চিকিৎসা ও গবেষণায় চিকিৎসক সমাজকে যাদের পথ দেখানোর কথা, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কর্মকর্তাদের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে কিছুদিন পরপর খবরের শিরোনাম হচ্ছে। এবার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অনিয়ম করে ক্লাস-পরীক্ষা এবং কোনোরকম গবেষণা ছাড়াই রেসিডেন্সি কোর্সের ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ‘ক্লিয়ারেন্স’ পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তিনি আবার হাসপাতালটির অতিরিক্ত পরিচালক (হাসপাতাল) হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।

শুধু তা-ই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের একজন মেডিকেল অফিসারের পদেও রয়েছেন তিনি। মেডিকেলে উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত একজন শিক্ষার্থীর যেখানে শুধুমাত্র পড়াশোনা করতেই গলদঘর্ম হওয়ার কথা, সেখানে তিনি একইসঙ্গে পালন করে চলেছেন তিন তিনটি দায়িত্ব!

বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, রেডিওলজি বিভাগের অন্যান্য শিক্ষকের আপত্তির মুখেও কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথকে ফেইজ-বি থিসিস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি দেন বিভাগীয় চেয়ারম্যান অধ্যাপক হাবিবা খাতুন। এমনকি পরবর্তী সময়ে তাকে ফেইজ-বি ক্লিনিক্যাল ও মৌখিক পরীক্ষায়ও অনুমতি দিতে চান বিভাগীয় চেয়ারম্যান

মূলত এমবিবিএস পাস করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হওয়ার যে কয়েকটি ডিগ্রি রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- এমডি, এমএস, এমফিল, ডিপ্লোমা, এফসিপিএস ও এমআরসিপি। এসব কোর্সে হাতে-কলমে দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি নিয়মিত ক্লাস, গবেষণা ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে নামের পাশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডিগ্রি বা উপাধি ব্যবহার করতে হয়। তবে ক্লাস, পরীক্ষা ও গবেষণা নামক গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যিক এসব নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হয়ে উঠেছেন বিএসএমএমইউ’র অতিরিক্ত পরিচালক ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথ।

২৭ শিক্ষার্থীর মধ্যে ডা. পবিত্র কুমারসহ দুজন পরীক্ষার অযোগ্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, রেডিওলজি বিভাগের অন্যান্য শিক্ষকের আপত্তির মুখেও কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথকে ফেইজ-বি থিসিস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি দেন বিভাগীয় চেয়ারম্যান অধ্যাপক হাবিবা খাতুন। এমনকি পরবর্তী সময়ে তাকে ফেইজ-বি ক্লিনিক্যাল ও মৌখিক পরীক্ষায়ও অনুমতি দিতে চান বিভাগীয় চেয়ারম্যান। তবে, বিভাগীয় পরীক্ষা কমিটির সদস্যরা সেটি নাকচ করেন। একইসঙ্গে বিভাগীয় কমিটির পক্ষ থেকে সর্বমোট ২৭ জনের মধ্যে ডা. পবিত্র কুমার ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ডা. রাকিব হাসনাতকে ফেইজ-বি ফাইনাল পরীক্ষার জন্য অযোগ্য (নট এলিজিবল) বলে ঘোষণা করা হয়। বাকি ২৫ জনকে যোগ্য (এলিজিবল) বলে চূড়ান্ত করা হয়।

তবে, গত ২৪ জুন অদৃশ্য এক শক্তির বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি অনুষদের কোর্স ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. শিরিন আক্তার বেগম ও সার্জারি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেনের সই করা এক চিঠিতে ডা. পবিত্র কুমারকে ফেইজ-বি পরীক্ষার জন্য ‘এলিজিবল’ বলে ঘোষণা করা হয়।

এ বিষয়ে জানতে সার্জারি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, কোর্সে যদি কারও ইনকমপ্লিট কিছু থাকে, সেটি আমার কাছে আসে না। সবগুলো মেডিকেল কলেজ এবং সবগুলো ডিপার্টমেন্ট থেকে কোর্স কো-অর্ডিনেটর ও চেয়ারম্যান হয়েই পরীক্ষায় অংশগ্রহণের তালিকাটা আমার কাছে আসে।

