জুয়েলারির বিশ্ববাজার : ব্যাপক সম্ভাবনা বাংলাদেশের
জুয়েলারি পণ্যের বৈশ্বিক বাজারের আকার সাড়ে ৩০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এ খাতে রপ্তানির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। বিশ্ব বাজারের একটি ছোট অংশ দখল করতে পারলেও তা হবে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ। এজন্য প্রয়োজন রপ্তানিবান্ধব নীতি।
অর্থনীতিবিদ ও স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, জুয়েলারি পণ্যের দক্ষ কারিগর রয়েছে দেশে। তাদের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। অন্যান্য দেশের কারিগরদের তুলনায় কম স্বর্ণ দিয়েও একই ডিজাইনের জুয়েলারি পণ্য তৈরি করতে পারেন এসব স্বর্ণশিল্পীরা। তবে সরকারি নীতি সহায়তার অভাবে এ সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। কাজের অভাবে প্রতিনিয়তই দেশ ছাড়ছেন এসব কারিগররা।
বিজ্ঞাপন
তারা আরও বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দেশের স্থানীয় বাজারে সবসময় স্বর্ণের মূল্য ভরি প্রতি ৮ থেকে ১৫ হাজার টাকা বেশি হয়ে থাকে। যার অন্যতম কারণ স্বর্ণের কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানিতে অসহনীয় শুল্ক-কর হার। আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বেশি দামে কাঁচামাল ও মেশিনারিজ কিনে রপ্তানি করা সম্ভব নয়। এ কারণে পিছিয়ে পড়েছে এ খাত। সম্ভাবনা কাজে লাগাতে প্রয়োজন রপ্তানিবান্ধব নীতি। তাহলে রপ্তানির দিক দিয়ে এ খাত পোশাক শিল্পকেও পেছনে ফেলে দিতে পারে।
প্রতিবছর বাড়ছে বাজারের আকার
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বাজার গবেষণা এবং পরামর্শ প্রতিষ্ঠান গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চের তথ্যমতে ২০২৩ সালে বিশ্বে জুয়েলারি বাজারের মোট আকার ছিল ৩৫৩.২৬ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছর শেষে এর আকার দাঁড়াবে ৩৬৬.৭৯ বিলিয়ন ডলারে। প্রতিবছর এ আকার বাড়বে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে রয়েছে স্বর্ণালংকার বানানোর দক্ষ কারিগর। এখন প্রয়োজন রপ্তানিবান্ধব নীতি। তাহলে রপ্তানির দিক দিয়ে এ খাত পোশাক শিল্পকেও পেছনে ফেলে দিতে পারে
গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চ বলছে, বছরে গড় ৪.৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি ধরে ২০৩০ সালে সারা বিশ্বে জুয়েলারি পণ্যের বাজারের মোট আকার দাঁড়াবে ৪৮২.২২ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশের রয়েছে ব্যাপক সম্ভাবনা
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শরীফ মোশাররফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গোল্ড ইন্ডাস্ট্রির বিশ্ববাজার প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলারের। এই বড় মার্কেটের যদি ০.৫ ভাগও বাংলাদেশ দখল করতে পারে তাহলে গোল্ড ইন্ডাস্ট্রি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রপ্তানি পণ্য হিসেবে আবির্ভূত হবে। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই ইন্ডাস্ট্রি তৈরি পোশাক শিল্পকেও ছাড়িয়ে যাবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ডা. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্বব্যাপী ভারতীয় জুয়েলারি নামে যেটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়, সেটি মূলত বাংলা ভাষাভাষী স্বর্ণশিল্পীরাই তৈরি করেন। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের কারিগররা এই জুয়েলারি পণ্য তৈরি করেন। ভারত ইতোমধ্যে তাদের দক্ষতা কাজে লাগিয়েছে। নীতিগত সহায়তার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে আমরা এখনো পারিনি।
তিনি বলেন, বিশ্ববাজারের একটি অলংকার দেখা গেছে ছয় ভরিতে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দক্ষ কারিগররা সেটি সাড়ে ৩ অথবা ৪ ভরি স্বর্ণ দিয়ে তৈরি করে ফেলতে পারেন। অর্থাৎ তারা এতটাই দক্ষ যে প্রায় অর্ধেক স্বর্ণ দিয়ে একই মানের জুয়েলারি তৈরি করে ফেলতে পারেন। ডিজাইন এক হলেও সেটির ওজন কম হয়, এজন্য দামও কম হবে। একই ডিজাইনের পণ্য মানুষ দামে যেটি কমে পাবে, সেটিই নেবে। এক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে আছি। এছাড়া আমাদের দেশে কিন্তু হাতে তৈরি ছাড়াও এখন মেশিন দিয়েও জুয়েলারি পণ্য তৈরি হচ্ছে। এটিও কিন্তু আমাদের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক দিক। এখন দরকার সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা। সহযোগিতা পেলে এ খাত হবে রপ্তানির বড় খাত।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, স্বর্ণের বিশ্ব মার্কেট কিন্তু খুব ছোট নয়। তবে স্বর্ণালংকার রপ্তানি করে এমন দেশের সংখ্যা খুব বেশি নেই। এই মার্কেটে আমরা যদি ঢুকতে পারি তাহলে একটা অবস্থান তৈরি করতে পারব বলে আমি মনে করি। সেটা নিয়ে আমরা আশাবাদী।
