ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক মাস পার হলেও এখনো শুকায়নি ক্ষত। থামেনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছাত্র-জনতার লাশের মিছিল। চোখ হারিয়ে অন্ধ, পা হারিয়ে পঙ্গুত্ববরণ করছেন একের পর এক শিক্ষার্থী। হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন অসংখ্য আহত ছাত্র-তরুণ।

হাজারো ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বৈরাচারমুক্ত ‘নতুন বাংলাদেশে’ সর্বত্র নীতি-আদর্শে এগিয়ে থাকা মানুষেরা নেতৃত্ব ও দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হবেন এমনটা প্রত্যাশিত হলেও বাস্তবে ঘটছে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের বড় বড় পদ বাগিয়ে নিচ্ছেন স্বৈরাচারের দোসর ও ছাত্রহত্যায় ইন্ধনদাতারা। যাদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডে উসকানি ছাড়াও রয়েছে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ।

সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা পাস না করা সত্ত্বেও তাকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ওই পরীক্ষা থেকে তিনি অব্যাহতি প্রাপ্ত হন।

স্বাস্থ্য খাতের শীর্ষ কর্মকর্তার দায়িত্ব পাওয়া অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন তেমনই একজন বলে অভিযোগ করছেন ওই খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

তাদের অভিযোগ, শেখ হাসিনার পতনের আগে আওয়ামী লীগের মতোই ছাত্র-জনতার বিপক্ষে রাজপথে নেমেছিলেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) চিকিৎসকরা। ‘শান্তি সমাবেশ’ নামের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে ‘এক দফার কবর’ দিতে চেয়েছিলেন তারা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের দায়িত্ব পাওয়া রোবেদ আমিন এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত ছিলেন।

কোটা সংস্কার ও পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনার পতনের দাবিতে আন্দোলনে অংশ নিয়ে আহত হওয়া ছাত্র-জনতাকে চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর অভিযোগ রয়েছে স্বাচিপপন্থি চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। সেই তালিকায় নাম রয়েছে ডা. রোবেদ আমিনেরও।

এছাড়া তার বিরুদ্ধে আছে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ। এমনকি তার পদোন্নতি নিয়ে আছে চাকরি বিধিমালা লঙ্ঘনের সুস্পষ্ট অভিযোগও। ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানেও প্রমাণ পাওয়া গেছে এসব অভিযোগের। রোবেদ আমিনের আশপাশে থাকা কর্মকর্তারাই এখন তার বিরুদ্ধে কথা বলছেন।

যদিও নিজের সর্বশক্তি দিয়ে রোবেদ আমিন পদে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

অবৈধ উপায়ে বাগিয়ে নেন গ্রেড-১ পদ

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে চাকরিতে যোগদান করেন ডা. রোবেদ আমিন। নিয়ম অনুযায়ী ২০১১ সালের পূর্বে তার সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই ডা. রোবেদ আমিন সহকারী অধ্যাপক পদে ঢাকা মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন। ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা সরকারের তোষামোদি করে এরপর বিধিমালা ভঙ্গ করে ২০১৩ সালে সহযোগী অধ্যাপক এবং ২০২০ সালে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান তিনি।

ডা. রোবেদ আমিনের চাকরি স্থায়ীকরণের বিষয়ে অধিদপ্তরের মানবসম্পদ বিভাগে যে তথ্য রয়েছে তাতে নানা অসঙ্গতি দেখা গেছে। সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা পাস না করা সত্ত্বেও তাকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। চাকরির ১৪ বছর পূর্তিতে সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা থেকে তিনি অব্যাহতি প্রাপ্ত হন।

এদিকে, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (পদোন্নতির জন্য পরীক্ষা) বিধিমালা ২০১৭-এর অনুচ্ছেদ ৮(২) অনুযায়ী সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা পাস না করলে কোনো কর্মকর্তা সর্বোচ্চ ৫ম গ্রেড পর্যন্ত পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হবেন। এরপর তিনি আর পদোন্নতির যোগ্য হবেন না। কিন্তু ডা. রোবেদ আমিনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে ভিন্ন নিয়ম। সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা পাস না করেও তিনি এক লাফে ৩য় গ্রেডের অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। বর্তমানে তাকে গ্রেড-১ পদে পদায়ন করা হয়েছে, যা চাকরির নিয়ম অনুযায়ী সম্পূর্ণ অবৈধ।

