে। উপদেষ্টা আমাকে অনুরোধ করেছেন, আমি যেন শিক্ষার্থীদের ভিসি হওয়ার বিষয়টা জানিয়ে দেই।

এমআর/এমজে