আরও পড়ুন
বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্যাক্সেশনের চেয়ারম্যান ও কার্যনির্বাহী সদস্য আনোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বর্ণ শিল্পের জন্য সারা পৃথিবীর একটি সংস্থা আছে। সেটি হচ্ছে ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল। তাদেরই একটি পরিসংখ্যান আছে। সারা পৃথিবীতে জুয়েলারির যত হাতে কাজ করা কারিগর আছেন, তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশই হচ্ছে বাঙালি। এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়, এই খাতে আমাদের দক্ষ জনবল আছে।
তিনি বলেন, হাতের কাজ করা যে কোন পণ্যের দাম সব সময় কিন্তু বেশিই হয়। একটি চটের ব্যাগও যদি হাতের তৈরি হয়, সেটির দামও কিন্তু অন্যান্য ব্যাগের তুলনায় বেশি হয়। কারণ এটি হাত দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। দেখতেও এটি সুন্দর লাগে। এই ব্যাগের আলাদা একটা গুরুত্ব তৈরি হয় তখন। আর জুয়েলারি হচ্ছে অনেক দামি পণ্য। সেই হিসেবে হাতে তৈরি জুয়েলারির চাহিদা অনেক বেশি।
তিনি আরও বলেন, সারা পৃথিবীতে জুয়েলারির যে চাহিদা রয়েছে, সেখানে হালকা ওজনের জুয়েলারির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। আমাদের দক্ষ কারিগররা হালকা ওজনের জুয়েলারি পণ্য তৈরি করতে পারেন। যা রপ্তানির ক্ষেত্রে অনেকটাই ইতিবাচক। তবে আমরাতো এসব দক্ষ কারিগরদের ধরে রাখতে পারছি না।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মজিদ বলেন, আমাদের কিন্তু যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের যে ভৌগোলিক অবস্থান, বাংলাদেশ কিন্তু একটা রুট। এই রুটে স্বর্ণ আসতে পারে এবং যেতেও পারে। এই আসা-যাওয়াটাকে খারাপ চোখে না দেখে এটাকে যেন গঠনমূলকভাবে নিতে পারি, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
সম্ভাবনা থাকলেও রপ্তানি কম
জুয়েলারি পণ্য রপ্তানির ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও বিশ্ববাজার ধরতে পারছে না বাংলাদেশ। প্রতি বছর এ খাতে নামমাত্র রপ্তানি হয়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, জুয়েলারির এ খাতটি গত কয়েক অর্থবছরে মাত্র কয়েক কোটি টাকার জুয়েলারি পণ্য রপ্তানি করেছে।
স্বর্ণ শিল্পের আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল (ডব্লিউজিসি) জুয়েলারি পণ্য রপ্তানিতে ২০২২ সালের শীর্ষ ১০০ দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে। সেখানে স্থান হয়নি বাংলাদেশের। এ তালিকায় শীর্ষ পাঁচ দেশ হচ্ছে চীন, সুইজারল্যান্ড, ভারত, হংকং ও ইতালি। বিশ্বে রপ্তানি করা অলংকারের অর্ধেকের বেশি (৫৩.৩ শতাংশ) এই পাঁচটি দেশের দখলে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী ৯ হাজার ৮৮০ কোটি ডলারের জুয়েলারি পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ২০২১ সালে এ অঙ্ক ছিল ৭ হাজার ২০০ কোটি ডলারের। এক বছরের ব্যবধানে জুয়েলারি পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ৩৭.১ শতাংশ।
ডব্লিউজিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে চীন সর্বোচ্চ এক হাজার ২৫০ কোটি ডলারের স্বর্ণালংকার রপ্তানি করেছে (মোট বৈশ্বিক রপ্তানির ১২.৬ শতাংশ)। সুইজারল্যান্ড এক হাজার ১৪০ কোটি ডলারের (১১.৬%), ভারত এক হাজার ৬০ কোটি (১০.৭%), হংকং ৯৩০ কোটি (৯.৪%), ইতালি ৮৯০ কোটি (৯%), যুক্তরাষ্ট্র ৭২০ কোটি, (৭.৩%), তুরস্ক ৬৮০ কোটি (৬.৯%), ফ্রান্স ৫২০ কোটি (৫.২%), সংযুক্ত আরব আমিরাত ৩৮০ কোটি (৩.৮%), থাইল্যান্ড ৩৩০ কোটি (৩.৪%), সিঙ্গাপুর ২৯০ কোটি (২.৯%), যুক্তরাজ্য ২৯০ কোটি (২.৯%), ইন্দোনেশিয়া ২৬০ কোটি (২.৬%), জার্মানি ১৬০ কোটি (১.৬%) ও আয়ারল্যান্ড ১১০ কোটি (১.১%) ডলারের স্বর্ণালংকার রপ্তানি করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে তালিকায় ভারতের পরে রয়েছে শ্রীলঙ্কা (৪৩তম), নেপাল (৭০তম) ও পাকিস্তান (৭১তম)।
গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে বিশ্বে জুয়েলারি বাজারের মোট আকার ছিল ৩৫৩.২৬ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছর শেষে এর আকার দাঁড়াবে ৩৬৬.৭৯ বিলিয়ন ডলারে। প্রতিবছর এ আকার বাড়বে
ভারত পারলে কেন পারছে না বাংলাদেশ?
