নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিম্যাল সাইন্সেস ইউনিভার্সিটির (সিভাসু) হর্তাকর্তা হয়ে উঠেছিলেন তিন কর্মকর্তা, যারা সবাই ছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ ও টেন্ডার সবই ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। কথায় কথায় সবাইকে ভয় দেখাতেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-রেজিস্ট্রারও অনিয়মের বেলায় তাদের মতোই বেপরোয়া ছিলেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া সিভাসুর ভিসি-রেজিস্ট্রার ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ওই তিন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

অভিযুক্ত তিন কর্মকর্তা হলেন সিভাসুর সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) আবু মো. আরিফ, খামার ব্যবস্থাপক ডা. তারিকুল ইসলাম অনিক ও ডা. আদিত্য চৌধুরী।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিরোধিতা করে নতুন করে আলোচনায় আসেন এই তিন কর্মকর্তা। আন্দোলনে অংশ নেওয়া সিভাসুর শিক্ষার্থীদের হুমকি, তাদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ লেলিয়ে দেওয়া এবং আন্দোলন বানচালে টাকা খরচ করার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের কয়েকদিন আগে শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের হুমকি দিয়েছিলেন তারা। একই সঙ্গে তারা সশরীরে মাঠে ছিলেন। শিক্ষার্থীদের কারা কারা আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন, সেটির তালিকা প্রশাসনকে সরবরাহ করতেন তারা। কোনো কারণে আন্দোলন ব্যর্থ হলে আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্তের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন এই কর্মকর্তারা।

গত ১৬ জুলাই চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে সশস্ত্র হামলা চালায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। এতে নিহত হন দুই শিক্ষার্থী ও এক দোকান কর্মচারী। আন্দোলনে নিহত ফয়সাল আহমেদ শান্তর বাবা বাদী হয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে একটি মামলা করেন। এতে ৭৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। তাদের মধ্যে নাম রয়েছে সিভাসু কর্মকর্তা আবু মো. আরিফেরও। যদিও মামলায় নাম আসার পরও এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে একটা কারণ দর্শানোর নোটিশও দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

নিয়ম ভেঙে পদোন্নতি হয় ৪ জনের

২০১৮ সালে দ্বিতীয় শ্রেণির প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন আবু মো. আরিফ। একসময় সাবেক প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির অনুসারী সন্ত্রাসী টিনুর ক্যাডার ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে টিনু দলবল নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নওফেলের গ্রুপে যোগ দেন। সেই থেকে নওফেলের সঙ্গে কাজ করেন আরিফ। পদোন্নতি পেতে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ২০২৩ সালে সহকারী লাইব্রেরিয়ান পদে আবেদন করেন আরিফ।

বাছাই কমিটিও তাকে ভাইভা কার্ড ইস্যুর জন্য অনুমতি দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তার ভাইভা কার্ড ইস্যু করা হয়। সিভাসু ক্যাম্পাসে এ অনিয়ম নিয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের মধ্যে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সমালোচনার মুখে আরিফকে ওই পদে নিয়োগ দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু অদৃশ্য সিন্ডিকেট আরিফকে যেকোনো প্রক্রিয়ায় পদোন্নতি দিতে তোড়জোড় শুরু করে। 

এ কারণে তড়িঘড়ি করে সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। যেটি প্রকাশের দিনই আরিফকে ওই পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে দায়িত্ব দেওয়া হয়। যেন তাকে ওই পদে পদোন্নতি বা নিয়োগ দেওয়া সহজ হয়। পরবর্তীতে তাই হয়েছে। ওই পদে অনেকে আবেদন করলেও যোগ্য বিবেচিত হয় সেই আরিফই। ফলশ্রুতিতে তাকে পদোন্নতি ও নিয়োগ প্রদান করা হয়।

সিভাসুর সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন ডা. তারিকুল ইসলাম অনিক ও ডা. আদিত্য চৌধুরী। ক্যাম্পাসে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং পরবর্তীতে নওফেলের রাজনীতি করতেন দুজনেই। শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার পরপর দুজনকে সিভাসুতে নিয়োগ দিতে চাপ দেন নওফেল। ২০১৮ সালে দুজনকে নবম গ্রেডে প্রথম শ্রেণির বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০২২ সালে তাদের স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হয়। দেড় বছর পরই ২০২৩ সালে দুজনকে ষষ্ঠ গ্রেডের খামার ব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়।

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নওফেলের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করতেন রাহুল দাশ। তার স্ত্রী পাপিয়া সেনকে ২০১৯ সালে নবম গ্রেডে প্রথম শ্রেণির হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০২২ সালে তাকেও স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। দেড় বছরের মাথায় তাকে পদোন্নতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু ওই পদে পদোন্নতি দেওয়া সম্ভব ছিল না, যার ফলে এ নিয়ে বাঁধে বিপত্তি। কিন্তু প্রশাসনিক কর্তারা নিয়ম ভেঙে শেষ পর্যন্ত তাকে সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে পদোন্নতি দেন।