ডা. পবিত্র কুমারের অনিয়ম নিয়ে উপাচার্যের কাছে নালিশ সহপাঠীদের

ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথের এসব অনিয়ম তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর একটি অভিযোগপত্র দিয়েছেন রেসিডেন্সি কোর্সে থাকা তারই কিছু সহপাঠী। অভিযোগে ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথ রেসিডেন্ট হিসেবে শিক্ষাছুটিতে থাকা অবস্থায় তার প্রশাসনিক পদে থাকার বৈধতা ও বিভাগীয় কোনো ক্লাস-ডিউটি না করেও ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিকার ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়।

অভিযোগে বলা হয়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভের জন্য পাঁচ বছর নিরলসভাবে কাজ করে এমডি অথবা এমএস ডিগ্রি লাভের জন্য ফাইনাল পরীক্ষায় বসার সুযোগ মেলে। কিন্তু কারও জন্য এসবের কিছুই প্রয়োজন হয় না। ভিসি কিংবা চেয়ারম্যানের বিশেষ পাওয়ারে কোনো ক্লাস, রিসার্চ অথবা হাতে-কলমে কাজ না করেই ফাইনাল পরীক্ষায় বসার অনুমতি মেলে, সম্ভবত একইভাবে ডিগ্রিও পাওয়া সম্ভব।

ফেইজ-এ পরীক্ষার সর্বশেষ সুযোগের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বিভাগের চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য শিক্ষককে ফোন করে ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথকে পাস করাতে বাধ্য করা হয়

ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথের প্রসঙ্গে আরও বলা হয়, তিনি রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের মেডিকেল অফিসার, একইসঙ্গে এমডি কোর্সের ছাত্র এবং বিএসএমএমইউয়ের অতিরিক্ত পরিচালক (হাসপাতাল)। যেখানে একজন ছাত্র শুধুমাত্র পড়াশোনা করতেই গলদঘর্ম হন, সেখানে তিনি তিনটি দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। এমনকি পবিত্র কুমার রেসিডেন্সি কোর্সে আজ পর্যন্ত একটিও ক্লাস, টিউটোরিয়াল, ব্লক এন্ডিং পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে, থিসিসের জন্য কোনো ডেটা কালেকশন না করে, এমনকি রেডিওলজি বিভাগের আল্ট্রাসনোগ্রাফি, এক্স-রে, সিটি/এমআরআইয়ের একটি রিপোর্টও না লিখে ফেইজ-বি ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি সবার আগে পেয়ে গেছেন।

উপাচার্য বরাবর দেওয়া অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, ফেইজ-এ পরীক্ষার সর্বশেষ সুযোগের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বিভাগের চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য শিক্ষককে ফোন করে ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথকে পাস করাতে বাধ্য করা হয়। একবার বিভাগীয় শিক্ষকদের সভায় তৎকালীন বিভাগীয় চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সালাউদ্দিন আল আজাদ বলেছিলেন, ‘পবিত্রকে পাস করাতে হলে আর পরীক্ষা নেওয়ার দরকার নেই, সবাইকে পাস করিয়ে দিতে হবে’। হয়েছিলও তা-ই। ওই পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ২২ জনের সবাইকে সেবার পাস করিয়ে দেওয়া হয়, যা উচ্চশিক্ষার এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।

শিক্ষা ছুটি, না-কি কর্তব্যকালীন ছুটি

২০১৬ সালের ১০ ডিসেম্বর এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের রেসিডেন্সি প্রোগ্রামে (ফেইজ-এ) অধ্যয়নের জন্য ২০১৭ সালের ১ মার্চ থেকে ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথকে দুই বছরের জন্য স্ব-বেতনে শিক্ষাছুটি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এরপর ২০২১ সালে এসে আবারও শিক্ষাছুটির জন্য আবেদন করেন পবিত্র কুমার। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে তার দেওয়া দ্বিতীয় দফা ছুটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিএসএমএমইউয়ের অধীনে এমডি (রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং) ফেইজ-বি রেসিডেন্সি প্রোগ্রামে অধ্যয়নের জন্য আবারও তিন বছরের ছুটি মঞ্জুর হয়। এ দফায় তাকে ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর হতে ২০২৪ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তিন বছরের (নির্ধারিত ফি পরিশোধ-সাপেক্ষে) ছুটি দেওয়া হয়।

ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, পরীক্ষাসহ বিভিন্ন অনিয়ম করে ধরা খেলেই নিজেকে সংখ্যালঘু দাবি করে অন্যদের থেকে সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করেন তিনি। একই কোর্সের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথ সদ্য সাবেক ভিসির ক্ষমতা এবং ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক অনিয়ম করে চলেছেন

অভিযোগ রয়েছে, যদিও তিনি দ্বিতীয় দফায় তিন বছরের জন্য শিক্ষাছুটি নিয়েছিলেন, তারপরও ২০২১ সালে তৎকালীন অতিরিক্ত রেজিস্টার স্বপন কুমার তপাদারকে দিয়ে সেটিকে কর্তব্যকালীন ছুটি দেখিয়ে রেডিওলজি বিভাগে যোগদান করেন। এমনকি এক-দুই মাস পরপর ডিপার্টমেন্টে গিয়ে হাজিরা খাতায় সাইন করে আসেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিরল দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করবেন ডা. পবিত্র কুমার

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক চিকিৎসক বলেন, ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথ একটি ক্লাস না করে, ছয়টি ব্লকের মধ্যে কোনো ব্লকই কমপ্লিট না করে কীভাবে ফাইনাল পরীক্ষার ক্লিয়ারেন্স পান? তার অনিয়ম এখানেই শেষ নয়। রেডিওলজি বিভাগের ফেইজ-বি রেসিডেন্ট হয়ে রেসিডেন্সি কোর্সে একটি এক্স-রে, একটি আল্ট্রাসাউন্ড ও একটি সিটি-স্ক্যান রিপোর্ট না করে রেসিডেন্সি কোর্স শেষ করাটা একটা বিরল দৃষ্টান্ত।

বিএসএমএমইউয়ের একটি শিটে ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথের নামের পাশে ‘নট এলিজিবল’ দেখা যায় / ছবি : সংগৃহীত

তিনি বলেন, ডিপার্টমেন্ট থেকে ক্লিয়ারেন্স না দেওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে শিক্ষকদের চাপে রেখে ক্লিয়ারেন্স দেওয়ার যে ধ্বংসাত্মক রীতি চালু হয়েছে, এটি রেসিডেন্সি কোর্সকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। এটি তো রেসিডেন্সি কোর্সের জন্য একটি অশনি সংকেত। এর আগেও চাকরিতে যোগদানের নির্ধারিত দুই বছর পূর্ণ না করেই রেসিডেন্সি প্রোগ্রামে ভর্তির মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হওয়ার নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বিএসএমএমইউয়ে এসব অনিয়মের শেষ কোথায়?

ধরা খেলেই মাইনোরিটির অজুহাত, কান্নাকাটি করে সহানুভূতি আদায়

ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, পরীক্ষাসহ বিভিন্ন অনিয়ম করে ধরা খেলেই নিজেকে সংখ্যালঘু দাবি করে অন্যদের থেকে সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করেন তিনি। একই কোর্সের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথ সদ্য সাবেক ভিসির ক্ষমতা এবং ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক অনিয়ম করে চলেছেন। এসবে বাধা দিলেই নির্দিষ্ট কিছু নেতার কাছে মাইনোরিটির অজুহাতে কান্নাকাটি করে সিমপ্যাথি আদায় করেন। যা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী থেকে শুরু করে সব শিক্ষক-চিকিৎসকই জানেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে অবগত থাকলেও তার বিশেষ ক্ষমতার কারণে কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করেন না।

ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথ ২০১৭ সালে বিভাগীয় কোটায় এমডি (রেডিওলজি) কোর্সে ভর্তি হন। এমডি ফেইজ-এ পরীক্ষায় অনেকবারই তিনি অংশগ্রহণ করেন। এমনকি পরীক্ষায় নকল করা অবস্থায় কয়েকবার ধরা পড়লেও ঊর্ধ্বতন মহলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি

