দেশের নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে জীবন-দক্ষতা ও মৌলিক সাক্ষরতা অর্জনে সহায়তা করতে একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। সেই প্রকল্পে এনজিও পার্টনার নিয়োগ ও চুক্তি নবায়নের নামে আড়াই কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক (ডিজি) আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি মোহাম্মদপুরে তার বাসায় ৫১ লাখ টাকা নগদ লেনদেনের একটি ভিডিও ফুটেজ ঢাকা পোস্টের হাতে এসেছে। বাকি টাকা বিভিন্ন সময় এনজিওগুলোর কাছ থেকে নিয়েছেন তিনি।

মহাপরিচালকের এমন বেপরোয়া দুর্নীতির হাত থেকে রেহাই পেতে গত রোববার (২৫ আগস্ট) প্রাথমিক শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করেছে কয়েকটি এনজিও। গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেছেন, প্রত্যেকটি অভিযোগ আমলে নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধান বলছে, গত ২৯ জুলাই ছাত্র বিক্ষোভের মধ্যে কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন বিটিআই লিগ্যাল হাইটস বিল্ডিংয়ে শিক্ষা ব্যুরোর ডিজির ফ্ল্যাটে যান ১৪টি এনজিওর কর্তাব্যক্তিরা। তাদের চুক্তি নবায়ন এবং নতুন করে পার্টনার না দেওয়ার জন্য ডিজিকে ৫১ লাখ টাকার ঘুষ দেন তারা। প্লাস্টিকের বাজারের ব্যাগে করে সেই টাকা ডিজির হাতে তুলে দেন। এসময় এনজিও কর্তাব্যক্তিদের বলতে শোনা যায়— স্যার টাকাটা গুনে নেন। ডিজি বলেন, আমি টাকা গুনে ঘুষ নিই না। এরপর তিনি সেই ব্যাগ নিয়ে ভেতরের রুমে চলে যান।

ভুক্তভোগী এক এনজিওপ্রধান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমান ডিজি ২০২৩ সালের মার্চ মাসে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোতে পদায়ন পাওয়ার পর থেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠেন। ছয় মাস পরপর চুক্তি নবায়ন করতে হয়। আমাদের নবায়নের ফাইল এলেই আটকে দিতেন তিনি। নানা অজুহাতে ঢাকায় ডেকে ‍চুক্তি নবায়নের পাশাপাশি প্রত্যেক এনজিওকে নতুন করে ৩ থেকে ৮ জন পার্টনার এনজিও নেওয়ার জন্য চাপ দিতেন। তার এই অনৈতিক চাপে দিশাহারা হয়ে আমরা ১৪ জন এনজিও কর্মকর্তা একসঙ্গে মিটিং করে চাহিদা অনুযায়ী ৫১ লাখ টাকা তার বাসায় দিয়ে আসি। লেনদেনের প্রমাণ রাখার জন্য গোপনে একটি ভিডিও করে রাখি।

এই ১৪টির বাইরে আরও ১১ এনজিওর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা জানান, ডিজি দুইভাবে টাকা নিতেন। একটি চুক্তি নবায়ন আরেকটি পার্টনার নিয়োগের নামে। উনার ঘুষের আলাদা রেট ছিল। পার্টনার ৩ থেকে ৫ লাখ, চুক্তি নবায়ন দুই লাখ টাকা। এ ছাড়া, পার্টনার নিতে না চাইলে প্রতি এনজিও থেকে ধরন অনুযায়ী নিতেন ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা।

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর নথি বলছে, গত ২ জুন থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত অন্তত ৫১টি জেলার লিড এনজিওর কাছে পার্টনার নিতে চিঠি দেন বর্তমান ডিজি। প্রত্যেকটি চিঠিতে তার স্বাক্ষর রয়েছে। কোনো কোনো এনজিওকে এক সপ্তাহ সময় বেঁধে চিঠি দেন তিনি। এর মধ্যে পার্টনার না নিলে প্রকল্পের চুক্তি বাতিল এবং কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।

এরপরই মাঠপর্যায়ে এনজিওদের মধ্যে আতষ্ক সৃষ্টি হয়। তখন কর্মকর্তারা নানাভাবে যোগাযোগ করলে পার্টনার না নিলে ৩ থেকে ৫ লাখ, চুক্তি নবায়নে দুই লাখ টাকা বেঁধে দেন ডিজি। এরপর গত এক মাসে অন্তত ৪০টি এনজিও ডিজির বাসায় গিয়ে টাকা দিয়ে আসেন। এর মধ্যে ১৪টি এনজিও দিয়েছে ৫১ লাখ টাকা, যার ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে।

এনজিও কর্ণধারদের দাবি, শুধু জুন-জুলাই মাসে চিঠি দিয়ে তিনি আমাদের কাছ থেকে কমপক্ষে আড়াই কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন।