>>অসম শুল্কহার
দেশে স্বর্ণের আমদানি ও বিক্রির ক্ষেত্রে শুল্কের হার পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। এ কারণে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশের বাজারে স্বর্ণের দামের পার্থক্য রয়েছে। ফলে বিপুল সম্ভাবনা সত্ত্বেও বিশ্ববাজার ধরতে পারছে না বাংলাদেশ। এছাড়া অতিরিক্ত দামের কারণে বাংলাদেশের অনেক উচ্চবিত্ত ক্রেতা বিদেশ থেকে জুয়েলারি পণ্য কেনেন। এতে দেশের অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। সরকারও প্রত্যাশিত রাজস্ব হারাচ্ছে।
জানা গেছে, জুয়েলারি পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে দেশে ৫ শতাংশ শুল্ক। অথচ ভারতে এ হার ৩ শতাংশ, যা বাংলাদেশের তুলনায় ২ শতাংশ কম।
বাজুসের সর্বশেষ (২৬ জুন) দর অনুযায়ী, ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণের দাম ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৫৫ টাকা। এর সাথে বাজুস নির্ধারিত নূন্যতম মজুরি ৭ হাজার ১০১ টাকা এবং ৫ শতাংশ ভ্যাট ৬ হাজার ২৭৩ টাকা যোগ করলে মোট মূল্য দাঁড়ায় ১ লাখ ৩১ হাজার ৭২৯ টাকা।
অন্যদিকে, ভারতে একই পরিমাণ স্বর্ণ কিনতে ৩ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয় ৩ হাজার ৭৬৩ টাকা। যা বাংলাদেশের তুলনায় ২ হাজার ৫১০ টাকা কম। অর্থাৎ শুধুমাত্র ভ্যাটের ক্ষেত্রেই প্রতি ভরিতে আড়াই হাজার টাকার বেশি কম।
জুয়েলারির কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানির ক্ষেত্রেও ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে শুল্ক-কর বেশি। অপরিশোধিত স্বর্ণ আকরিকের আমদানি শুল্ক বাংলাদেশে ৫ শতাংশ হলেও ভারতে এ পণ্যে কোন শুল্ক নেই। এ ক্ষেত্রে ভারতের সাথে বাংলাদেশের ব্যবধান ৫ শতাংশ। এছাড়া জুয়েলারি খাতের অন্যান্য অধিকাংশ পণ্যেই ভারতের চেয়ে শুল্ক-কর বেশি বাংলাদেশে।
বাজুসের সহ-সভাপতি মাসুদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, রপ্তানি না হওয়ার প্রথম কারণ সরকারের সদিচ্ছার অভাব। সদিচ্ছা বলতে বোঝাচ্ছি কোনো পণ্য বা খাতকে যদি সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করতে চায় যে এখান থেকে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করব, তখন সেই খাতকে সুযোগ করে দিতে হয়। বাংলাদেশে স্বর্ণের কোনো খনি নেই। এটা বাইরে থেকে আমদানি করে নিয়ে আসতে হয়। এজন্য আমদানি এবং রপ্তানির যথাযথ সুযোগ দিতে হবে।
তিনি বলেন, স্বর্ণের কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানির ক্ষেত্রে আমরা বিশ্ববাজারের দামে পাই না। একটি পণ্যের কাঁচামাল বিশ্ববাজারে ১০০ টাকা হলে সেখানে আমাদেরকে যদি ১১০ টাকা দিয়ে কিনতে হয় তাহলে রপ্তানি করবো কীভাবে? আমরা কি লস দিয়ে রপ্তানি করবো? কেউ কী লস দিয়ে রপ্তানি করবে? এটাতো সরকারের যারা নীতি বা পলিসি প্রণয়ন করেন, তাদেরকে বুঝতে হবে।