ব্যবস্থা না নিলে আন্দোলনের হুমকি দিয়ে এ চিকিৎসক আরও বলেন, জাতির জনকের নামে প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থাসহ সব নিয়মকানুন ধ্বংস হতে থাকবে, এটি মেনে নেওয়া যায় না। চিকিৎসা বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষার সচেতন শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা ডা. পবিত্র কুমারের এসব অনিয়মের তদন্ত-সাপেক্ষে তার কোর্স বাতিলসহ সব অবৈধ প্রশাসনিক পদ প্রত্যাহারের আবেদন জানাই। অন্যথায় সচেতন শিক্ষার্থীদের নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ ও আন্দোলন ছাড়া আর কোনো বিকল্প আমাদের কাছে থাকবে না।

ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে জানা যায়, ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথ ২০১৭ সালে বিভাগীয় কোটায় এমডি (রেডিওলজি) কোর্সে ভর্তি হন। এমডি ফেইজ-এ পরীক্ষায় অনেকবারই তিনি অংশগ্রহণ করেন। এমনকি পরীক্ষায় নকল করা অবস্থায় কয়েকবার ধরা পড়লেও ঊর্ধ্বতন মহলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

চেয়ারম্যান-কোর্স ডিরেক্টর ‘এলিজিবল’ বলেছে তাই সাইন করেছি : ডিন

সার্জারি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ডা. পবিত্র কুমারের বিষয়ে কোর্স কো-অর্ডিনেটর বলেছে যে, তিনি সব পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন এবং ফাইনাল পরীক্ষার জন্য এলিজিবল (যোগ্য)। এরপর চেয়ারম্যানও বলেছেন তিনি এলিজিবল। এ কাগজ আসে কোর্সের ডিরেক্টরের কাছে, তিনিও এলিজিবল বলে স্বাক্ষর করার পর যখন আমার কাছে আসে, স্বাভাবিকভাবেই এতগুলো ধাপে পার হয়ে আসা ব্যক্তিকে আমারও এলিজিবল বলেই সাইন করতে হয়। এটি হলো আমাদের পদ্ধতি। আমার তো আর প্রতিটি শিক্ষার্থীর ব্যাকগ্রাউন্ড ঘেঁটে দেখার সুযোগ নেই যে কার কী অবস্থা।

‘বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট থেকে বিভিন্নভাবে এ নামের তালিকা আসে। কখনও একজন, দুজন বা তিনজনও আসে। পবিত্র কুমারের বিষয়টিও যখন তারা কমপ্লিটেড লিখে দিয়েছেন, তখন আর তার বিষয়ে আমার কিছুই বলার থাকে না। যেহেতু তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, আমার মনে হয় কোর্স কো-অর্ডিনেটর, কোর্স ডিরেক্টর ও চেয়ারম্যানের কাছে জানতে চাইতে পারেন।’

চিকিৎসাসেবা এমন একটি পেশা, যার সঙ্গে অনেকটাই রোগীর জীবন-মরণের সম্পর্ক। তাই বরাবরই চিকিৎসকদের উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণে কোনো ধরনের ‘ছাড়’ না দেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

সার্জারি অনুষদের ডিন আরও বলেন, এখন পর্যন্ত আমার কাছে কেউ লিখিত অভিযোগ করেননি। যদি কেউ কারও বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন, তাহলে অবশ্যই আমি বিষয়টি দেখব।

জীবন-মরণের পেশায় শিক্ষা-প্রশিক্ষণে ছাড় না দেওয়ার পরামর্শ

চিকিৎসাসেবা এমন একটি পেশা, যার সঙ্গে অনেকটাই রোগীর জীবন-মরণের সম্পর্ক। তাই বরাবরই চিকিৎসকদের উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণে কোনো ধরনের ‘ছাড়’ না দেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, যদি কেউ রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত আশ্রয়ে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কোর্সে ‘কাটছাঁট’ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হয়ে যান, তাহলে সেটি হবে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য ভয়াবহ ব্যাপার।

