নামিদামি হোটেলে ‘অসহনীয়’ কোয়ারেন্টাইনের ভার
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে দেশে ফিরলেই ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক। তবে যেখানে-সেখানে নয়, থাকতে হবে সরকার নির্ধারিত নামিদামি হোটেলে। ফলে করোনাকালে অতিরিক্ত উড়োজাহাজ ভাড়ার সঙ্গে বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের হোটেল ভাড়া।
প্রবাসীরা বলছেন, সরকার প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের জন্য যে ২৮টি হোটেল নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেগুলোতে সর্বনিম্ন ভাড়া চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। সর্বোচ্চ ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা। ১৪ দিন এসব হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে তাদের প্রায় দুই মাসের সমপরিমাণ বেতন বা তারও বেশি অর্থ খরচ হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
ইতালি থেকে আসা তারেক আব্দুল্লাহ বলেন, ‘সরকার প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের যে নিয়ম করেছে, তা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। অন্যান্য দেশে সরকারি তত্ত্বাবধানে কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা হয়। সাধারণ মানুষের চেয়ে কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিরা আরও স্বাচ্ছন্দ্যে থাকেন। আর বাংলাদেশের চিত্র উল্টো।’
সরকার প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের জন্য যে ২৮টি হোটেল নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেগুলোতে সর্বনিম্ন ভাড়া চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। সর্বোচ্চ ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা। ১৪ দিন এসব হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে তাদের প্রায় দুই মাসের সমপরিমাণ বেতন বা তারও বেশি অর্থ খরচ হচ্ছে
তিনি বলেন, ‘আমি ইতালির একটি রেস্টুরেন্টে দৈনিক ৭ ঘণ্টা কাজ করি, মাসে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭২ হাজার টাকার মতো আয় করি। সব খরচ বাদ দিয়ে আমার ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা থাকে। করোনাকালে ৭৫ হাজার টাকা প্লেন ভাড়া দিয়ে দেশে ফিরলাম। দেশে ফিরে আরও ৯৮ হাজার টাকা দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে হোটেলে থাকছি। এমন জুলুম বন্ধ চাই।’
দুবাই প্রবাসী আবির হাসনাত ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘৪৮ থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পুড়ে মাসে ৩২ হাজার টাকা পাই। সেখানে ১০ হাজার টাকায় একটি রুমে ছয়জন ভাড়া থাকি। অথচ দেশে দৈনিক পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা দিয়ে হোটেল ভাড়া করে থাকতে হচ্ছে। কোয়ারেন্টাইনের নামে আমাদের দুই মাসের সমপরিমাণ বেতন নেওয়া হচ্ছে। এটা তো উচিত হয়। দুই বছরে একবার দেশে আসি। এমন হলে টিকে থাকতে পারব না। সরকারকে এসব নামিদামি ও ব্যয়বহুল হোটেলের বিকল্প ভাবা উচিত।’
সরকার নির্ধারিত হোটেলের খরচ আকাশচুম্বী
সর্বশেষ ১৫ এপ্রিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ২৮টি হোটেলে প্রবাসীদের কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা রেখে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সেগুলো হলো- হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, বেঙ্গল ক্যানারি পার্ক লিমিটেড, সিক্স সিজন্স হোটেল, ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট, রেডিসন ব্লু ঢাকা ওয়াটার গার্ডেন, হোটেল বেঙ্গল ইন, হোটেল স্প্রিং হিল অ্যাপার্টমেন্ট, রয়্যাল পার্ক রেসিডেন্স হোটেল, প্লাটিনাম রেসিডেন্স, গ্যালেসিয়া হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট লিমিটেড, হোটেল প্লাটিনাম, হোটেল গার্ডেন রেসিডেন্স, স্কাইলিংক লিমিটেড, হোটেল দ্য রহমানিয়া ইন্টারন্যাশনাল, হলিডে এক্সপ্রেস, ওয়েস্ট পার্ক ইন রেসিডেন্স, ন্যাসেন্ট গার্ডেনিয়া, এনকারেজ দ্য রেসিডেন্স, ব্লু ক্যাসল হোটেল, রাফ্রেসিয়া সার্ভিসড অ্যাপার্টমেন্ট, লেকশোর হোটেল, দ্য ওয়ে ঢাকা, ডরিন হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট (সাবেক ফোর পয়েন্ট বাই শেরাটন), ন্যাসেন্ট গার্ডেনিয়া রেসিডেন্স, রেনেসাঁ ঢাকা গুলশান হোটেল, প্রিয় নিবাস স্টাইলিশ রেসিডেনশিয়াল হোটেল ও হোটেল অ্যারিস্টোক্রেট ইন লিমিটেড।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় হোটেল প্লাটিনাম, হোটেল গার্ডেন রেসিডেন্স, স্কাইলিংক লিমিটেড, হোটেল দ্য রহমানিয়া ইন্টারন্যাশনাল, হলিডে এক্সপ্রেস নামের পাঁচটি আবাসিক হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। তালিকার মধ্যে এ পাঁচটির খরচ সবচেয়ে কম।