একাধিক এনজিওপ্রধান বলেন, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর ডিজি বুঝতে পেরেছেন তিনি এখানে থাকতে পারবেন না। এরপর আরও বেপরোয়া হয়ে সাতদিনের মধ্যে পার্টনার নেওয়ার সময় বেঁধে দেন তিনি।

টাকা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ঘুষ খাই না।

ভিডিওর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই টাকা ঘুষের নয়, আমার জমি বিক্রির টাকা। কোথায় জমি বিক্রি করেছেন— এমন প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেন।

পুরো অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব ফরিদ আহাম্মদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, জোর করে পার্টনার দেওয়ার কোনো বিধান নেই। তিনি যদি তা করে থাকেন সেটি বেআইনি। কোনো ভুক্তভোগী অভিযোগ করলে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঘুষ নেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যারা ঘুষ দিয়েছেন তারা যদি অভিযোগ করেন দ্রুত তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ করবেন কি না— জানতে চাইলে দুই এনজিওপ্রধান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘুষের বিষয়ে আমরা অভিযোগ করলে চিহ্নিত হয়ে যাব। তখন তিনি আমাদের আরও বেশি হয়রানি করবেন।

ডিজিকে বদলি করলেই কেবল অভিযোগ করবেন— এমন ভাষ্য তাদের। আদালতে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন কয়েকজন।

যেভাবে বিক্রি হতো এনজিও পার্টনারশিপ

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর একাধিক কর্মকর্তা ও এনজিও প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, ৬৪ জেলায় ঝরে পড়া শিশু-কিশোরদের শিক্ষার আওতায় আনতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আওতায় ২০২০ সালে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন (সাব-কম্পোনেন্ট ২.৫ আউট অব স্কুল চিলড্রেন(ওওএসসি) প্রোগ্রাম, পিইডিপি-৪ কর্মসূচি গ্রহণ করে। বাংলাদেশ সরকার, বিশ্বব্যাংক, ইউনিসেফের যৌথ অর্থায়নে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রত্যেক জেলা থেকে একটি লিড এনজিও নির্বাচন করা হয়। এই লিড এনজিও যদি মনে করে তবে নিজেই পার্টনার (অংশীদার) নেওয়ার জন্য অধিদপ্তরে চিঠি দেবে।

চিঠিতে পার্টনার হিসেবে নেওয়ার জন্য ৫ বছরের অভিজ্ঞতা, ৩ বছরের অডিট রিপার্টসহ বিস্তারিত জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়। অধিদপ্তর সেগুলো যাচাই-বাছাই করে পার্টনারশিপের অনুমতি দেয়। কিন্তু বর্তমান ডিজি করেছেন উল্টোটা। তিনি নিজেই লিড এজেন্সির কাঁধে জোর করে পার্টনার চাপিয়ে দিয়েছেন। অন্তত ৫১টি জেলায় লিড এনজিওকে পার্টনার হিসেবে নেওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছেন। যে চিঠিগুলো ঢাকা পোস্টের হাতে এসেছে।

গত ২ জুন রাঙ্গামাটির লিড এনজিও আশ্রয় অঙ্গন সোসাইটির নির্বাহী পরিচালককে পার্টনার হিসেবে মাতারবাড়ী বহুমুখী সমাজ কল্যাণ সংস্থাকে নেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়। একই তারিখে চিঠি দেওয়া হয় রাঙ্গামাটির আরেকটি এনজিও প্রোগ্রেসিভকে। নেত্রকোণায় সোসিও ইকোনমিক অ্যান্ড রুরাল এ্যাডভান্সমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনকেও (সেরা) চিঠি দেওয়া হয়। গত ১৩ জুলাই একই চিঠি দেওয়া হয় গাইবান্ধার মানব কল্যাণ স্বাবলম্বী সংস্থাকে। সেখানে সমাজ উন্নয়ন পল্লী সংস্থাকে পার্টনার হিসেবে নিয়োগের জন্য বলা হয়।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিজি আবুল কালাম আজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, পার্টনার দেওয়ার বিষয়টি চুক্তিতে বলা আছে, এটা নতুন কিছু নয়।

পার্টনার ডিজি দেবে নাকি এনজিও চাহিদা পাঠাবে— এমন প্রশ্নে ক্ষেপে গিয়ে তিনি বলেন, আমি কাকে দেব, সেটি কি আপনাকে জিজ্ঞেস করে দেব?

এদিকে ডিজির ঘুষ গ্রহণ ছাড়াও প্রকল্পটি নিয়ে আরও বেশকিছু অভিযোগ রয়েছে। ২০২০ সালে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন (সাব-কম্পোনেন্ট ২.৫’ আউট অব স্কুল চিলড্রেন প্রোগ্রাম, পিইডিপি-৪) প্রকল্প নেওয়ার পর সাবেক ডিজি তপন কুমার ঘোষের বিরুদ্ধে এনজিও নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি ও শত কোটি টাকার ঘুষ-বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। এরপর একাধিক সংবাদ প্রকাশের পর গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রাথমিক সুপারিশের পর তপন কুমারকে ওই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

এনএম/এমজে