বিএসএমএমইউয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোর্স কারিকুলাম আছে, প্রত্যেককেই সেগুলো অতিক্রম করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হয়ে বের হতে হবে। এর বাইরে বিশেষ কোনো ক্ষমতা বা কোনো হস্তক্ষেপে কাউকে সুযোগ বা ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।

বিএসএমএমইউয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান / ছবি : সংগৃহীত

‘আমি ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছিলাম। এরপর আরও তিনজন ভিসি এসেছেন। আমার সময় পর্যন্ত এ ধরনের কোনো রেকর্ড নেই। এ ধরনের কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন কখনও হতে হয়নি আমাকে। সেই সময়ে শিক্ষার্থীরাও রেগুলার ছিল, শিক্ষকরাও ঠিকঠাক পড়াতেন। ফলে অ্যাকাডেমিক ভালো একটা আউটপুট আমি পেয়েছি। আমার সময় কখনও এ ধরনের বিষয়ে কাউকে কোনো ধরনের ছাড় দিইনি।

ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথের একইসঙ্গে তিন পদে থাকার বিষয়ে সাবেক এ উপাচার্য বলেন, আমার সময় এ ধরনের কোনো কিছুই হয়নি। এখনকার কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে কীভাবে ভাবছে, এটি তারাই বলতে পারবে। তিনি যদি কোর্সের কোনো শিক্ষার্থী হন, তাহলে তো তার পড়াশোনা নিয়েই কূল-কিনারা পাওয়ার কথা না। তিনি আবার একইসঙ্গে তিনটি দায়িত্ব কীভাবে পালন করবেন? সবকিছু একসাথে করলে তাকে দিয়ে পড়াশোনাটাই বা কতটুকু হবে? এটি ভাবার বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোন পরিপ্রেক্ষিতে এমন অর্ডার দিয়েছে, সেটি আমি জানি না। যেহেতু অভিযোগ উঠেছে, এখন তাদেরই উচিত বিষয়টি পরিষ্কার করা।

ডা. পবিত্র কুমারের লুকোচুরি ও সমঝোতার চেষ্টা

ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথের বিরুদ্ধে ওঠা সবগুলো অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে তার সঙ্গে প্রথম দফায় গত ২৪ জুন মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তখন তিনি এ বিষয়ে সরাসরি সাক্ষাতে কথা বলতে চান এবং ‘মিটিংয়ে ব্যস্ত আছি’ বলে ফোন কেটে দেন। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ২৬ জুন সাক্ষাৎ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার কক্ষে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। ২৭ জুন তার মুঠোফোনে আবারও যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

সর্বশেষ ৩০ জুন আবারও তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। সে সময় ফোন রিসিভ করলে সাংবাদিক পরিচয় শুনেই তিনি ফোন কেটে দেন এবং প্রতিবেদকের নম্বরটি ব্লক লিস্টে ফেলে রাখেন। ফলে তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

এদিকে, নিজে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে না চাইলেও থেমে থাকেননি ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথ। একাধিক মাধ্যমে তিনি সমঝোতা করে অভিযোগের বিষয়গুলো ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা এবং পরবর্তী সময়ে অন্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আরেক অধ্যাপককে দিয়ে ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথ। উভয় মাধ্যমেই বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সাধারণ ঘটনা’ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেন তিনি। একইসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি চক্র তাকে চক্রান্তের মাধ্যমে থামাতে চাইছেন বলেও দাবি করা হয়।

এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. দীন মো. নূরুল হকের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (অ্যাকাডেমি) অধ্যাপক ডা. আতিকুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এমন অভিযোগের বিষয়ে জেনেছি। সবাইকে নির্দিষ্ট কারিকুলাম পূরণ করে তবেই আসতে হবে। বিশেষ বিবেচনায় কারও কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি নিয়ে আমি ভিসি মহোদয় এবং সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলব। পরবর্তী সময়ে তদন্ত-সাপেক্ষে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সেটি আমরা চিন্তা করব।

টিআই/কেএ