শেখ হাসিনার পতনের আগে আওয়ামী লীগের মতোই ছাত্র-জনতার বিপক্ষে রাজপথে নেমেছিলেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) চিকিৎসকরা। ‘শান্তি সমাবেশ’ নামের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে ‘এক দফার কবর’ দিতে চেয়েছিলেন তারা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের দায়িত্ব পাওয়া রোবেদ আমিন এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত ছিলেন।

অডিট আপত্তিতে ‘গুরুতর’ আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ

জানা গেছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূতভাবে নোয়াখালী আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজে ৪৯ লাখ ৯৯ হাজার ৪৭৬ টাকা দেওয়া হয়। অভিযোগ আছে, এনসিডিসির লাইন ডিরেক্টর ডা. রোবেদ আমিন তার এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে এসব অর্থ বরাদ্দ দেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ সালে গুরুতর অডিট আপত্তি ওঠে রোবেদ আমিনের বিরেুদ্ধে। ওই অডিট আপত্তিতে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করা হয়। এছাড়া ২০২১-২২ অর্থ বছরে তার বিরুদ্ধে আরও কিছু অডিট আপত্তি এসেছে। এরমধ্যে ‘গুরুতর আর্থিক অনিয়ম’ হিসেবে চিহ্নিত আপত্তিও রয়েছে।

ড্যাবের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঘেরাও, রোবেদ আমিন-সাদীসহ স্বাস্থ্যের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অপসারণ দাবি

সংশ্লিষ্টদের মতে, ওই সময়ে ৩ কোটি ৬১ লাখ ৪১ হাজার ৩২০ টাকার অডিট আপত্তির মধ্যে ২ কোটি ৮৯ লাখ ৮৪ হাজার টাকার এমএসআর কেনাকাটার ক্ষেত্রে গুরুতর আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।

২০২১-২২ সালে গুরুতর অডিট আপত্তি ওঠে রোবেদ আমিনের বিরেুদ্ধে। ওই অডিট আপত্তিতে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করা হয়। এছাড়া ২০২১-২২ অর্থ বছরে তার বিরুদ্ধে আরও কিছু অডিট আপত্তি এসেছে। এরমধ্যে ‘গুরুতর আর্থিক অনিয়ম’ হিসেবে চিহ্নিত আপত্তিও রয়েছে।

অডিট আপত্তির বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে জানা যায়, ওভিসি (অনলাইন ভিডিও কমার্শিয়াল) তৈরির একটি রিকোয়েস্ট ফর কোটেশন (আরএফকিউ) বিল ৪ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ টাকা, আরেকটির বিল ৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা। স্ট্যান্ডার্ড রিকোয়েস্ট ফর কোটেশন (এসআরএফকিউ) তৈরির মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি জারি করে কার্যাদেশ দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা না করে ‘মিডিয়াবাজ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়, যেখানে টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন্স ফর সাপ্লাই অব গুডস-এ কার্যাদেশ প্রাপ্ত কোম্পানির স্বাক্ষর নেই। এছাড়া সেই ওভিসিগুলো কোথায় সম্প্রচার করা হয়েছে সে বিষয়ে কেউ বলতে পারেন না। পাবলিকেশন মেটেরিয়াল কোডে ৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা, কম্পিউটার ক্রয়-ব্যয় কোডে ৪ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকা ও ৪ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ টাকা, স্টেশনারি কোডে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৯৮০ টাকার ৪টি আরএফকিউ বিলে এসআরএফকিউ তৈরি করে যথাযথ নিয়ম মেনে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়নি।

এরকম অনেক নিয়মবহির্ভূত আরএফকিউ করা হয় অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে।

একইসঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা ও বেসরকারি হাসপাতালের মালিক

