করোনাকালে প্রবীণ নিবাস
অভিমান ভুলে ফোন করি, কষ্ট নিয়ে রাখি
অভিমান আর অপমান ভুলে ফোন করি, কথা বলি ছেলে-মেয়ের সঙ্গে। আবেগ নিয়ে ফোন করলেও, রাখি কষ্ট নিয়ে। হঠাৎ হঠাৎ ছেলেটা এসে দেখে যেত আমাকে, ভালো লাগত। তবে করোনার কারণে গত নয় মাস কারও দেখা নেই। আমি বন্দি নিবাসে, করোনায় ছেলে বন্দি প্রবাসে। মেয়ে কখনো আসে না দেখতে। এভাবেই বেঁচে আছি...
ভীষণ অভিমান আর কষ্ট বুকে চেপে আগারগাঁও প্রবীণ নিবাসে উঠেছেন উম্মে কুলসুম (ছদ্মনাম)। আইনজীবী হিসেবে দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন। অধ্যাপক স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলে-মেয়ের বৈরি আচরণে মনঃকষ্ট নিয়ে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপনের পথ বেছে নেন। চলে আসেন আগারগাঁও প্রবীণ নিবাসে।
বিজ্ঞাপন
অনেকটা বন্দি জীবনের কষ্টটা নির্দ্বিধায় প্রকাশ করলেও পরিবার-ছেলে-মেয়ে সম্পর্কে বিশেষ তথ্য দিতে রাজি হননি তিনি। বলেন, ‘আমি চাই না আমার ছবি প্রকাশ হোক। সন্তানরা ভালো থাকুক। আমার একাকিত্ব ওদের কষ্ট দিক, তা চাই না।’
তাদের মধ্যে রয়েছেন চিকিৎসক, শিক্ষক, আইনজীবী, বেসরকারি উন্নয়ন কর্মকর্তা ও চিত্রশিল্পী। পরিবার ছেড়ে এখানে আশ্রয় নেওয়া প্রবীণদের প্রত্যেকের বিষাদের গল্পও ভিন্ন
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন কমিশন ভবনের ঠিক সামনে অবস্থিত ‘প্রবীণ নিবাস’। শুধু উম্মে কুলসুম নন, এখানে থাকা প্রবীণদের সঙ্গে পরিবার-পরিজনের যোগাযোগ বা সাক্ষাৎ এমনিতেই তেমন একটা নেই। করোনা অতিমারির ভয় জেঁকে বসায় সেটা আরও কমে গেছে।
প্রবীণ এ নিবাসে ধারণক্ষমতা ৫০ জন, বর্তমানে আছেন ৪৩ জন। সার্বক্ষণিক দেখভালে তিনজন নার্স ও দু’জন আয়া নিয়োজিত আছেন। রয়েছে নামাজের কক্ষ, লাইব্রেরি, বসার কক্ষসহ টিভি দেখার ব্যবস্থা। জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনে রয়েছে অ্যাম্বুলেন্স। প্রবীণদের জন্য পাশেই গড়ে তোলা প্রবীণ হাসপাতালে রয়েছে সকল অসুখের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থাও।
সেখানে থাকা প্রবীণদের দেখভালে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, করোনায় বাইরের জগতের ন্যায় বদলে গেছে প্রবীণ নিবাসের অবস্থাও। এখানে অনেক নিয়মের পরিবর্তন আনা হয়েছে। বাইরের খাবার যেমন অ্যালাউ করা হচ্ছে না তেমনি নিকটাত্মীয় ব্যতীত দেখা-সাক্ষাৎও করা হয়েছে সীমিত। প্রবীণদের করোনা সুরক্ষার জন্য মাস্ক সরবরাহের পাশাপাশি রয়েছে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থাও।
‘বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ’ ও ‘জরা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান’ (বাইগাম)- এর পরিচালনায় এ নিবাসের বেশির ভাগ প্রবীণই সম্ভ্রান্ত পরিবারের। তাদের মধ্যে রয়েছেন ডাক্তার, শিক্ষক, আইনজীবী, বেসরকারি উন্নয়ন কর্মকর্তা ও চিত্রশিল্পী। পরিবার ছেড়ে এখানে আশ্রয় নেওয়া প্রবীণদের প্রত্যেকের বিষাদের গল্পও ভিন্ন।
প্রবীণ নিবাস সূত্রে জানা গেছে, একজন প্রবীণকে সিঙেল কক্ষে থাকার জন্য মাসে দিতে হয় পাঁচ হাজার টাকা। এক কক্ষে দু’জন থাকলে ছয় হাজার টাকা। খাবার বাবদ খরচ আরও তিন হাজার টাকা। এ খরচ প্রবীণ সদস্য বা তার পরিবারের সদস্যদেরই বহন করতে হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রবীণ নিবাস ভবনের সামনে বড় হরফে লেখা ‘সম্মানের সাথে প্রবীণদের সেবা দিন, সকলে বার্ধক্যের প্রস্তুতি নিন’।