মাসুদুর রহমান বলেন, বৈধ পথে স্বর্ণের বার, জুয়েলারি পণ্য রপ্তানিতে উৎসাহ দেওয়া হবে- সরকারের তরফ থেকে বারবার বলা হলেও এই খাত সংশ্লিষ্ট কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানির ওপর অসম শুল্কহারের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে জুয়েলারি পণ্য বিক্রির ওপর রয়েছে ৫ শতাংশ ভ্যাট। ব্যবসায়ীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে অপরিকল্পিত উৎসে করের বোঝা। এভাবে আমদানি শুল্ক, করহার এবং কাঠামোগত শুল্ক ও শিল্পবান্ধব নীতি প্রণয়নে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উদাসীনতা জুয়েলারি শিল্পকে পিছিয়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুন
>>রপ্তানির জন্য বৈধ পথে হয় না আমদানি
স্বর্ণ নীতিমালার আওতায় ২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর ১টি ব্যাংক ও ১৭টি জুয়েলার্সকে স্বর্ণ আমদানির অনুমতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- মধুমতি ব্যাংক, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড, জুয়েলারি হাউজ, রতনা গোল্ড, অরোসা গোল্ড করপোরেশন, আমিন জুয়েলার্স, স্রেজা গোল্ড প্যালেস, জরোয়া হাউস লিমিটেড, মিলন বাজার, এসকিউ ট্রেডিং, এমকে ইন্টারন্যাশনাল, বুরাক কমোডিটিস এক্সচেঞ্জ, গোল্ডেন ওয়ার্ল্ড জুয়েলার্স, রিয়া জুয়েলার্স, লক্ষ্মী জুয়েলার্স, বিডেক্স গোল্ড অ্যান্ড ডায়মন্ড, ডি ডামাস ও দি আর্ট অব গ্যালারি। পরে অবশ্য আরও একটি প্রতিষ্ঠানকে আমদানির জন্য অনুমতি দেয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনুমতি পেলেও আমদানি পর্যায়ে উচ্চ শুল্কসহ নানা কারণে স্বর্ণ আমদানি করছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। স্বর্ণ নীতিমালা অনুযায়ী বাংলাদেশে স্বর্ণের বার্ষিক চাহিদা ২০ থেকে ৪০ টন। তবে নীতিমালার পর থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ২০০ কেজির মতো স্বর্ণ আমদানি হয়েছে।
এ বিষয়ে আমদানির অনুমতি পাওয়া জুয়েলারি হাউজের কর্ণধার ও বাজুসের সহ-সভাপতি রিপনুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি একবার বিদেশ থেকে স্বর্ণ আমদানি করেছি। ওই স্বর্ণ দেশে আসার আগে আমরা জানতামই না যে আমদানিতে ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) বসানো হয়েছে। সাথে আরও ২ হাজার টাকা ট্যাক্স এবং ৫ শতাংশ ভ্যাট। প্রতি ভরিতে এখন সর্বমোট ১২ শতাংশ ভ্যাট-ট্যাক্স বা শুল্ক লাগছে।
তিনি বলেন, আরেকটি জটিলতা হচ্ছে এই পণ্যটি ছাড়াতে সর্বনিম্ন ১৫ দিন লাগে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এতদিন সময় লাগে। বিমানবন্দর থেকে যখন পণ্যটি আমরা ছাড়াতে যাই ভ্যাট-ট্যাক্স সব পরিশোধ করার পর তারা বিএসটিআইতে পাঠায়। বিএসটিআই-এর নিজস্ব কোন ল্যাব নেই। তারা তাঁতীবাজারের ল্যাবে পাঠায়। সেখান থেকে আবার বিমানবন্দরে আসে। এরপর এটি ছাড়াতে হয়। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, স্বর্ণের দাম মিনিটে-মিনিটে বাড়ে-কমে। সে জায়গায় আমদানি করতে গেলে ১৫ দিন ছাড়াতেই লেগে যায়। আমদানি প্রক্রিয়ায় এ দীর্ঘসূত্রতা এক্ষেত্রে অন্যতম বড় বাধা।
