একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গাড়িচালক হিসেবে কাজ করেন বশির আহমেদ। তিনি যে গাড়িটি চালান তা গ্যাসচালিত। সাধারণত গ্যাস নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি চেষ্টা করেন সিলিন্ডার পুরোপুরি ভর্তি করে নিতে। এতে নির্বিঘ্নে দুদিন গাড়ি চালানো যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রিফুয়েলিং স্টেশনগুলোতে চরম গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে বিপাকে পড়েছেন বশির। গ্যাস নেওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আবার চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসও পাওয়া যাচ্ছে না।

ঢাকা পোস্টকে বশির আহমেদ বলেন, সম্প্রতি গ্যাসের সমস্যা অনেক বেড়েছে। কোনো কোনো পাম্পে তো গ্যাস পাওয়াই যাচ্ছে না। আবার যেগুলোতে পাওয়া যায় সেখানে দীর্ঘ সারি। কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর যখন গ্যাস নিতে যাই, তখন দেখি চাপ কম। অর্থাৎ এক হাজার টাকার গ্যাস চাইলে ৫০০ টাকার পাওয়া যায়। এ গ্যাস দিয়ে সারা দিন গাড়ি চলে না। ফলে আবারও গ্যাস নিতে আসতে হয়।

সম্প্রতি গ্যাসের সমস্যা অনেক বেড়েছে। কোনো কোনো পাম্পে তো গ্যাস পাওয়াই যাচ্ছে না। আবার যেগুলোতে পাওয়া যায় সেখানে দীর্ঘ সারি। কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর যখন গ্যাস ভরার সময় হয়, তখন দেখা যায় চাপ কম। অর্থাৎ এক হাজার টাকার গ্যাস চাইলে ৫০০ টাকার পাওয়া যায়। এ গ্যাস দিয়ে সারা দিন গাড়ি চলানো যায় না। ফলে আবারও গ্যাস নিতে আসতে হচ্ছে চালকদের

সিএনজি গ্যাসের এমন সংকটে ভুক্তভোগী হচ্ছেন বশির আহমেদের মতো অসংখ্য চালক ও মালিক। দেশের প্রায় ৫০০ রিফুয়েলিং স্টেশনের কোনোটিতে গ্যাসই নেই। যেগুলোতে রয়েছে সেগুলোর চাপ খুবই কম।

সিএনজি স্টেশনগুলোতে দীর্ঘ লাইন

রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকায় অবস্থিত সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনগুলোর মধ্যে ডিএল ফিলিং স্টেশন অন্যতম। গত সোমবার স্টেশনটিতে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ৩০টি ব্যক্তিগত গাড়ি গ্যাস নেওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ। লাইনে গ্যাসের চাপ কম থাকায় প্রতিটি গাড়িতে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় গ্যাস ভরতে বেশি সময় লাগছে। ফলে লাইনের সর্বশেষ গাড়ির চালক জানেন না কখন গ্যাস নিতে পারবেন।

গ্যাস নেওয়ার অপেক্ষায় রিফিলিং স্টেশনের পাশে গাড়ির সারি / ছবি- সংগৃহীত

কথা হয় চালক মোমেন উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রায় এক ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। কখন সিরিয়াল আসবে বলতে পারছি না। আবার সিরিয়াল পেলেও দেখা যাবে চাপ কম থাকায় ট্যাংকি ফুল করতে পারব না।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গাড়ি চালান বিল্লাল হোসেন, অফিস বনানীতে। গাড়িতে গ্যাস নেওয়ার জন্য কয়েকটা ফিলিং স্টেশন ঘুরে ব্যর্থ হয়েছেন। শেষে সিরিয়াল দিয়েছেন ডিএল ফিলিং স্টেশনে। তিনি বলেন, প্রথমে গেলাম কুড়িলের একটি স্টেশনে। সেখান থেকে নিকুঞ্জ, কিন্তু কোথাও গ্যাস মিলল না। অবশেষে এখানে এসে সিরিয়াল দিলাম।

দেশে অবস্থিত এলএনজি টার্মিনালের মধ্যে সামিটের টার্মিনাল জাতীয় গ্রিডে দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর টার্মিনালটির কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সমপরিমাণ গ্যাসের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে সিএনজি ফিলিং স্টেশনসহ শিল্পকারখানা, বিদ্যুৎ ও আবাসিক খাতে

