আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং মাদারীপুর-৩ (কালকিনি-ডাসার-সদর একাংশ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান গোলাপের যুক্তরাষ্ট্রে ৯টি বাড়ি কেনাসহ অর্থ পাচারের অনুসন্ধান নিয়ে এখনও ধোঁয়াশায় রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করার পর দুদকের গঠিত বিশেষ টিম নথিপত্র তলবসহ কিছু নথিপত্র সংগ্রহ করলেও প্রকৃত তথ্য উদঘাটন করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রে আসলেই গোলাপের নামে বাড়ি রয়েছে কি না তা যাচাই-বাছাইয়ে তারা এমএলএআর (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রিকোয়েস্ট) পাঠায় ২০২৩ সালের ২০ জুন। মাঝে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একাধিকবার তাগিদপত্র দিলেও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে তথ্য বা ফিরতে চিঠি পায়নি সংস্থাটি। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচারের বিষয়টি আপাতত প্রমাণ করা কঠিন বলেই মনে করছে দুদক।

অভিযোগ ছিল গোলাপের নিউইয়র্কে মোট ৯টি প্রপার্টি বা সম্পত্তির (ফ্ল্যাট বা বাড়ি) মালিক। ওইসব সম্পত্তির মূল্য ৪০ লাখ ডলারের বেশি। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪৩ কোটি টাকা (এক ডলার সমান ১০৮ টাকা ধরে)।

যদিও বিদেশে অর্থ পাচারের বাইরে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে তার বিরুদ্ধে নতুন করে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পৃথক আরও একটি অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। এর মধ্যেই গত ২৫ আগস্ট রাজধানীর ১২/১ পশ্চিম নাখালপাড়ার বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন।

আবদুস সোবহান গোলাপ ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মাদারীপুর-৩ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের পদ পান

এ বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা (মহাপরিচালক) ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেহেতু মূল অভিযোগই হলো টাকা পাচার ও যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি কেনার। তাই ওই অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ে অবশ্যই বিদেশের তথ্য-উপাত্ত লাগবে। তাছাড়া নিউইয়র্কে তার বাড়ির ঠিকানাসহ এমএলএআর পাঠানোর পর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। একাধিকবার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে তাগিদপত্র দেওয়া হয়েছে। আমরা অপেক্ষা করছি যুক্তরাষ্ট্র থেকে কি জবাব পাই তার জন্য। গোলাপের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ নিয়েও নতুন করে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। এখন দেশে তার কি কি সম্পদ পাওয়া যায়, সেটা অনুসন্ধান করা হবে।

আবদুস সোবহান গোলাপ ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মাদারীপুর-৩ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের পদ পান।

অভিযোগ ছিল গোলাপের নিউইয়র্কে মোট ৯টি প্রপার্টি বা সম্পত্তির (ফ্ল্যাট বা বাড়ি) মালিক। ওইসব সম্পত্তির মূল্য ৪০ লাখ ডলারের বেশি। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪৩ কোটি টাকা (এক ডলার সমান ১০৮ টাকা ধরে)

অন্যের জমি দখল করে নিজ নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করার অভিযোগে গোলাপের বিরুদ্ধে চলতি বছরের জুনে পাঁচটি মামলা করেছেন পাঁচজন ভুক্তভোগী। তাদের অভিযোগ, সংসদ সদস্য থাকার সময় জোরজবরদস্তির প্রতিবাদ করলে হামলা ও মামলার ভয় দেখানো হয়। দেরিতে হলেও আদালতের কাছে ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা করছেন তারা। এ ছাড়াও কোটাবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশনা দেওয়ার মামলার আসামি তিনি।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচার ও বাড়ি থাকার বিষয়ে দুদকে দাখিল হওয়া অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, আবদুস সোবহান গোলাপ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক এবং অন্য দেশে একাধিক বাড়ি কিনেছেন। তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনী হলফনামায় এ তথ্য গোপন করেছেন। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। তথ্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক ‘অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট’ বা ওসিসিআরপি তাদের ওয়েবসাইটে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মো. আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ৪০ লাখ ডলার ব্যয়ে একাধিক বাড়ি কিনেছেন।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মো. আবদুস সোবহান মিয়া ২০১৪ সালে প্রথম নিউইয়র্কে অ্যাপার্টমেন্ট কেনা শুরু করেন। ওই বছর নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস এলাকায় একটি সুউচ্চ ভবনে অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন তিনি। পরের পাঁচ বছরে তিনি নিউইয়র্কে একে একে মোট ৯টি প্রপার্টি বা সম্পত্তির (ফ্ল্যাট বা বাড়ি) মালিক হন। এসব সম্পত্তির মূল্য ৪০ লাখ ডলারের বেশি (প্রতিবেদনটি প্রকাশের সময়ের ডলারের বিনিময় মূল্য অনুযায়ী প্রায় ৪২ কোটি টাকা)।

প্রতিবেদন বলছে, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে মোহাম্মদ আবদুস সোবহান মিয়া জ্যাকসন হাইটসের একটি আলিশান ভবনে পাঁচটি কনডোমিনিয়াম কিনেছিলেন, ওই সময়ে যার দাম ছিল প্রায় ২ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ২৫ কোটি টাকা)। এর কাছাকাছি কয়েকটি ভবনে তিনি আরও তিনটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন, যার দাম ৬ লাখ ৮০ হাজার ডলার (প্রায় ৭ কোটি টাকা)। আর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে জ্যাকসন হাইটসে আরও একটি সম্পত্তি কিনেছেন প্রায় ১ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার (প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টাকা) মূল্যে। এসব সম্পত্তির সবই নগদ টাকায় কেনা হয়েছিল।

২০২৩ সালের ১৩ জানুয়ারি প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ’৮০র দশকে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর মোহাম্মদ আবদুস সোবহান মিয়া কম বেতনের কাজ– পিজ্জা তৈরি, ওষুধের দোকানে কাজ, লাইসেন্স ছাড়া ট্যাক্সি চালাতেন বলে জানিয়েছেন তার সহকর্মীরা। এসব কাজ থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে এভাবে অ্যাপার্টমেন্ট বা বাড়ি কেনা সম্ভব না। এসব সম্পত্তি কিনতে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাঠানো হয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কেননা, বাংলাদেশ থেকে সম্পত্তি কেনার জন্য বিদেশে অর্থ পাঠানোর সুযোগ নেই।

ওই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে এ বিষয়ে রিট দাখিল হলে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ আবদুস সোবহান মিয়ার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ৯টি বাড়ি কেনার বিষয়ে অনুসন্ধান করতে দুদককে নির্দেশ দেন।

এমএলএআর কী?

এমএলএআরের পূর্ণাঙ্গ রূপ– মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট। যা অভিযোগ সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার এক ধরনের চিঠি বা আবেদন। একটি দেশের দায়িত্বশীল সংস্থা সুনির্দিষ্ট তথ্যের বিষয়ে জানতে অন্য দেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার কাছে আইনি প্রক্রিয়ায় এ ধরনের এমএলএআর প্রেরণ করে থাকে। জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনে (আনকাক) সই করা দেশগুলোর মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানে এমএলএআর বেশি ব্যবহৃত হয়। এর আগে বাংলাদেশ থেকে আগে অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে এমএলএআর প্রেরণ করা হতো। বর্তমানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এমএলএআর প্রেরণ করা হয়।

আরএম/এসএসএইচ