রিপনুল হাসান বলেন, তারপরও আমরা স্বর্ণ আমদানির ব্যাপারে আন্তরিক ছিলাম। কিন্তু ভ্যাট-ট্যাক্সতো অনেক বেশি। সরকারকে ১২ শতাংশ ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে অন্যান্য খরচসহ আমাদের ১৫ শতাংশ খরচ পড়ে যায়। অথচ ব্যাগেজ রুলে যারা স্বর্ণ আনছেন, তারাতো শুধুমাত্র ৪ হাজার টাকার ট্যাক্স দিচ্ছে। তাদের আর কোন খরচ নেই। আর যেগুলো চোরাচালানোর মাধ্যমে আসছে, সেখানেতো কোন খরচই নেই। তাহলে তাদের সাথে আমরা প্রতিযোগিতায় কিভাবে পারবো? এসব কারণেই দেশে বৈধভাবে স্বর্ণ আমদানি হচ্ছে না। অথচ ভারতে আমদানি শুল্ক আমাদের তুলনায় অনেক কম। ভারত সরকার বরং রপ্তানির ক্ষেত্রে অনেক সুযোগ-সুবিধা দেয়। এজন্যই তারা জুয়েলারির ক্ষেত্রে এত এগিয়েছে। তাই বিষয়টি নিয়ে আমাদের সরকারকে ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, প্রতিদিন সারাদেশের জল, স্থল ও আকাশ পথে কমপক্ষে প্রায় ২৫০ কোটি টাকার অবৈধ স্বর্ণ ও হীরার অলংকার ও বার চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসছে। যা ৩৬৫ দিন বা একবছর শেষে দাঁড়ায় প্রায় ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। দেশে চলমান ডলার সঙ্কটে এই ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার অর্থপাচার ও চোরাচালান বন্ধে প্রস্তাবিত বাজেটে কার্যকর কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
বাজুসের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ডা. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বর্ণ খাতে বেশি শুল্ক-করের বোঝা চাপিয়ে দিয়েও কিন্তু ফলাফল শূন্য। সরকারতো চাহিদা অনুযায়ী শুল্ক-কর পাচ্ছে না। ১৯টি প্রতিষ্ঠানকে স্বর্ণ আমদানির লাইসেন্স দেওয়া হলেও তারাই বলে যে আমরা স্বর্ণ আমদানি করতে পারছি না। নানা সমস্যার কারণে তারা আমদানি করতে পারছেন না। তারা যদি স্বর্ণ আমদানি করতে পারতো, আমরা তাদের থেকে কিনতে পারতাম। এরপর জিয়েলারি তৈরি করে রপ্তানি করতে পারতাম। আমরাতো সে সুযোগ পাচ্ছি না। সুযোগ না পেলে আমাদের যে রপ্তানি সম্ভাবনা আছে, সেটি কীভাবে কাজে লাগাবো?
বাজুসের সহ-সভাপতি মাসুদুর রহমান বলেন, সরকারকে বাজুস যে প্রস্তাবনাগুলো দিয়েছে, সেগুলো ভালো প্রস্তাব। সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে যারা আছেন, তারা কীভাবে অথবা কী চিন্তা করেন, সেটা তো আমাদের জানার বাইরে। যেমন- আমদানির ক্ষেত্রে লজিস্টিকসহ ১৪ থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশ ট্যাক্স পড়ছে। অন্যদিকে ব্যাগেজ রুল সহজ করে দিয়েছে। এই বৈষম্যের কারণে দেশে বৈধভাবে স্বর্ণ আমদানি হচ্ছে না। আমি মনে করি বাংলাদেশের স্বর্ণ খাতে উন্নয়নের ক্ষেত্রে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে সিদ্ধান্তটা হচ্ছে মূল প্রতিবন্ধকতা।
তিনি বলেন, সম্প্রতি আমরা অনেকগুলো ফেয়ার (মেলা) করছি। এগুলো কেন করা হচ্ছে? এগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বকে জানান দেওয়া, আমাদের রপ্তানির সক্ষমতা আছে। আমরা শুধু সরকারকে নাড়া দিতে চাচ্ছি, সুযোগ-সুবিধা চাচ্ছি। এখন সরকারের তো সদিচ্ছা থাকতে হবে। উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আপনি গার্মেন্টস খাতের উপর নির্ভর করছেন। কোনো কারণে এই সেক্টর যদি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে সহযোগিতা করতে না পারে, তখন কী হবে?
