সামান্য বৃষ্টিতে রাজধানীর অলিগলি ও প্রধান সড়কগুলো পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি একটু দীর্ঘ সময় স্থায়ী হলে রীতিমতো ‘ডুবে যায়’ ঢাকা শহর। হাঁটু ও কোমর সমান পানিতে নাকাল হন নগরবাসী। অথচ জলাবদ্ধতা নিরসনে বহু প্রকল্প ও পদক্ষেপ হাতে নিয়ে প্রচুর টাকা খরচ করেছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে দুই সিটি কর্পোরেশন প্রায় ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিল, কাজও হয়েছে কিছু। কিন্তু গত শুক্রবারের বৃষ্টির ফল বুঝিয়ে দিয়েছে নগরবাসীকে। তাদের প্রশ্ন, জলাবদ্ধতা নিরসনে এত এত বাজেট, লাভ কী হলো?

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বরাদ্দের ২০০ কোটি টাকার মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) জলাবদ্ধতা নিরসনে সরাসরি ৯০ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখে। এ ছাড়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের (খাল, জলাশয়, নর্দমা পরিষ্কার) জন্য বরাদ্দ রাখা হয় ৩০ কোটি টাকা, খাল-পুকুর ও জলাশয় পুনরুদ্ধারে আরও দুই কোটি টাকা এবং পানির পাম্প ক্রয় ও স্থাপনে আরও এক কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জলাবদ্ধতা নিরসনে পাম্প হাউজের যন্ত্রপাতি আধুনিকীকরণ, উন্নয়ন ও ক্রয়ে বরাদ্দ রাখে ২৫ কোটি টাকা। খালের উন্নয়ন, সীমানা নির্ধারণ ও বৃক্ষরোপণে বরাদ্দ রাখে আরও ৩৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া, নর্দমা পরিষ্কারে ১১ কোটি, খাল পরিষ্কারে পাঁচ কোটি, খাল-কালভার্ট মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে ১০ কোটি, পাম্প হাউজ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে আট কোটি, লেক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে তারা।

জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) সরাসরি ৯০ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখে। এ ছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের (খাল, জলাশয়, নর্দমা পরিষ্কার) জন্য বরাদ্দ রাখা হয় ৩০ কোটি টাকা, খাল-পুকুর ও জলাশয় পুনরুদ্ধারে আরও দুই কোটি টাকা এবং পানির পাম্প ক্রয় ও স্থাপনে আরও এক কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়

গত কয়েক বছর ধরে দেখা যায়, বর্ষা মৌসুম মানেই জলাবদ্ধতা। জলজটে নাকাল হতে হয় নগরবাসীকে। অথচ প্রতি বছরই জলাবদ্ধতা নিরসনে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেয় সরকার। বছর বছর অর্থ বরাদ্দের পরিমাণও বাড়ে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। ক্ষেত্রবিশেষ ভোগান্তির পরিমাণও বাড়ে।

একসময় রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার। পরে রাজধানীর সব নালা ও খাল দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে ঢাকা ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা গত ১৫ বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলেও সমস্যা যেন নগরবাসীর পিছু ছাড়ছে না।

আগে ঢাকা মহানগরীর প্রধান প্রধান ড্রেন লাইন নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার। শাখা লাইনগুলোর দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের ওপর ন্যস্ত ছিল। ওই সময় রাজধানীর মোট ড্রেনেজ লাইনের মধ্যে ৩৮৫ কিলোমিটার ঢাকা ওয়াসার অধীন এবং প্রায় দুই হাজার ৫০০ কিলোমিটার ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের অধীনে ছিল। এর বাইরে ৭৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ২৬টি খাল এবং ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ছিল ঢাকা ওয়াসার। যে কারণে বর্ষায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে সংস্থাগুলো একে অন্যের ওপর দায় চাপানোর সুযোগ পেত।

কিন্তু ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর থেকে রাজধানীর জলাবদ্ধতার সব দায় এসে পড়ে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ওপর। তারাও গত চার বছরে রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ৭৩০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে।

কেন বারবার ডুবছে ঢাকা শহর, ক্ষুব্ধ নগরবাসী

সামান্য বৃষ্টিতে রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হওয়ায় দুই সিটি কর্পোরেশনের ওপর ক্ষুব্ধ নগরবাসী। তারা বলছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের এত পরিকল্পনা আর প্রকল্পের ছড়াছড়ি, তবুও কেন বারবার ডুবছে ঢাকা শহর? হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে এত প্রকল্পের ফল কী?