ঢাকা পোস্টের হাতে আসা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রদত্ত বিভিন্ন হাসপাতালের লাইসেন্সের তথ্যে দেখা যায়, এএমজেড হাসপাতালের মালিকানা তালিকায় ১১ নম্বরে নাম রয়েছে ডা. রোবেদ আমিনের। সরকারি কর্মচারী বিধিমালা ১৯৭৯ অনুযায়ী, একজন চিকিৎসক পেশাজীবী হিসেবে চেম্বার করতে পারবেন, কনসালটেন্সি করতে পারবেন। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালের মালিকানা/পরিচালক পদ গ্রহণ করতে পারবেন না। যদি করেন তা হবে বিধিমালা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

ডা. রোবেদ আমিন, ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

জানতে চাইলে অধিদপ্তরে কর্মরত ও নানাভাবে বঞ্চিত ডা. ফারুক আহমেদ নামে এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, রোবেদ আমিন সরকারি বিধিমালা পরিপন্থি কাজে জড়িত চিকিৎসক। তার বিরুদ্ধে এখন আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। অথচ তিনি হয়ে গেলেন মহাপরিচালক। এ সিদ্ধান্তে আমরা বিস্মিত এবং স্তম্ভিত হয়েছি। তার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের অডিট শাখার কাগজপত্র দেখলেই অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। তার পিএম, ডিপিএম ও অফিস সহকারীদের জিজ্ঞাসা করলেও সব তথ্য জানা যাবে।

সরকারি কর্মচারী বিধিমালা ১৯৭৯ অনুযায়ী, একজন চিকিৎসক পেশাজীবী হিসেবে চেম্বার করতে পারবেন, কনসালটেন্সি করতে পারবেন। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালের মালিকানা/পরিচালক পদ গ্রহণ করতে পারবেন না। যদি করেন তা হবে বিধিমালা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার করেছেন, সরকারি বিধিমালা ভঙ্গকারীকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সর্বোচ্চ পদে পদায়ন সে অঙ্গীকারের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সাংঘর্ষিক। আমরা চাই সরকার যেভাবে সমস্ত ফ্যাসিস্টপন্থিদের রাষ্ট্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন, স্বাস্থ্য খাতেও ডা. রোবেদ আমিনকে সরিয়ে যোগ্য ব্যক্তিকে পদায়নের মাধ্যমে জন আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাবেন।

মুখ খুলতে শুরু করেছেন তার আশেপাশের কর্মকর্তারাই!

রোবেদ আমিনের নানা অনিয়ম নিয়ে কথা হয় অধিদপ্তরের তার শাখারই (এনসিডিসি) সাবেক এক কর্মকর্তার সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, এনসিডি কর্নার স্থাপনকে কেন্দ্র করে বছরে প্রায় এক হাজারের মতো সেমিনার-ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়। এসব সেমিনার প্রতি ১ লাখ ৩০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত বাজেট ছিল। প্রতি সেমিনার বাবদ অডিট ও বিল পাসের কথা বলে ২০-৩০ হাজার টাকা নেওয়া হতো যার মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ২ থেকে ৩ কোটি টাকা। যা স্পষ্টতই আত্মসাৎ করা হয়।

তিনি আরও বলেন, প্রতিটি এনডিসি কর্নারে সবুজ বই, রেজিস্ট্রেশন বই, পোস্টার, লিফলেট, গাইডলাইন সরবরাহ করা হতো, যা উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে না ছাপিয়ে বিএমটিএফ থেকে ৮-১০ গুণ বেশি মূল্যে ছাপানো হতো। এটা নিয়ে প্রতি বছরই অডিট আপত্তি হতো। এমনকি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুশাসন ছিল ডিজি অফিসের নিজস্ব প্রিন্টিং প্রেস বা বিজি প্রেস থেকে ছাপানোর জন্য, কিন্তু তা না করে কিছু সংখ্যক ঠিকাদারের যোগসাজশে (ফারহান, হাজী আবুল কালাম) এদের মাধ্যমে বিগত বছরগুলোতে প্রায় দুইশ থেকে তিনশ কোটি টাকার প্রিন্টিং কাজ হয়। এনডিসি কর্নারের জন্য প্রতিবছর প্রায় ১০০ কোটি টাকার ওষুধ ক্রয় করা (ইউসিএল এবং ইডিসিএল বহির্ভূত ওষুধ) হতো সেটাও উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি অনুসরণ না করে ইডিসিএল এবং বিজিবি থেকে এমআরপি রেটে কেনাকাটা করে সরকারের শতশত কোটি টাকা তছরুপ করা হয়।