সময় মতো উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্যাস নিতে না পারায় প্রায়ই সমস্যার মুখে পড়তে হয় বলে জানান বিল্লাল। বলেন, ‘অফিসে প্রায় সময়ই গাড়ির দরকার পড়ে। ধরেন, গ্যাসের জন্য সিরিয়ালে অপেক্ষা করছি, এ সময় অফিস থেকে কল আসল। তখন বলতে হয়, গ্যাসের জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু অফিস সেটি বুঝতে চায় না, সমস্যায় পড়তে হয়।’

আবার দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত গ্যাস। বিল্লাল বলেন, আমার গাড়ি সর্বোচ্চ ১০ লিটার গ্যাস নিতে পারে। কিন্তু সেখানে আমি পাব হয়তো পাঁচ থেকে ছয় লিটার। এটা সারা দিনের জন্য যথেষ্ট না। ফলে আবার আমাকে আবার গ্যাস নিতে আসতে হতে পারে। অর্থাৎ ওয়ার্কিং টাইমের কয়েক ঘণ্টা অপচয় হচ্ছে গ্যাস নিতে গিয়ে।

শুধু ব্যক্তিগত গাড়ি নয়, সিএনজি অটোরিকশাও বেকায়দায় পড়েছে গ্যাস সংকটে / ছবি- সংগৃহীত

বশির হয়তো এমন অপচয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না। কিন্তু মোর্শেদ আলমের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। উবারচালক মোর্শেদ গ্যাস ভরার সময়ে অন্তত দুটি ট্রিপ মিস করেছেন। তিনি বলেন, সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে গ্যাস নিতে যে সময় অপচয় হচ্ছে, সেই সময়ে আমি দুটি ট্রিপ দিতে পারতাম। কিন্তু সেটি করতে পারছি না। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।

গ্যাসের এই ভোগান্তি এড়াতে অনেকেই গাড়িতে তেল ভরছেন, যা বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যয়। তবে, উবারচালকদের ক্ষেত্রে বিষয়টি ব্যয়বহুল বিধায় ট্রিপের ভাড়াও বেড়ে যাচ্ছে। এটি আবার যাত্রীদের ঘাড়ে পড়ছে। ভাড়া নিয়ে উভয়পক্ষকে বচসায় জড়াতে হচ্ছে।

একই স্টেশনে অপেক্ষারত উবারচালক সেলিম বলেন, যেখানে গ্যাসের দাম প্রতি লিটার ৪৩ টাকা, সেখানে তেলের লিটার ১৩১ টাকা। আমাদের খরচ তো বাড়ছেই, তাই ট্রিপের ভাড়াও সেভাবে নেওয়া লাগছে।

সংকটের বোঝা সিএনজিচালকদের ঘাড়ে

ব্যক্তিগত গাড়ির ক্ষেত্রে গ্যাসের বদলে তেল নেওয়ার সুযোগ থাকলেও সিএনজি অটোরিকশার ক্ষেত্রে তা একেবারেই নেই। ফলে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে গ্যাস না নেওয়া পর্যন্ত চাকা ঘুরবে না বাহনটির।

গ্যাস না পাওয়ায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন উবারচালক ও ফিলিং স্টেশনের মালিকরা / ছবি- সংগৃহীত

মহাখালীর এবিএন সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনে সকাল থেকে সারি সারি সিএনজি অটোরিকশার চালককে গ্যাস নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। কথা হয় সিএনজিচালক আমজাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, সম্প্রতি গ্যাসের সমস্যা অনেক বেড়েছে। কয়েকটি জায়গা ঘুরেও গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও আবার সিরিয়াল অনেক বেশি। দেখা গেল, গ্যাস নিতে নিতে দুপুর হয়ে যায়। এ সময়ে কয়েকটি ট্রিপ মারতে পারতাম, সব-ই লস।

আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন— জানিয়ে চালক আবদুল করিম বলেন, গাড়িতে গ্যাস ভরার জন্য যে সময় নষ্ট হয়, সে সময়ে অন্তত চার থেকে পাঁচটি ট্রিপ দেওয়া সম্ভব। গ্যাসের এ সংকটের কারণে অন্যান্য গাড়ির তুলনায় আমরা বেশি বিপদে পড়েছি। কোনো স্টেশনেই গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। যেখানে পাওয়া যায়, সেখানেই সিরিয়াল। আবার দেখা যায়, গ্যাস পেলেও চাপ না থাকায় সিলিন্ডার ফুল করা যায় না। সবমিলিয়ে চরম ভোগান্তি, চরম আর্থিক ক্ষতির মধ্যে আছি।