রাজধানীর আরামবাগ এলাকার বাসিন্দা ও বেসরকারি চাকরিজীবী খাদিমুল ইসলাম বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি কর্পোরেশন যে কোনো কাজ করে, এটা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়। গত শুক্রবার আরামবাগ এলাকায় কোমর সমান পানি জমেছিল। অলিগলি ভরে গিয়েছিল হাঁটু পানিতে। এটি শুধু এক দিনের বিষয় নয়, বৃষ্টি হলেই এভাবে পানি জমে রাজধানীজুড়ে। তাহলে সিটি কর্পোরেশন কি আসলেই কাজ করে? এ প্রশ্ন এখন সাধারণ নাগরিকদের। যদি তারা কাজ করে তাহলে কিছুটা হলেও জলাবদ্ধতা কম হতো, কিন্তু প্রতিবারই কেন এমন জলাবদ্ধতা হয়?

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনে পাম্প হাউজের যন্ত্রপাতি আধুনিকীকরণ, উন্নয়ন ও ক্রয়ে বরাদ্দ রাখে ২৫ কোটি টাকা। খালের উন্নয়ন, সীমানা নির্ধারণ ও বৃক্ষরোপণে বরাদ্দ রাখে আরও ৩৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া, নর্দমা পরিষ্কারে ১১ কোটি, খাল পরিষ্কারে পাঁচ কোটি, খাল-কালভার্ট মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে ১০ কোটি, পাম্প হাউজ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে আট কোটি, লেক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে তারা

শেওড়াপাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা রইস উদ্দিন বলেন, প্রতি বছর বৃষ্টি হলে আমাদের এলাকাসহ পুরো ঢাকা পানিতে তলিয়ে যায়। রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের, কিন্তু তারা কী কাজ করে, কীভাবে কাজ করে, আমরা তো কোনো প্রভাব দেখতে পাই না। বৃষ্টি মানেই রাজধানীতে জলাবদ্ধতা, হাঁটু পানি, কোমর পানি। প্রতিবার যদি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাহলে আসলেই তারা কাজ করে কি না, এটি নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় রাজধানী ছেড়ে অন্যত্র চলে যাই।

কেন এই জলাবদ্ধতা

বৃষ্টি হলেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে রাজধানীর নিউ মার্কেট, আজিমপুর, নীলক্ষেত, বকশিবাজার, মালিবাগ, শান্তিনগর, সায়েদাবাদ, শনির আখড়া, পুরান ঢাকা, বংশাল, নাজিমুদ্দিন রোড, ধানমন্ডি, মিরপুর, শেওড়াপাড়া, আরামবাগ, মতিঝিল, বনানী, খিলক্ষেত, উত্তরার কিছু অংশ, কারওয়ান বাজার, বিজয় সরণি, মিরপুর ১৩, হাতিরঝিলের কিছু অংশ, আগারগাঁও থেকে জাহাঙ্গীর গেট যেতে নতুন রাস্তা, খামারবাড়ি থেকে ফার্মগেট, ফার্মগেট-তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকা, মোহাম্মদপুরের কিছু অংশ, মেরুল বাড্ডা, ডিআইটি প্রজেক্ট, গুলশান লেকপাড় এলাকার সংযোগ সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক ও অলিগলিতে জলাবদ্ধতা দেখা যায় নিয়মিত। গত শুক্রবারের টানা ছয় ঘণ্টার বৃষ্টিতে ঢাকা শহরের বেশিরভাগ এলাকা ডুবে যায়। এ দিন ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এত দিন শুধু খাল থেকে ভাসমান বর্জ্য অপসারণ করেছে। খাল খনন, পানিপ্রবাহ এখনও সেভাবে ঠিক হয়নি। যে কারণে মূলত জলাবদ্ধতা নিরসনে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া বর্জ্যের কারণে ড্রেন দিয়ে মূল প্রবাহে পানি নেমে যেতে পারছে না।