এই চারজনের ক্ষেত্রে কীভাবে নিয়ম ভাঙা হয়েছে— জানতে চাইলে সিভাসুর এক শিক্ষক ঢাকা পোস্টকে বলেন, সেকশন অফিসার পদে কেউ নিয়োগ হলে পরবর্তীতে পদোন্নতির জন্য তাকে স্থায়ীভাবে ওই পদে চার থেকে পাঁচ বছর চাকরি করা প্রয়োজন হয়। একই সঙ্গে তার মোট চাকরিকাল ৯ থেকে ১০ বছর হতে হবে। কিন্তু তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনোটাই মানা হয়নি। পরবর্তীতে ইউজিসি আপত্তি দেয়।

তিন জনের সিন্ডিকেটে সহযোগী ছিলেন যারা

সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) আবু মো. আরিফ, খামার ব্যবস্থাপক ডা. তারিকুল ইসলাম অনিক ও ডা. আদিত্য চৌধুরী এই তিনজনের পরামর্শে চলত সিভাসু। ভিসিও ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। তাদের সিন্ডিকেটে নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতেন ফিশারিজ বিভাগের আওয়ামীপন্থি শিক্ষক প্রফেসর ড. নুরুল আবছার খান, রেজিস্ট্রার মির্জা ফারুক ইমাম ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার নাছির আহমেদ।

এই সিন্ডিকেটের পছন্দের ঠিকাদার কাজ না পেলে পুরো টেন্ডার প্রক্রিয়া বাতিল করে দিতেন ভিসি। এ রকম একটি টেন্ডার বাতিল হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রায় ১০ কোটি টাকার বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ক্রয় করা যায়নি। কারিগরি কমিটির সুপারিশ প্রত্যাখান করে ভিসি টেন্ডার প্রক্রিয়াটাই বাতিল করে দেন।

অনিয়মে ডুবে ছিলেন ভিসি-রেজিস্ট্রার

হাসিনা সরকারের পতনের কয়েক দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দিয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করিয়েছেন সিভাসুর ভিসি ড. এএসএম লুৎফুল আহসান। গত ৩ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রতিবিপ্লবের ঘোষণা দিতে নির্দেশনা দেন ভিসি। 

সিভাসুর একজন শিক্ষক জানান, নওফেলের অনুগত এ ভিসি প্রায় পৌনে দুই বছরে যা ইচ্ছা তাই করেছেন। নওফেলের নির্দেশে বাকলিয়া আওয়ামী লীগের এক নেতার মেয়েকে ফিশারিজ বিভাগে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন এই ভিসি। যিনি নিয়োগ পরীক্ষায় ১৭তম হয়েছিলেন। মেধাবীদের বঞ্চিত করে তাকে নিয়োগ দেওয়া হলে ক্যাম্পাসে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। কিন্তু আমাদের প্রতিবাদ করার সুযোগ ছিল না।

উপাচার্য ছাড়াও সিভাসুর শীর্ষ পদগুলোর মধ্যে কোষাধ্যক্ষ ড. কামাল হোসেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অফিসের পরিচালক পদে এবং বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহ-সভাপতি ড. গউজ মিয়া কোয়ালিটি এস্যুরেন্স সেলের পরিচালক পদে বহাল রয়েছেন। কক্সবাজার ক্যাম্পাসের পরিচালক পদে বহাল রয়েছেন আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন প্রগতিশীল শিক্ষক ফোরামের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. নুরুল আবছার খান। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান, ভিসির সব অপকর্মের হোতা রেজিস্ট্রার মীর্জা ফারুক ইমাম। অর্থ লুটপাটের অভিযোগে তিনি ইউজিসি কর্তৃক অভিযুক্ত হয়েছেন। বন বিভাগে চাকরি করার সময়ে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ওয়ান-ইলেভেনের পরে বন বিভাগে শুদ্ধি অভিযান চলাকালে তিনি ঘুষ দিয়ে চাকরি নেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে খালু শ্বশুর ড. নুরুল আনোয়ার ও খালা শাশুড়ি ড. জরিপা বেগমের প্রভাব খাটিয়ে রেজিস্ট্রারের পদ বাগিয়ে নেন মীর্জা ফারুক। 

এ ছাড়া, পোর্ট সিটি ইউনিভার্সিটির ভিসি ড. নুরুল আনোয়ার একটানা ১৮ বছর এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে সুবিধা ভোগ করছেন। একই সঙ্গে তিনি পুরো সময়জুড়ে কর্মচারী নিয়োগ বোর্ড এবং অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৩ সেপ্টেম্বর নিয়ম ভেঙে নিয়োগ ও পদোন্নতি পাওয়া ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের অপসারণ দাবি করে সিভাসুতে বিক্ষোভ করেছেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে তারা সিভাসুর ভিসি ও রেজিস্ট্রারসহ স্বৈরাচারের দোসরদের পদত্যাগ দাবি করেন। 

এ ঘটনার পর থেকে সিভাসুতে ছাত্রলীগ করা কর্মকর্তাদের কম দেখা গেছে। তাদের বেশিরভাগের মুঠোফোনও বন্ধ রয়েছে। এ কারণে তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

ভিসি ড. এএসএম লুৎফুল আহসান ও রেজিস্ট্রার মীর্জা ফারুক ইমামকে একাধিকবার কল করা হলেও তারা রিসিভ করেননি।

এমআর/এমজে