লসের মুখে ফিলিং স্টেশন-মালিকরাও

শুধু ব্যক্তিগত গাড়ি, গণপরিবহন বা সিএনজি অটোরিকশাই নয়, গ্যাসের সরবরাহ ঠিক না থাকায় বিপাকে পড়েছেন ফিলিং স্টেশন-মালিকরাও। এবিএন স্টেশনের ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সাধারণের পাশাপাশি পরিচিত অনেক ক্লায়েন্ট আসছেন। কিন্তু তাদের চাহিদা মতো গ্যাস দিতে পারছি না। চাপ কম থাকলে অনেক সময় পাম্প বন্ধ রাখা লাগে। গত দেড়-দুই মাস ধরে গ্যাসের সমস্যাটা বেড়েছে। এতে করে পাম্পমালিকরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

কক্সবাজারের মহেশখালীতে স্থাপিত সামিটের এলএনজি টার্মিনাল। এটি বন্ধ থাকায় তৈরি হয়েছে গ্যাস সংকট / ছবি- সংগৃহীত

কেন এই অবস্থা— জানতে চাইলে তিনি বলেন, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) সরবরাহ কমে যাওয়ায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। যতদিন না এলএনজির পরিমাণ বাড়ানো হবে, ততদিন এর সমাধান হবে না। আমাদের যেখানে গ্যাসের চাপ থাকা লাগে ১০ পিএসআই (পাউন্ড পার স্কয়ার ইঞ্চি), সেখানে চাপ মাত্র তিন পিএসআই। তাহলে সেল (বিক্রি) করব কীভাবে? কোনো গাড়িই ফুল সিলিন্ডার গ্যাস পায় না। এতে আমাদের বিক্রি কমেছে, গ্রাহকরাও ভোগান্তির মুখে পড়েছেন।

গ্যাস সংকটের বিষয়ে বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নূর ভূঁইয়া বলেন, দেশের স্টেশনগুলোতে এখন চাহিদামাফিক গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে পাম্পমালিকরা লসের মুখে পড়েছেন। সমস্যার সমাধানে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু সেখান থেকে জানানো হয়েছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও বেশ কিছুদিন সময় লাগবে।

গ্যাস সংকটের কারণ কী

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সামিট গ্রুপের মালিকানাধীন এলএনজি টার্মিনাল। রেমালের আগে বিদ্যুৎ, সারসহ বিভিন্ন খাতে প্রতিদিন ৩১০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস সরবরাহ করা হতো। এর মধ্যে ২০০০ মিলিয়ন ঘনফুট আসত গ্যাসক্ষেত্র থেকে। বাকি ১১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মিলত এলএনজি টার্মিনাল থেকে।

গ্যাসের জন্য অপেক্ষা। সিএনজি স্টেশন ঘিরে অটোরিকশাগুলোর দীর্ঘ সারি / ছবি- সংগৃহীত

দেশে অবস্থিত এলএনজি টার্মিনালের মধ্যে সামিটের টার্মিনাল জাতীয় গ্রিডে দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর টার্মিনালটির কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সমপরিমাণ গ্যাসের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে সিএনজি ফিলিং স্টেশনসহ শিল্পকারখানা, বিদ্যুৎ ও আবাসিক খাতে।

রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানির তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ৬০৬টি অনুমোদিত সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন থাকলেও বর্তমানে ৫২৫টির কার্যক্রম চলমান। এর বিপরীতে দুই লাখ ৭৫ হাজার ৪৬২টি সিএনজিচালিত যানবাহন আছে, যেগুলো স্থানীয়ভাবে রূপান্তরিত।

এ ছাড়া আমদানি করা ট্যাক্সি ক্যাব ও বিআরটিসির সিএনজিচালিত বাসের সংখ্যা ৪০ হাজার ৩৮৩টি। সিএনজিচালিত অটোরিকশা আছে এক লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি। এই বিপুল সংখ্যক যানবাহন জ্বালানির জন্য রিফুয়েলিং স্টেশনের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাসের এ সংকট যানবাহন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ফেলেছে বেকায়দায়।

সংকটের সমাধান কবে— জানতে চাইলে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, গ্যাসের সরবরাহ এখন কম। বিদ্যুৎশিল্পসহ সবখানে গ্যাসের সাপ্লাই (সরবরাহ) স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চলছে। সামিটের টার্মিনালটি স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরতে সপ্তাহখানেক সময় লাগবে। এটি কার্যক্রমে ফিরলে গ্যাসের সংকট কমে আসবে।

ওএফএ/এমএআর/