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, ঢাকার পানি তিনটি মাধ্যমে আশপাশের নদ-নদীতে গিয়ে পড়ে। এগুলো হচ্ছে- পাম্প স্টেশন, স্লুইসগেট ও খাল। বর্তমানে বেশ কয়েকটি পাম্প স্টেশন নষ্ট হয়ে আছে। একইভাবে স্লুইসগেটগুলোও অকেজো অবস্থায় আছে। আর খালগুলোর অবস্থা ভালো নয়, সেগুলো পানি প্রবাহের জন্য উপযুক্ত নয়। অবৈধ দখলের পাশাপাশি নানা বর্জ্য জমে খালগুলোতে কয়েক স্তরের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে।

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় প্রতিদিন প্রায় সাত হাজার টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। এর মধ্যে প্রায় ১৫ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য। এগুলো ঢাকার ড্রেন, নালা আর খালে গিয়ে পড়ছে। এসব বর্জ্য খালে বা ড্রেনে আটকে থাকছে, যে কারণে পানি নামতে পারছে না। আবার কিছু খাল এখনও দখল অবস্থায় আছে। বাকিগুলো যেভাবে সংকুচিত করা হয়েছে, তা দিয়ে পানির প্রবাহ সম্ভব নয়। ফলে বৃষ্টি হলেই পানিতে নিমজ্জিত হচ্ছে রাজধানী ঢাকা।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

নগর বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকৃতিভিত্তিক পরিকল্পনা হাতে নেওয়া উচিত। অর্থাৎ বিদ্যমান  খাল ও ড্রেনগুলো আধুনিক করতে হবে। খালগুলো দখলমুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি ড্রেনগুলো পরিপূর্ণভাবে সচল করতে হবে। এ ছাড়া ড্রেনেজ ব্যবস্থা কংক্রিটে আচ্ছাদিত না করে প্রাকৃতিকভাবে পানি যেন শোষিত হয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

ঢাকার যত পানি সংরক্ষণাগার অর্থাৎ খাল, পুকুরগুলো সংকুচিত হয়েছে। অনেকগুলো হারিয়ে গেছে। এগুলো ফিরিয়ে আনার কাজ করতে হবে। পাশাপাশি হাতিরঝিলের মতো আরও বেশকিছু পরিকল্পনা দরকার। একই সঙ্গে ঢাকা ও আশপাশের নদীর সঙ্গে ড্রেনের পানি প্রবাহের নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে। ড্রেনগুলোর ধারণক্ষমতা ১০০ মিলিমিটারে নিয়ে যেতে হবে।

এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, একটি আদর্শ শহরে এমন ব্যবস্থা থাকতে হয় যেন ৪০ শতাংশ পানি মাটির নিচে চলে যায়। ঢাকার জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানে এখনও কোনো কাজ দৃশ্যমান নয়। অন্যদিকে, খাল ও নর্দমাগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টি হলেই রাজধানীতে পানি আটকে যাচ্ছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস বলেন, জলাবদ্ধতাপ্রবণ মোট ১৬১টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে এবং নিজস্ব অর্থায়নে জলাবদ্ধতা নিরসনে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে। পাশাপাশি এটি নিরসনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন খাল, বক্স কালভার্ট ও নর্দমা থেকে বাৎসরিক সূচি অনুযায়ী বর্জ্য ও পলি অপসারণ করা হচ্ছে।