অসুস্থতার মধ্যে আছে করোনা আতঙ্ক
প্রবীণ নিবাসে বসবাসকারীদের বয়স ৫০-এর ঊর্ধ্বে। কম-বেশি নানা অসুখে ভুগছেন তারা। প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে প্রবীণ হাসপাতালে। নেই করোনা টেস্টের ব্যবস্থা। তবে, করোনার উপসর্গ দেখা দিলে পাশের ইসলামিক ফাউন্ডেশন ভবনে টেস্টের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রবীণ হাসপাতালেই করোনা থেকে শুশ্রূষার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
করোনাকালে কেমন আছেন প্রবীণ নিবাসীরা— জানতে চাইলে চিত্রশিল্পী শেখ মুজিবুল হক (৮০) ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি একা। একা থাকতেই এখন ভালো লাগে। হঠাৎ হঠাৎ পরিবার-সন্তানদের দেখতে মন চায়। এখানে বিশেষ কোনো সমস্যা নেই। খাবারের মান আগের চেয়ে ভালো। করোনার ভয় আছে। রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ায়- এমন ওষুধ সরবরাহ করছে নিবাস কর্তৃপক্ষ।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা নিজেরা কথা বলি। কাউকে না পেলে নিজে নিজে কথা বলি। আকাশের পানে তাকিয়ে থাকি। ছবি আঁকি। কখনো জীবজন্তুর ছবি আঁকিনি। তবে করোনায় বদলে যাওয়া জীববৈচিত্র্য এবং বদলে যাওয়া প্রকৃতি আমাকে ভীষণ অবাক করে। এসব নিয়েই ভাবি। প্রকৃতির ছবি আঁকি।’
করোনাক্রান্তের খবরেও মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি সন্তান
আট মাস আগে প্রবীণ নিবাসে গর্ভধারিণী মাহমুদা আলমকে রেখে যান সন্তান। খরচও দিচ্ছিলেন নিয়মিত। হঠাৎ করোনাক্রান্ত হন মাহমুদা আলম। নিবাস থেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু জামালপুরে থাকা সন্তান-পরিবার কেউ টেলিফোন কল রিসিভ করেননি।
প্রবীণ নিবাসের তত্ত্বাবধায়ক আঞ্জুমান জাহিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার সব উপসর্গ দেখা দেওয়ায় মাহমুদা আলমকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে নিয়ে টেস্ট করানো হয়। পজিটিভ রিপোর্ট আসার পর তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কেউ নিতে আসেননি বা সহযোগিতা করেননি। দুই দিন পর অবস্থা খুব খারাপ হলে তার এক ভাতিজা এসে বাড়ি নিয়ে যান। পরদিনই ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার।
এ বিষয়ে বাইগাম-এর সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল মান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এই প্রবীণ নিবাস নিয়ে অনেক অভিযোগ ছিল। আমরা সব অভিযোগের নিষ্পত্তি ঘটাতে কাজ করছি। খাবারের মান ভালো করেছি। সার্বক্ষণিক আয়া-নার্সরা সেবা দিচ্ছেন। সবার কক্ষে বেল সিস্টেম চালু করেছি। বেল চাপলেই কক্ষে চলে যান নার্স কিংবা আয়া।’
তিনি আরও বলেন, এটা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। সরকারি সহায়তা খুব কমই পাই। প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই খরচ বহন করতে হয়। এখানকার অধিকাংশ নিবাসীই সম্ভ্রান্ত। কেউ চিকিৎসক, কেউ শিক্ষক, কেউ আইনজীবী অথবা বেসরকারি উন্নয়ন কর্মকর্তা ছিলেন। নিজেদের খরচ নিজেরাই বহন করেন তারা।
জেইউ/এমএআর/জেএস