বিল মারুফ বিন বারিক / ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগে পড়েছেন বিল মারুফ বিন বারিক। ৩৮তম বিসিএসে পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম হন। অথচ অদৃশ্য কারণে গেজেট থেকে ছিটকে পড়েন তিনি। কারণ জানতে পুলিশ, প্রশাসন ও মন্ত্রণালয়— সব জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করেছেন। কিন্তু কোনো সদুত্তর পাননি।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২৮ থেকে ৪২তম বিসিএস পর্যন্ত বাদ পড়া ২৫৯ জনকে নিয়োগ দেয়। সেই তালিকায় আছেন বিল মারুফ বিন বারিক। 

সরকারি কর্ম কমিশনের মেধাক্রম অনুযায়ী সুপারিশ পেয়েও গেজেটভুক্ত না হওয়ায় দীর্ঘ চার বছর এক মাস ১৫ দিনের দুঃসহ সময়ের বর্ণনা দিয়েছেন মারুফ। উন্মোচন করেছেন জীবনের বাঁকে বাঁকে ঘটে যাওয়া নানা অধ্যায়। তার মুখোমুখি হয়েছেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক মুছা মল্লিক।

ঢাকা পোস্ট : আপনার জন্ম ও বেড়ে ওঠা নিয়ে জানতে চাই।

বিল মারুফ বিন বারিক : আমার জন্ম নওগাঁ জেলায়। সেখানেই বেড়ে ওঠা। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা এ জেলাতে। খুবই সাধারণভাবে কেটেছে আমার ছেলেবেলা।

ঢাকা পোস্ট : নিজেকে নিয়ে তিন বাক্যে বলতে বললে কী বলবেন?

বিল মারুফ বিন বারিক : চেষ্টা করি বিনয়ী হতে। আমার মাধ্যমে কেউ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সর্বশেষ, সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পছন্দ করি।

ঢাকা পোস্ট : ৩৮তম বিসিএসে পররাষ্ট্র ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার বিষয়টি জানার পর কেমন অনুভূতি ছিল?

বিল মারুফ বিন বারিক : তখন করোনা মহামারি চলছিল। আমি একটি পাওয়ার প্লান্টে কাজ করি। সেখানে স্ত্রীকে নিয়ে থাকতাম। রেস্ট্রিক্টেড এরিয়া হওয়ায় আমরা বেশি বের হতাম না। যেদিন রেজাল্ট দেয় সেদিন সার্ভার জ্যাম ছিল, পিডিএফটা পাওয়া যাচ্ছিল না। রোল নম্বর সার্চ করে দেখার সুযোগ ছিল না। তবে, অনেকে রেজাল্টের ছবি ফেসবুকে দিয়েছিল। সেখানে নিজের রোল খুঁজতে শুরু করি।

যেহেতু প্রথম পছন্দ ছিল পররাষ্ট্র ক্যাডার, তাই কৌতূহল নিয়েই দেখতে লাগলাম। প্রথম রোল নম্বরটি আমার পরিচিত মনে হলো। পরে অ্যাডমিট কার্ড মিলিয়ে দেখি এটা আমারই নম্বর। সব অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। সেই মুহূর্তের অনুভূতিটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। পরে মাকে জানালাম। সেজদারত হয়ে আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করলাম।

স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে প্রথম হতে চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম হওয়াটা ছিল অপ্রত্যাশিত আনন্দের।

ঢাকা পোস্ট : পিএসসির সুপারিশে পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম হলেন কিন্তু গেজেটে নাম নেই। এটা জানার পর কেমন অনুভূতি হয়েছিল?

বিল মারুফ বিন বারিক : গেজেটে নাম না দেখে আমার কাছে পৃথিবীটা খুব ছোট হয়ে এসেছিল। মনে হচ্ছিল চারদিকে অন্ধকার। কোথাও কেউ নেই, কোনো পথও জানা নেই। পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করলাম। সেখান থেকে কোনো সাড়া পেলাম না। যার কাছেই যাই সবাই দেখি মুখ ফিরিয়ে নেয়। সবাই এমনভাবে কথা বলছিল যেন তাদের সামনে একটা অন্যায় কথা বলেছি।

তবে, এমন অনেক মানুষও পেয়েছি যারা খুব হেল্প করেছে। তাও কোনো কাজ হয়নি। এরপর একটা সময় পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে শুরু করলাম। তবে, সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাসের পারদ আমার মনকে প্রশান্ত রেখেছে। আমি জানতাম সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা সবসময় উত্তম।

ঢাকা পোস্ট : গেজেট থেকে বাদ পড়ার পেছনে কী কারণ ছিল বলে মনে করেন? 