জলাবদ্ধতার বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, খালগুলো বুঝে পাওয়ার পর থেকে আমরা কাজ করছি। বেশকিছু খাল দখলমুক্ত করে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। পাশাপাশি ওয়াটার লগিং হটস্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার, ড্রেনের পানির লেভেল পরীক্ষা এবং অতিবৃষ্টির সময় কল্যাণপুর থেকে শক্তিশালী পাম্পের সাহায্যে দ্রুত পানি সরিয়ে নদীতে স্থানান্তর করা হচ্ছে। আমাদের জায়গা থেকে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আসলে নগরবাসী সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হলে আমাদের জন্য সব কাজ করা সহজ হবে।

যা বলছেন দায়িত্বরত কর্তারা

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, গত শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সময়ে ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এরপরও দুপুর দেড়টা পর্যন্ত বৃষ্টি অব্যাহত ছিল। এটি স্বাভাবিক মাত্রার চাইতে অনেক বেশি। একইসঙ্গে আমরা দেখেছি, নর্দমাগুলোর ৫০ ফুট অন্তর যে ক্যাচপিট রয়েছে সেগুলো ঠিক মতো পানি নিষ্কাশন করতে পারছে না। নগরবাসী অভ্যাসগত কারণে যত্রতত্র পলিথিন ও প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্য ফেলছে। বৃষ্টি হলে সেগুলো ক্যাচপিটে গিয়ে জমা হয়। আমরা লোকবল দিয়ে একদিকে পরিষ্কার করছি, অন্যদিকে সেগুলো ফের আটকে যাচ্ছে। ফলে, পানি সরতে দেরি হচ্ছে। আর পানি সরতে বিলম্ব হলে স্বাভাবিকভাবে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়।

‘পানি সরে যাওয়ার জন্য স্লুইস গেটগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছ থেকে ২০২১ সালে ৫৫টি স্লুইস গেইট ও রেগুলেটর পেয়েছি। এর মধ্যে ৩৭টি বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এবং বাকি ১৮টি কামরাঙ্গীরচরে অবস্থিত। আমরা সব স্লুইস গেট সচল করেছি। কিন্তু সারাদেশে অতি বৃষ্টি হওয়ায় ঢাকা শহর ঘিরে চারপাশের যে নদ-নদীগুলো রয়েছে সেগুলোর পানির স্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে স্লুইস গেট দিয়ে সক্ষমতা অনুযায়ী পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব হচ্ছে না। এটিও পানি সরতে বিলম্ব হওয়ার অন্যতম কারণ।’

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় প্রতিদিন প্রায় সাত হাজার টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। এর মধ্যে প্রায় ১৫ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য। এগুলো ঢাকার ড্রেন, নালা আর খালে গিয়ে পড়ছে। এসব বর্জ্য খালে বা ড্রেনে আটকে থাকছে, যে কারণে পানি নামতে পারছে না। আবার কিছু খাল এখনও দখল অবস্থায় আছে। বাকিগুলো যেভাবে সংকুচিত করা হয়েছে, তা দিয়ে পানির প্রবাহ সম্ভব নয়। ফলে বৃষ্টি হলেই পানিতে নিমজ্জিত হচ্ছে রাজধানী ঢাকা

বরাদ্দ হওয়া অর্থ জলাবদ্ধতা নিরসন কাজেই ব্যবহার করা হচ্ছে— জানিয়ে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ২৬টি স্থানে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। বাকি ২৬টি স্থানে এগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কাজ চলমান থাকলে কি এগুলো থেকে তাৎক্ষণিক ফল পাওয়া যাবে? কাজ শেষ হওয়া বা অন্য কাজগুলোর সঙ্গে সমন্বয় হওয়ার পর ফল দেখা যাবে। আমাদের অনেক কাজ হয়েছে, অনেক কাজ চলমান আছে। আশা করি, কাজগুলো শেষ হলে ঢাকার জলাবদ্ধতা অনেকাংশে কমে যাবে।

এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, রামচন্দ্রপুর খাল, গুলশান লেক, প্যারিস বা বাইশটেকি খাল, সুতিভোলা খাল ও রাজউক খাল থেকে দুই লাখ ৫৮ হাজার টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ওয়াটার লগিং হটস্পট চিহ্নিতকরণ করা হয়েছে। নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার করা হচ্ছে। বরাদ্দ দেওয়া অর্থে বেশকিছু কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আরও অনেক কাজ চলমান। কাজগুলো শেষ হলে জলাবদ্ধতা সমস্যার অনেকটা সমাধান হবে।

কোন খালের দায়িত্বে কে, পরিকল্পনায় যা আছে

ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকৃতিভিত্তিক পরিকল্পনার ওপর জোর দিয়েছেন সবাই। সেক্ষেত্রে বিদ্যমান খালগুলো দখলমুক্ত এবং হারিয়ে যাওয়া খালগুলো পুনরুদ্ধারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। জানা যায়, খালের দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর এর সীমানা নির্ধারণের কাজ করতে চেয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। কিন্তু পুরো কাজ এখনও শেষ হয়নি। কোথাও সিএস, কোথাও আরএস এবং কোথাও মহানগর জরিপ ধরে খালের সীমানা নির্ধারণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি খালের আধুনিকায়নে একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও তার কোনো অগ্রগতি নেই।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়, তাদের আওতায় থাকা রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রের একটি বড় অংশের বৃষ্টির পানি মান্ডা, জিরানী, শ্যামপুর ও কালুনগর খাল হয়ে নিষ্কাশন হয়। এ চারটি খালের দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটার। কাগজে-কলমে খালগুলো থাকলেও বাস্তবে দখল ও ভরাটে অচল হয়ে আছে। মূলত এ কারণে ঢাকার দক্ষিণে জলাবদ্ধতা বেশি দেখা যাচ্ছে।

সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, খালগুলো পুনরুদ্ধার এবং সেখানে নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য ৮৯৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকার খালগুলোর মধ্যে রয়েছে- কল্যাণপুর ঙ খাল, কল্যাণপুর চ খাল, রূপনগর প্রধান খাল, রূপনগর শাখা খাল- আরামবাগ, রূপনগর শাখা খাল- দুয়ারীপাড়া, রূপনগর শাখা খাল- চিড়িয়াখানা, মিরপুর দিয়াবাড়ী খাল, ইব্রাহিমপুর খাল, বাউনিয়া খাল, শাহজাদপুর খাল, সূতিভোলা খাল, ডুমিনি খাল, বোয়ালিয়া খাল, গোবিন্দপুর খাল, নরাই খাল, আব্দুল্লাহপুর খাল, দ্বিগুণ খাল, ধউর খাল, বাইশটেকি খাল, সাংবাদিক কলোনি খাল, কসাইবাড়ী খাল, মহাখালী খাল, উত্তর দিয়াবাড়ী খাল, বেগুনবাড়ী খাল, কাটাসুর খাল, রামচন্দ্রপুর খাল, কল্যাণপুর প্রধান খাল, কল্যাণপুর ক খাল, কল্যাণপুর খ খাল এবং কল্যাণপুর ঘ খাল।

অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের খালগুলোর মধ্যে রয়েছে- মান্ডা খাল, হাজারীবাগ খাল, শ্যামপুর খাল, জিয়া সরণি খাল, সুতিভোলা খাল, কদমতলা খাল, বাসাবো খাল, তিতাস খাল, শাহজাহানপুর খাল, নন্দীপাড়া খাল, বেগুনবাড়ি খাল, কাটাসুর খাল, খিলগাঁও-বাসাবো খাল, জিরানী খাল, কুতুবখালী খাল, খিলগাঁও খাল, দোলাইরপাড় খাল, কাজলা খাল, ফকিরখালী খাল, সুকুরসি খাল, ডগাইর খাল, বাইগদা খাল, মৃধাবাড়ী খাল, মাতুয়াইল কবরস্থান খাল এবং সেগুনবাগিচা খাল। তবে, এর বাইরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) এলাকায় ডিএসসিসির আওতাভুক্ত অংশে ১৫টি খাল রয়েছে। যেগুলো পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে। এগুলোও সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে।

এএসএস/এমজে