• বিজেএমসির জমি, দখলে নিল সিটি কর্পোরেশন ও ডেভেলপার
• জমির ভাগ ছাড়তে নারাজ বিজেএমসি, ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ

রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র ও ব্যাংকপাড়া বলে পরিচিত মতিঝিল। এখানেই ৩৭ কাঠা জমির মালিক বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশন (বিজেএমসি)। এত মূল্যবান জায়গায় জমি থাকলেও কোনো কাজে লাগাতে পারেনি বিজেএমসি। সংস্থাটি ব্যর্থ হয়ে নিজের ৩৭ কাঠা জমি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনকে উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ দেয়। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন নিজে উন্নয়ন না করে ডেভেলপার কোম্পানি দিয়ে ওই জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণ করে।

জানা যায়, বহুতল ভবনের অর্ধেক ডেভেলপার কোম্পানি এবং বাকি অর্ধেক সিটি কর্পোরেশন দখলে নেয়। তবে, জমির মালিক বিজেএমসিকে মাত্র একটি ফ্লোর ও ৩০টি গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা দেয় সিটি কর্পোরেশন। বিজেএমসির অতিমূল্যাবান জমিটি নিয়ে এমন ‘তুঘলকি কাণ্ড’ হওয়ায় বিষয়টি সংসদীয় কমিটিতে উপস্থাপিত হয়। এটি নিয়ে বিস্তরভাবে আলোচনাও হয়। এমন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কারা জড়িত ছিলেন অর্থাৎ জমিটি কীভাবে বরাদ্দ দেওয়া হলো— বিষয়টি খতিয়ে দেখার পক্ষে নিজের অবস্থানও পরিষ্কার করেন তৎকালীন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মির্জা আজম।

বিজেএমসির অতিমূল্যাবান জমিটি নিয়ে এমন ‘তুঘলকি কাণ্ড’ হওয়ায় বিষয়টি সম্প্রতি সংসদীয় কমিটিতে উপস্থাপিত হয়। এটি নিয়ে বিস্তরভাবে আলোচনাও হয়। এমন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কারা জড়িত ছিলেন অর্থাৎ জমিটি কীভাবে বরাদ্দ দেওয়া হলো— বিষয়টি খতিয়ে দেখার পক্ষে নিজের অবস্থানও পরিষ্কার করেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মির্জা আজম

মির্জা আজম সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বলেন, ‘ডেভেলপার কোম্পানির মালিক আলহাজ মিজানুর রহমান বিজেএমসি টাওয়ারের নবম তলা এবং ৩০টি কার পার্কিংয়ের জন্য অগ্রিম জামানত হিসেবে পাঁচ কোটি টাকা জমা দেন। তিনি উক্ত টাকা সুদসহ দাবি করছেন। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত কী, তা জানতে চাই।’

সভাপতির জানতে চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুর রউফ জানান, ইতোপূর্বে বিজেএমসি টাওয়ার ও আলহাজ মিজানুর রহমানের বিষয়টি নিয়ে কমিটিতে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। মিজানুর রহমানের কাছে বিজেএমসির ২০ কোটি টাকার অধিক পাওনা রয়েছে। কিন্তু তিনি দাবি করেছেন পাঁচ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিনি বিজেএমসির পাওনা না দিয়ে নিজের টাকা দাবি করছেন, এটি অযৌক্তিক।

সচিব বলেন, ‘মূলত বিজেএমসির প্রায় ৩৭ কাঠার জমিটি দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনকে দেওয়া হয়েছিল উন্নয়নের জন্য। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নিজে না করে তা ডেভেলপার আলহাজ মিজানুর রহমানের দিয়ে করান। ফলে ২৪ তলা ভবনটির অর্ধেক ডেভেলপার কোম্পানি এবং বাকিটা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন বুঝে নেয়। নিজস্ব জমি হওয়া সত্ত্বেও বিজেএমসিকে মাত্র একটি ফ্লোর ও ৩০টি গাড়ি রাখার জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ডেভেলপার কোম্পানি সব ফ্লোরের কাজ সম্পন্ন করলেও বিজেএমসির ফ্লোরের কাজ করেনি, যা চুক্তির মধ্যে ছিল। বরং উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিজেএমসির ফ্লোরটি ডেভেলপার নিজেই ভাড়া হিসেবে নেয়, যাতে ওই ফ্লোরের দখলও বিজেএমসি না পায়।’

