গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে এখন থেকে নিয়োগ পাবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ

সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী উপাচার্য এম আবদুস সোবহান শেষ কর্মদিবসে ১৪১ জনকে নিয়োগ দিয়ে যান। বিষয়টি বেশ সমালোচিত হয়। এরই মধ্যে ওই নিয়োগ বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। ঘটনার তদন্তও শুরু হয়েছে।

শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী উপাচার্য এম আবদুস সোবহান নন, এমন আরও আট উপাচার্যের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য, আর্থিক অনিয়ম এবং উন্নয়ন প্রকল্পের দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত চলছে। কারও কারও বিরুদ্ধে এসব অনিয়মের প্রমাণও মিলেছে। এ নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে প্রধান শিরোনাম হয়েছে বারবার। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তারা ওইসব ঘটনায় বিব্রত না হলেও সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউজিসি বিব্রত। উচ্চ শিক্ষার ইমেজ রক্ষায় এখন সৎ ও কর্মদক্ষ উপাচার্যের খোঁজ করছে সরকার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উপাচার্য নিয়োগের আগে এখন থেকে সম্ভাব্য শিক্ষকদের আমলনামা সংগ্রহ করা হবে। এ বিষয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদনকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। অর্থাৎ, বিভিন্ন সংস্থার গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নিয়োগ পাবেন উপাচার্যরা।

উপাচার্য পদটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহীর পদ। তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেক উপাচার্য নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, এমনকি এলাকাপ্রীতিও করে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও অভ্যন্তরীণ আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এসব অভিযোগ প্রমাণিত হলেও ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিছুই করতে পারে না

বর্তমানে দেশের সাতটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ খালি আছে। আগামী জুনে আরও চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদ ফাঁকা হচ্ছে। সবমিলিয়ে প্রায় এক ডজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ শূন্য হচ্ছে। এসব পদে নিয়োগ পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন সরকারপন্থী শিক্ষকরা।

শেষ কর্মদিবসে ১৪১ জনকে নিয়োগ দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী উপাচার্য এম আবদুস সোবহান

সংশ্লিষ্টরা জানান, উপাচার্য পদটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহীর পদ। তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেক উপাচার্য নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, এমনকি এলাকাপ্রীতিও করে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও অভ্যন্তরীণ আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এসব অভিযোগ প্রমাণিত হলেও ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিছুই করতে পারে না। অন্যদিকে, দলীয় নিয়োগের কারণে অভিযুক্ত উপাচার্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না রাজনৈতিক চাপে। ফলে উপাচার্যরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, নিয়োগ দেওয়ার পর যেহেতু কিছুই করা যায় না, তাই নিয়োগের আগে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা জরুরি। তাই একজন সিনিয়র অধ্যাপককে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার আগে তার অতীত আমলনামা ও পারিবারিক তথ্য যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন। সেজন্য সরকারের নানা সংস্থাকে কাজে লাগানো হয়েছে। চাকরিজীবনে তিনি কোন ধরনের চরিত্রের অধিকারী ছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতি করতে গিয়ে কোন ধরনের ভূমিকা নিয়েছেন, বিরোধীদলীয় শিক্ষকদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন কি না— এসব বিষয় প্রাধান্য দিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘একজন উপাচার্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি একাডেমিক, প্রশাসনিক, নিয়োগ, আর্থিক বিষয়াদির একক প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। তার সার্বিক কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়টি কেমন চলবে। আমরা চাই, ভালো ইমেজের ব্যক্তি উপাচার্য হোক। সেজন্য সৎ, দক্ষ শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য কাজ চলছে।’

বর্তমানে দেশের সাতটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ খালি আছে। আগামী জুনে আরও চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদ ফাঁকা হচ্ছে। সবমিলিয়ে প্রায় এক ডজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ শূন্য হচ্ছে

বর্তমানে শূন্য এবং আগামী জুনে ফাঁকা হবে এমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসি নিয়োগে এখনই প্রক্রিয়া শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় বলছে, ৩০ জুন পর্যন্ত ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ শূন্য হচ্ছে।