তিনি আরও বলেন, স্বর্ণ খাতে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার আয় করার উৎস রয়েছে। একটা সেক্টরকে উন্নত করতে গিয়ে যদি কিছু চাওয়া হয়, তাহলে সরকারের যারা নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে রয়েছেন সেখানে তাদের ভূমিকা নিতে হবে।
বাজুস সহ-সভাপতি বলেন, এখানে শুধু জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের বিষয় নয়। সুফল এলে দেশে ডলার আসবে, চোরাচালান বন্ধ হবে। হাজার-হাজার কোটি টাকা ডলার হয়ে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। অন্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে স্বর্ণের দাম বেশি। সেজন্য ব্যাগেজ রুলে দেশের বাইরে থেকে মানুষ স্বর্ণ কিনে আনছে। এই পদ্ধতি থেকে ফিরে এলে দেশের টাকা দেশেই থাকবে, ডলার দেশেই থাকবে এবং এই সেক্টরও উন্নত হবে। প্রতিবন্ধকতাগুলো সরকার যদি দূর করে দেয়, তাহলে খুব সহজেই এর সুফল দেশের মানুষ ভোগ করতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, এ খাতে আমাদের রপ্তানির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। বিএফআইইউ (বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) একটি রিপোর্ট দিয়েছে, যেখানে ২২ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্যের কথা বলা হয়েছে। সেখান থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা সরকার শুধু ভ্যাট পাবে। এটা বিএফআইইউর জরিপে উঠে এসেছে।
স্বর্ণ শিল্পের আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল (ডব্লিউজিসি) জুয়েলারি পণ্য রপ্তানিতে ২০২২ সালের শীর্ষ ১০০ দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে। সেখানে স্থান হয়নি বাংলাদেশের। এ তালিকায় শীর্ষ পাঁচ দেশ হচ্ছে চীন, সুইজারল্যান্ড, ভারত, হংকং ও ইতালি। বিশ্বে রপ্তানি করা অলংকারের অর্ধেকের বেশি (৫৩.৩ শতাংশ) এই পাঁচটি দেশের দখলে
>>আছে আরও নানা সমস্যা
জুয়েলারি রপ্তানির পথ সুগম করতে দেশে গোল্ড ব্যাংক ও গোল্ড এক্সচেঞ্জ প্রয়োজন। এছাড়া দরকার ইকোনমিক জোনেরও। দেশে জুয়েলারি তৈরির দক্ষ কারিগর থাকলেও উন্নত প্রযুক্তির কারখানায় কাজ করার মতো দক্ষ কারিগরের অভাব রয়েছে। এ খাতে রয়েছে আরও নানা সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ।
ভালো নেই স্বর্ণের কারিগররা
স্বর্ণের দাম অব্যাহতভাবে বেড়ে যাওয়ায় জুয়েলারি বেচাকেনাও ধারাবাহিকভাবে কমে গেছে। তার উপর বিশ্ববাজার থেকে বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে স্বর্ণের দাম বেশি। দামের ফারাকের জন্য মানুষ বিদেশ থেকে জুয়েলারি কিনে আনছেন। তার প্রভাবে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারসহ দেশের স্বর্ণশিল্পীদের কাজ কমেছে। এজন্য তাদের সংখ্যাও দিন দিন কমছে।
তাঁতীবাজারের স্বর্ণের কারিগর পবিত্র দর ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ৪৫ বছর ধরে এ কাজ করি। শুরুতে অবস্থা ভালো ছিল। এখন পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ। আমাদের সংসার চালানোটাই এখন কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জানি না এ পেশায় আবার কবে সুদিন আসবে।
তিনি বলেন, এখন স্বর্ণের দাম অনেক বেশি। আমাদের দেশেতো আরও বেশি। মানুষ কম দামে পেয়ে দেশের বাইরে থেকে স্বর্ণ কিনে আনছেন। এজন্য আমাদের কাজ অনেক কমে গেছে। কাজের অভাবে আমাদের এখানকার অনেকে পেশা বদলিয়েছেন। কেউ আবার সুযোগ পেয়ে দেশের বাইরে চলে গেছেন। সেখানে ভালো বেতনে কাজ করছেন। তাঁতীবাজারে আগে ২৫-৩০ হাজার মানুষ কাজ করতো৷ এখন সেখানে ৫ হাজারে নেমে এসেছে। সারা দেশেই একই অবস্থা। আমরা এখন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে আছি। এজন্য অনেক সময় হতাশায় থাকি।
কীভাবে সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে?