এনসিডিসির এই সাবেক কর্মকর্তা বলেন, এসব কাজে তার সঙ্গে প্রোগ্রাম ম্যানেজার ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে বিভিন্ন সময় কাজ করেন ডা. আব্দুল আলিম, ডা. সরোয়ার উদ্দিন মিলন, ডা. রাহাত ইকবাল চৌধুরী, ডা. নবিউল ইসলাম, ডা. সজীব রায়, ডা. নুসায়ের চৌধুরী, ডা. শহিদুল ইসলাম শোভন, ডা. দবির, ডা. মারুফ আহমেদ খান, ডা. মোস্তাফিজুর রহমান, ডা. অসীম চক্রবর্তী প্রমুখ।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ‘ভিলেনে’র ভূমিকায় রোবেদ আমিন

কোটা সংস্কার ও পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনার পতনের দাবিতে আন্দোলনে অংশ নিয়ে আহত হওয়া ছাত্র-জনতাকে চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর অভিযোগ রয়েছে স্বাচিপপন্থি চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। এমনকি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. এবিএম খুরশিদ আলমসহ অধিদপ্তরের বেশকিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তারা আহতদের চিকিৎসার ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন। সেই তালিকায় নাম রয়েছে ডা. রোবেদ আমিনেরও।

তার সঙ্গে প্রোগ্রাম ম্যানেজার ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে বিভিন্ন সময় কাজ করেন ডা. আব্দুল আলিম, ডা. সরোয়ার উদ্দিন মিলন, ডা. রাহাত ইকবাল চৌধুরী, ডা. নবিউল ইসলাম, ডা. সজীব রায়, ডা. নুসায়ের চৌধুরী, ডা. শহিদুল ইসলাম শোভন, ডা. দবির, ডা. মারুফ আহমেদ খান, ডা. মোস্তাফিজুর রহমান, ডা. অসীম চক্রবর্তী প্রমুখ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মতে, ফ্যাসিবাদের অনুগত ব্যক্তি হিসেবেই রোবেদ আমিনকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডাইরেক্টর পদে পদায়িত করা হয়। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো তাকেই আবার বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক হিসেবে পদায়ন করেছে। বঞ্চিত চিকিৎসকদের দাবি, ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগী ব্যক্তিকে বিপ্লবের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মহাপরিচালক পদে নিয়োগ প্রদানের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা বৈষম্যের শিকার চিকিৎসক কর্মচারীদের কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ সিদ্ধান্তে অধিকাংশ বঞ্চিতদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তারই বহিঃপ্রকাশ হলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের আন্দোলন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ডা. রোবেদ আমিনকে অনতিবিলম্বে মহাপরিচালকের পদ থেকে প্রত্যাহার করতে হবে। অন্যথায় বৈষম্য বিরোধী চিকিৎসক, কর্মচারীদের ক্ষোভ প্রশমিত হবে না। কারণ ডা. রোবেদ আমিন শুধু অনিয়ম-দুর্নীতি আর গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে মতাদর্শিক পার্থক্যই নয়, তিনি একজন অভ্যাসগত দুর্নীতিপরায়ণ ও নীতিভ্রষ্ট ব্যক্তি।

‘স্বাস্থ্যের সর্বোচ্চ পদে স্বৈরাচারের দোসরদের জায়গা হবে না’

ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ‘ড্যাবে’র কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি মহাসচিব ডা. মো. আব্দুস সালাম বলেন, বিগত সরকারের সুবিধাভোগী লোকদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, নিপসমের পরিচালক, আইপিএইচের পরিচালক পদে পদায়ন করা হয়। আমরা স্বাভাবিকভাবে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মহাপরিচালক (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আমরা আশা করেছিলাম এ মহাপরিচালক পদটিতে যোগ্য ব্যক্তির পদায়ন হবে, যিনি স্বৈরাচারী সরকারের দোসর হবেন না। কিন্তু নতুন পদায়িত ব্যক্তি ডা. রোবেদ আমিন ফ্যাসিবাদের একজন দোসর হিসেবে বিগত সরকারের সব দুর্নীতির সিন্ডিকেটের একজন সক্রিয় সদস্য।