দলীয়ভাবে নিয়োগ হওয়ায় বিতর্কিত উপাচার্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া যায় না 

শূন্য যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের পদ

বর্তমানে সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ দুই মেয়াদ শেষ করে গত ৬ মে অবসরে গেছেন আলোচিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান। মার্চ মাসে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ ফাঁকা হয়। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়ার মেয়াদ শেষ হয় ২৩ মার্চ। এর ছয় দিন পর ২৯ মার্চ নতুন উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক ডা. শরফুদ্দিন আহমেদকে এখানে নিয়োগ দেয় সরকার।

২০ মার্চ অবসরে যান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মীজানুর রহমান এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) অধ্যাপক আবদুল মান্নান। এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দুই মেয়াদ কাটিয়ে গত ৪ মার্চ বিদায় নিয়েছেন অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ। বিশ্ববিদ্যালয়টির শীর্ষ তিন পদ ভিসি, পো-ভিসি ও ট্রেজারর পদটি শূন্য রয়েছে। বর্তমানে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন উপাচার্যের রুটিন দায়িত্বে আছেন।

এর বাইরে আরও ১৩ উপাচার্যের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে তদন্ত শেষ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। মোট ২১ উপাচার্যের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বেশির ভাগই স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ, ভবন নির্মাণ ও কেনাকাটায় আর্থিক দুর্নীতিসংক্রান্ত

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদটি গত ৪ জানুয়ারি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মেয়াদ ২৯ জানুয়ারি এবং হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মেয়াদ ৩১ জানুয়ারি শেষ হয়।

শেষ হচ্ছে যাদের মেয়াদ

চলতি (মে) মাসের ১৯ তারিখ যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের মেয়াদ শেষ হবে। গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরকৃবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. গিয়াস উদ্দীন মিয়া ও রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষের ১০ জুন এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচিত উপাচার্য অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর ১৩ জুন মেয়াদ শেষ হবে।

তদন্ত চলছে যেসব উপাচার্যের বিরুদ্ধে

মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অন্তত আট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এর মধ্যে মেয়াদ থাকা অবস্থায়ও তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির তদন্ত করেছে শিক্ষা প্রশাসন। অনিয়মের প্রমাণও মিলেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোনো উপাচার্যের বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নজির নেই। ইউজিসি অভিযুক্ত ব্যক্তি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে তদন্ত করলেও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের এখতিয়ার রাখে না।

উপাচার্য পদটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহীর পদ। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায় দুর্নীতিগ্রস্তও হন তিনি

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে- খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে শেষের দুটির সাবেক এবং প্রথম ছয়টির বর্তমান উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।

এর বাইরে আরও ১৩ উপাচার্যের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে তদন্ত শেষ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। মোট ২১ উপাচার্যের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বেশির ভাগই স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ, ভবন নির্মাণ ও কেনাকাটায় আর্থিক দুর্নীতিসংক্রান্ত।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ কেন— জানতে চাইলে সদ্য মেয়াদ শেষ করা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-উপাচার্য প্রফেসর হারুন-অর-রশিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এর পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছ। তার মধ্যে অন্যতম হলো- স্থানীয় রাজনৈতিক ও প্রভাবশালীদের চাপ। একজন উপাচার্যকে শান্তি মতো মেয়াদ শেষ করতে স্থানীয়দের ম্যানেজ করে চলতে হয়। এর মধ্যে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনও রয়েছে।’ তার মতে, ‘এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়োগ দেওয়ার প্রবণতা কমাতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমিও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই মেয়াদ সুনামের সঙ্গে শেষ করেছি। আমার ওপরও নানা চাপ ছিল। তবে এগুলো কৌশলে মোকাবিলা করেছি। নিয়োগের ক্ষেত্রে নিজের এলাকা বা আত্মীয়-স্বজনকে আমলে নিইনি। একজন উপাচার্যকে সম্পূর্ণ লোভের বাইরে থাকতে হবে। তাহলে সব না হলে অধিকাংশ দুর্নীতি থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।’

এনএম/এমএআর/