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মজিদ বলেন, স্বর্ণের জন্য একটি কমিউনিটি এক্সচেঞ্জ যদি আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারি এবং সেটা যদি কার্যকর করতে পারি তাহলে আমাদের স্বর্ণের সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং ব্যবহার; এগুলোর ক্ষেত্রে নতুন একটি সুযোগ হতে পারে। যেটা একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
এ প্রসঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শরীফ মোশাররফ হোসেন বলেন, আমার সুপারিশ হচ্ছে গোল্ড রিফাইনারি কারখানার কাঁচামাল হিসেবে অপরিশোধিত বা অর্ধ পরিশোধিত আকরিকের আমদানির ট্যারিফ শূন্য করে দিতে হবে। জুয়েলারি শিল্পে ব্যবহৃত বিভিন্ন পণ্যের আমদানি শুল্ক যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনতে হবে। এই শিল্পের উন্নয়নে গোল্ড কয়েন এবং বিভিন্ন ধরনের অলংকারের সম্ভাব্য বাজার খুঁজে বের করার জন্য আমাদের স্টাডি করতে হবে। এ স্টাডি করার ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন এবং বাজুস একযোগে কাজ করতে পারে। এরপর রপ্তানির জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের অধীনে এই খাতের জন্য আলাদা একটি ইকোনমিক জোন বরাদ্দ দিতে হবে, যেখানে যৌথ উদ্যোগে দেশীয়দের সঙ্গে বিদেশি উদ্যোক্তাও কারখানা স্থাপন করতে পারে। তাহলে দেশে উন্নত টেকনোলজি স্থানান্তরিত হবে। যদিও দেশে অলংকার তৈরির দক্ষ কারিগর রয়েছে কিন্তু উন্নত প্রযুক্তির কারখানায় কাজ করার মতো দক্ষ কারিগরের অভাব রয়েছে। যে কারিগরগুলো রয়েছে তারা মূলত হাতের কাজে বেশি পারদর্শী। তাদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। সর্বোপরি বাজুসকে গোল্ড রিফাইনারি ও জুয়েলারি শিল্পে উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
ড. শরীফ মোশাররফ হোসেন বলেন, সরকারি নীতির মাধ্যমে এ খাতকে যদি পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়, উদ্যোক্তারা যদি সময়োপযোগী এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেন তাহলে আশা করছি অদূর ভবিষ্যতে গোল্ড রিফাইনারি ও জুয়েলারি খাতকে একটি উদীয়মান রপ্তানি খাত হিসেবে দেখতে পারব এবং দেশের অর্থনীতিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারবে এ খাত।
তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ২৪ নভেম্বর বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে আসবে। তখন কিছু-কিছু সুবিধা আর মিলবে না, সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। রপ্তানি পণ্যে বাড়তি শুল্ক আরোপিত হবে। এ কারণে যে খাত সমস্যায় উপনীত হবে বলে মনে করা হচ্ছে সেটিই হচ্ছে রপ্তানি খাত। সম্প্রতি বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ কমে যেতে পারে।
আরও পড়ুন
এলডিসি প্রসঙ্গে অধ্যাপক শরীফ বলেন, এ দেশের রপ্তানির প্রধান উৎস হচ্ছে তৈরি পোশাক খাত। এ শিল্পের উত্থান হয়েছিল শুল্কমুক্ত সুবিধার কারণে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর পোশাক শিল্পের রপ্তানির উপর বড় ধরনের প্রভাব আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই দিকটি মাথায় রেখে আমাদের ভাববার সময় এখনই।
ড. শরীফ মোশাররফ হোসেন বলেন, আমরা একটি পণ্যের রপ্তানির উপর নির্ভরশীল। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অন্যান্য খাতেও বাজারের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে। অন্য কোন পণ্য রপ্তানি করতে সক্ষম এ রকম খাত খুঁজে বের করতে হবে। খুঁজে বের করে তাদের প্রয়োজনীয় নীতিগত সহায়তা দিতে হবে। আমি মনে করি গোল্ড রিফাইনারি এবং জুয়েলারি খাতে প্রচুর রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, এই খাতে উৎপাদিত পণ্যের বিপুল চাহিদা রয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে। এই খাতে কাজ করার জন্য দক্ষ কর্মীর যোগান রয়েছে আমাদের দেশে। আর বিনিয়োগের জন্য আগ্রহী উদ্যোক্তাও রয়েছে।
বাজুসের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ডা. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের রপ্তানির সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে বিশ্ববাজার ধরতে হলে সরকারি পর্যায় থেকে সহযোগিতা করতে হবে। এ খাতের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল এবং মেশিনারিজ আমদানি করার ক্ষেত্রে শুল্ক কমাতে হবে। পাশের দেশ ভারত পারলে আমাদের দক্ষ কারিগর থাকতে আমরা কেন পারব না? আমরা চাই শুল্ক-কর অন্তত ভারত সরকার যা নির্ধারণ করেছে তা অনুযায়ী করা হোক।