তিনি বলেন, গত ৩ আগস্ট ছাত্র জনতার আন্দোলনের বিরোধিতা করে ফ্যাসিবাদের দোসর চিকিৎসকদের অংশগ্রহণে যে শান্তি সমাবেশ করা হয়েছে, তার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নকারী হিসেবে চিহ্নিত বর্তমানে নিয়োগপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক। ছাত্র জনতার আন্দোলন যে চেতনার বিরুদ্ধে, সেই ফ্যাসিবাদী চেতনার ব্যক্তি, উচ্চাভিলাষী, পদলোভী চিকিৎসককে বৈষম্যবিরোধী চিকিৎসক সমাজ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না।

অধিদপ্তরের অধিকাংশ কর্মকর্তাই দুর্নীতি পরায়ণ : ড্যাব সভাপতি

ড্যাব সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন আল রশীদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা চাই, যিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হবেন, তার অবশ্যই একটা ক্লিন ইমেজ থাকবে। কিন্তু যদি না থাকে, তাহলে তো আমাদের জন্য খুবই লজ্জাজনক। আপনারা জানেন স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের সময়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। যেগুলো নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অসংখ্য রিপোর্টও হয়েছে। যেসব কর্মকর্তারা এতোদিন এই অধিদপ্তর চালিয়েছে, তাদের মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাসহ প্রতিষ্ঠানটির প্রায় অধিকাংশই দুর্নীতি পরায়ণ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে।

অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ মিটিংয়ে ব্যস্ত আছেন বলেন ফোন কেটে দেন রোবেদ আমিন।

তিনি বলেন, আওয়ামী দু’শাসনের এসব অপকর্মের প্রতিবাদে ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে দেশে একটি গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে এবং বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের দায়িত্ব নিয়েছে। এখন সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা হলো স্বাস্থ্য খাতসহ দেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে সৎ এবং দেশপ্রেমী লোকদের পদায়নের মাধ্যমে দেশকে একটা স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে যাওয়া। কিন্তু আমরা দেখছি স্বাস্থ্য খাতের সব প্রতিষ্ঠানেই দুর্নীতিবাজ লোকগুলোকে বসানো হচ্ছে, যা ছাত্র জনতার বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা পরিপন্থি।

ডা. হারুন আল রশীদ আরও বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হচ্ছে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা, এখানে মহাপরিচালক করা হয়েছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের সময়ের একজন দুর্নীতিবাজ চিকিৎসককে। তিনি কীভাবে তাহলে এই প্রতিষ্ঠানটিকে দুর্নীতিমুক্ত করবেন? আমরা চাই তাকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই জায়গা থেকে অপসারণ করা হোক, একইসঙ্গে তার বিরুদ্ধে যতগুলো অভিযোগ এসেছে, সেগুলো তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

যা বলছেন ডা. রোবেদ আমিন

সব বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক রোবেদ আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দায়িত্ব নিলেও এখনো তো বসতেই পারিনি। ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা এখনো অফিস করতে পারেননি। আগামী সপ্তাহে (এই সপ্তাহ) একটা সমাধান হবে বলে আশা করছি।

অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে ব্যস্ত আছেন বলেন ফোন কেটে দেন।

এর আগে অডিট আপত্তির জবাবে দেওয়া এক লিখিত বক্তব্যে ডা. রোবেদ আমিন বলেছেন, আপত্তিতে বর্ণিত কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক খাতের ব্যয়টি অপারেশন প্ল্যানের আওতা বহির্ভূত নয়। কেননা, অপারেশনাল প্ল্যানের মেজর অ্যাক্টিভিটিসে বলা আছে নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ নিয়ন্ত্রণের জন্য এর কার্যক্রম শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সেবা খাতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ বাস্তবায়ন করতে হবে।

টিআই/এসএম