‘পরবর্তী সময়ে ফ্লোরটি অনেকটা জোর করে দখলে নিয়ে বিজেএমসি তিন কোটি টাকা ব্যয়ে এর সব কার্যক্রম সম্পন্ন করে। চুক্তি অনুযায়ী ফ্লোরটি ডেভেলপারকে ভাড়া নিতে বললে তিনি আর তা নেননি। এ ছাড়া তিনি (মিজানুর রহমান) উদ্দেশ্যমূলকভাবে গ্রাউন্ড ফ্লোরে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করেন। তার কাছে ফ্লোরের উন্নয়ন ও বকেয়া ভাড়াসহ ২০ কোটি টাকার অধিক পাওনা। তাই ডেভেলপারকে আর কোনো টাকা না দিয়ে তার কাছ থেকে পাওনা টাকা আদায় করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’

সচিব আরও বলেন, ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিল। মতিঝিলের মতো জায়গায় জমির মালিক হওয়া সত্ত্বেও বিজেএমসি মাত্র একটি ফ্লোর পাবে— এমন চুক্তি কীভাবে করা হয়েছে তা বোধগম্য নয়।’

বফ্লোরটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘অতিমূল্যবান জায়গা বিধায় একটু দেখেশুনে ভালো ভাড়াটিয়ার কাছে ফ্লোরটি ভাড়া দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।’ কোন সরকার এবং কার সময়ে চুক্তিটি করা হয়েছে— সভাপতি জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘তখন ঢাকার মেয়র ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। ওই সময় যারা সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বে ছিলেন তারাই কাজটি করে সমগ্র জায়গাটি দখল করে নেয়। ওই সময়ের পরিস্থিতিতে বিজেএমসি বা মন্ত্রণালয়ের লোকজনকে এটি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল।’

কমিটির সাবেক সদস্য মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এত বড় একটি তুঘলকি কারবার এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়া যায় না। নিয়ম অনুযায়ী জমির মালিক পাবে অর্ধেক আর ডেভেলপার পাবে অর্ধেক। মতিঝিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গার জমি, এখানে জমির মালিক আরও বেশি পাবে। তিনি পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করে মামলা দায়েরের প্রস্তাব করেন।

পরে সংসদীয় কমিটির সাবেক সভাপতি মির্জা আজম বলেন, একজন ব্যক্তি সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করতেই পারেন। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন, মন্ত্রণালয়, বিজেএমসিতে যারা সরকারি দায়িত্বে ছিলেন তারা কীভাবে কাজটি করলেন, তা খতিয়ে দেখা উচিত। বিষয়টি সাবার কাছেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তাই আগামী বৈঠকে সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে চুক্তিসহ এ বিষয়ের ওপর যাবতীয় তথ্যাদি উপস্থাপন করার আহ্বান জানান তিনি।

একাদশ জাতীয় সংসদের বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠক সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজীকে। তার নেতৃত্বে গঠিত নতুন কমিটি বিষয়টি পর্যালোচনা করবে— সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

প্রসঙ্গত, জাতীয়করণ করা পাটকলগুলো নিয়ন্ত্রণ, পরিদর্শন ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে বাংলাদেশ শিল্পপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ শীর্ষক আদেশ ১৯৭২ (রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ২৭, ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ-১০) অনুসারে বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন (বিজেএমসি) প্রতিষ্ঠিত হয়। একজন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে বোর্ড অব ডিরেক্টরস-এর মাধ্যমে বিজেএমসি পরিচালিত হয়। বর্তমানে এ সংস্থার অধীনে তিনটি নন জুট প্রতিষ্ঠানসহ মোট ২৬টি মিল রয়েছে। ঢাকা অঞ্চলের অধীনে সাতটি, চট্টগ্রাম অঞ্চলের অধীনে ১০টি এবং খুলনা অঞ্চলের অধীনে নয়টি মিল রয়েছে। আঞ্চলিক মিলসমূহ দেখাশোনা ও সমন্বয়ের জন্য বিজেএমসির দুটি আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে।

এসআর/এমএআর