তিনি বলেন, আগামী পাঁচ বছরের জন্য এই খাতকে সুযোগ দিতে হবে। সরকার যদি বলে আপনাদেরকে সুযোগ-সুবিধা দিলাম, রপ্তানি করে বৈদিশিক মুদ্রা নিয়ে আসেন। তাহলে দেখবেন সম্ভাবনা কতটুকু। সরকার সুযোগ দিলে এখানে কর্মসংস্থানেরও ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। ছোট-ছোট কারখানা গড়ে উঠবে এবং সেগুলোতে দক্ষ-অদক্ষ অনেক লোক কাজ করার সুযোগ পাবে। বর্তমানে যে দুরবস্থা চলছে সেটিও কেটে যাবে। সবমিলিয়ে এটা দেশের জন্যই মঙ্গল হবে।
বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্যাক্সেশনের চেয়ারম্যান ও কার্যনির্বাহী সদস্য আনোয়ার হোসেন বলেন, সরকারি প্রণোদনা ও মেশিনারিজ আমদানিতে শুল্ক-কর রেয়াতের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের স্বর্ণশিল্পীদের হাতে তৈরি জুয়েলারি পণ্য স্থানীয় ও বিশ্ব বাজারে সমানভাবে সমাদৃত। কিন্তু এই খাতের সঠিক পরিচর্যার অভাবে স্থানীয় স্বর্ণশিল্পীরা কাজের অভাবে দুঃখ-দুর্দশায় জীবন-যাপন করছেন। স্থানীয় কারিগররা পেশা বদল করে অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। কেউ-কেউ বিদেশেও চলে গেছেন। এই সংকট মোকাবিলায় সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এই খাতের সফলতায় সরকারের বৈদেশিক আয় আসবে, তেমনি বাড়বে রাজস্ব আয়।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, যখন আমরা আশির দশকে গার্মেন্টস শুরু করি তখন বাংলাদেশের অবস্থান কোথায় ছিল? কোথাও ছিল না, কিন্তু সেখান থেকে তো আমরা দুই নম্বর অবস্থানে চলে এসেছি। শুরুটা যদি ভালো হয়, ভিত্তি যদি ভালো হয় আর পলিসি যদি ঠিক থাকে তাহলে কিন্তু নিজেদের জায়গা করে নিতে খুব একটা অসুবিধা হয় না।
২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর ‘স্বর্ণ নীতিমালা-২০১৮’ অনুমোদন দেওয়া হয়, যা ২০২১ সালের অক্টোবরের ২৮ তারিখ সংশোধন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
নীতিমালায় বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বর্ণ নীতিমালার কোথায়-কোথায় সমস্যা রয়েছে পুরো তথ্য আমাদের দিন, তাহলে অবশ্যই আমরা এটা নিয়ে কাজ করব।
স্বর্ণ পরিশোধনাগার স্থাপনে আশা বাড়ছে
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে এই প্রথম স্বর্ণ পরিশোধনাগার স্থাপন হচ্ছে। 'বসুন্ধরা গোল্ড রিফাইনারি লিমিটেড' নামে এ স্বর্ণ পরিশোধনাগার নির্মাণের অনুমতি পেয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ। রাজধানীর ৩০০ ফুট ঢাকা-পূর্বাচল হাইওয়ের পাশে জোয়ার সাহারা এলাকায় ৪৭০ শতক জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে এই পরিশোধনাগার।
অপরিশোধিত ও আংশিক পরিশোধিত স্বর্ণ আমদানির পর তা কারখানায় পরিশোধনের মাধ্যমে স্বর্ণের বার ও জুয়েলারি উৎপাদন করা হবে। সেগুলো রপ্তানির পাশাপাশি দেশে জুয়েলারি তৈরিতে ব্যবহৃত হবে। নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে এ পরিশোধনাগারে দিনে ২০০ কেজি স্বর্ণবার ও ১৫০ কেজি জুয়েলারি উৎপাদিত হবে।
বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্যাক্সেশনের চেয়ারম্যান ও কার্যনির্বাহী সদস্য আনোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সর্ব প্রথম স্বর্ণ পরিশোধনাগার স্থাপন করতে যাচ্ছে। বিশ্ব বাজারে আর কিছু দিন পর রপ্তানি হবে 'মেইড ইন বাংলাদেশ' সম্বলিত স্বর্ণের বার ও জুয়েলারি পণ্য। যা এ শিল্পকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারের পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে বড় ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু এই পরিশোধনাগারের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির শুল্ক-কর ৩০-৬০ শতাংশ, যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এজন্য স্বর্ণ পরিশোধনাগার শিল্পে আমরা ১০ বছর কর অবকাশ চাই।
বাজুসের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ডা. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বর্ণ পরিশোধন শুরু হলে দেশের ভেতর থেকেই বৈধভাবে স্বর্ণ কেনার সুযোগ পাবেন ব্যবসায়ীরা। এতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভোক্তারাও উপকৃত হবেন। এ ছাড়া জুয়েলারি রপ্তানির সম্ভাবনাও তৈরি হবে।
এসএইচআর/এমজে