বিল মারুফ বিন বারিক : কারণ জানতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে দৌড়ঝাঁপ করেছি। আমার এলাকার পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসকের অফিসে গেছি। প্রকৃত কারণ কেউ বলেননি। আমার বাবা বিসিক শিল্প উন্নয়ন সমিতির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার কথা বলার প্রয়োজন হতো। আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করতেন। এসব বিষয়ই হয়তো তারা বিবেচনায় নিয়েছে। এ ছাড়া আমার বাবা দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি কমিউনিস্ট পার্টি করতেন।

ঢাকা পোস্ট : সেই দিনগুলোতে পেছন থেকে কেউ অনুপ্রেরণা দিয়েছে কি না?

বিল মারুফ বিন বারিক : আমার বাবা-মা ও স্ত্রী আমাকে সাহস দিয়েছেন। আমার চাচাও আমার জন্য অনেক দৌড়ঝাঁপ করেছেন। দুঃসহ সেই সময়ে অনেক মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে। একজনের নাম বলা সম্ভব না। জীবনে এমন কিছু মানুষ থাকে যারা অপরের কল্যাণে নিজের সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করেন। আমার জীবনে এমন কিছু মানুষ পেয়েছিলাম। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

ঢাকা পোস্ট : এবার নিজেকে কোথায় দেখতে চান? 

বিল মারুফ বিন বারিক : কখনও ভাবিনি সুযোগটা পাব। যেহেতু সুযোগ পেয়েছি নিজেকে একজন ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট হিসেবে দেখতে চাই। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে চাই।

ঢাকা পোস্ট : বুয়েট থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করে সিভিল সার্ভিসে কেন এলেন?

বিল মারুফ বিন বারিক : অনেকেই মনে করেন দেশ এত অর্থ দিয়ে প্রকৌশলী তৈরি করেছেন অথচ অনেকে সেই জ্ঞানটা কাজে না লাগিয়ে অন্যদিকে ঝুঁকছেন। আমি বিষয়টির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। সবাইকে ইঞ্জিনিয়ারই হতে হবে— এটা ঠিক না। ইঞ্জিনিয়াররা দেশের চলমান প্রক্রিয়ায় পলিসি মেকিংয়ে ভূমিকা রাখার সুযোগ পান না। একটি বিরূপ পরিস্থিতিতে সমস্যা সমাধান বা মোকাবিলা করায় আমাদের যে সক্ষমতা রয়েছে সেটি ফরেন সার্ভিসে কাজে লাগানো সম্ভব।

ঢাকা পোস্ট : সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েও গেজেটেড না হওয়ার দায় কার? কোথায় সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন?

বিল মারুফ বিন বারিক : একজন সুপারিশপ্রাপ্ত হলেন, কিন্তু তাকে চূড়ান্ত নিয়োগ দেওয়া হলো না। কেন দেওয়া হলো না— রাষ্ট্রের কাছে এর একটি যৌক্তিক কারণ ও ব্যাখ্যা থাকতে হবে। এটি মূলত পলিসির সমস্যা। রাজনৈতিক বিবেচনায় বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়াটি আনঅফিসিয়াল। কারও সঙ্গেই এমন বৈষম্য না হোক— এটাই প্রত্যাশা।

ঢাকা পোস্ট : বিসিএস পরীক্ষা দিতে যারা আগ্রহী তাদের কী পরামর্শ দেবেন?

বিল মারুফ বিন বারিক : খুব পড়াশোনা করলেই ভালো ফল আসবে, বিষয়টি এমন না। আমার ভেতরে কোয়ালিটি আছে কি না, সেটিই বিবেচ্য বিষয়।

ঢাকা পোস্ট : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

বিল মারুফ বিন বারিক : আপনাকেও ধন্যবাদ। ঢাকা পোস্টের জন্য শুভকামনা।

এমএম/এমএসএ