হোটেল প্লাটিনামের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাদের এখানে একজনের কোয়ারেন্টাইন ও তিন বেলা থাকা-খাওয়ার খরচ মিলে প্রতিদিনের জন্য তিন হাজার ৭০০ টাকা দিতে হয়। হোটেল গার্ডেন রেসিডেন্সে চার হাজার, স্কাইলিংক লিমিটেডে চার হাজার, হোটেল দ্য রহমানিয়া ইন্টারন্যাশনালে চার হাজার এবং হলিডে এক্সপ্রেসে খরচ হয় চার হাজার টাকা।
এছাড়া রেডিসন, ইন্টারকন্টিনেন্টালের মতো পাঁচ তারকা হোটেলে প্রতি দিনের কোয়ারেন্টাইনের খরচ ১৮ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা।
আবুধাবি থেকে বাংলাদেশে এসে দুই মাস পর আবারও আবুধাবি ফিরে গেছেন শেখ রাসেল। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি আবুধাবির ডানাহ এলাকায় থাকি। দেশ থেকে ডানাহতে ফেরার পর আমাকে ১০ দিনের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছিল। সেখানে আমিসহ তিনজনকে একটি বিশাল রুমে রাখা হয়। সেই রুমে একটি এসি, একটি ফ্রিজ, তিনটি টেবিল, তিনটি চেয়ার, তিনটি কম্বল, তিনটি বেড, তিনটি টাওয়েল, সাবান, শ্যাম্পু, টুথপেস্ট-ব্রাশ সব আলাদা আলাদা ছিল। এছাড়া ১০ দিনে দুবার লন্ড্রিতে কাপড় ধুয়ে দিয়েছে। প্রতিদিন অঢেল খাবার-দাবার দিয়েছে। এর সবকিছুই দিয়েছে বিনামূল্যে। অথচ আমাদের দেশে বিনামূল্যে তো দূরের কথা, টাকা দিয়েও এমন সার্ভিস পাওয়া যায় না।
প্রবাসীদের বাঁচাতে দ্রুত কোয়ারেন্টাইনের খরচ কমানো অথবা সরকারিভাবে কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা উচিত বলে মন্তব্য তার।
বেবিচক যা বলছে
প্রবাসীদের কোয়ারেন্টাইনের মেয়াদ কমানোর পুনর্বিবেচনার বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম. মফিদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘করোনায় আক্রান্ত অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো থেকে আসা যাত্রীদের জন্য হোটেলে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া বাহরাইন, কুয়েত ও কাতারের ক্ষেত্রে তিন দিনের কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক। আপাতত করোনার প্রাদুর্ভাব বিবেচনায় কোয়ারেন্টাইন পুনর্বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই।’
এর আগে ১ মে থেকে শর্তসাপেক্ষে আন্তর্জাতিক কমার্শিয়াল ফ্লাইট চালুর সিদ্ধান্ত নেয় বেবিচক। তবে ফ্লাইট চালুর ক্ষেত্রে ৩৮টি দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ও অতি ঝুঁকিপূর্ণ বলে তালিকা করে তারা। এসব দেশ থেকে আগতদের কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক করা হয়।
বেবিচক জানায়, ৩৮ দেশের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ২৩ দেশ থেকে ফিরলে ১৪ দিন হোটেলে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। দেশগুলো হলো- ইরাক, ইতালি, লাটভিয়া, লিথুনিয়া, নেদারল্যান্ড, প্যারাগুয়ে, পেরু, স্লোভেনিয়া, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, তুরস্ক, অস্ট্রিয়া, আজারবাইজান, বেলজিয়াম, চিলি, ক্রোয়েশিয়া, এস্তোনিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, হাঙ্গেরি ও উরুগুয়ে।
এছাড়া বাহরাইন, কুয়েত ও কাতারের ক্ষেত্রে তিন দিন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। এ তিন দেশের যাত্রীরা সরকারি কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে থাকার সুবিধা পাবেন। দেশে আসার তিন দিন পর যাত্রীদের করোনা টেস্ট করানো হবে (যাত্রীর খরচে)। রিপোর্ট নেগেটিভ এলে তারা বাকি ১১ দিন বাড়িতে গিয়ে কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন।
বেবিচকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ৩৮ দেশের মধ্যে বাকি ১২টি দেশ থেকে বাংলাদেশে আসা যাবে না। দেশগুলো হলো- ভারত, ওমান, ইরান, মঙ্গোলিয়া, সাইপ্রাস, জর্জিয়া, সাউথ আফ্রিকা, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, কোস্টারিকা ও তিউনিসিয়া। তবে সরকারের অনুমতি নিয়ে এ দেশগুলো থেকে বাংলাদেশি নাগরিক দেশে আসতে পারবেন। এক্ষেত্রে তাদের নিজ খরচে সরকার নির্ধারিত হোটেলে বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে।
এআর/আরএইচ/এমএআর/