বাংলাদেশের রেলপথ ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ সহজ ও উন্নত করার জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ ও ভারত। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এ সুযোগ নিতে যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশটি। তারা এমন সুযোগ পেলে বাংলাদেশ কি লাভবান হবে— তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সংশ্লিষ্ট মহলে।

গত ২২ জুন (শনিবার) ভারতের নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউজে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর এ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করা হয়। সমঝোতা স্মারকে রয়েছে- রাজশাহী ও কলকাতার মধ্যে নতুন একটি আন্তর্দেশীয় ট্রেন-সার্ভিস চালু করা এবং বাংলাদেশে ভারতের রেল-ট্রানজিট।

এর আগে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে একগুচ্ছ রেলপথ তৈরির পরিকল্পনা করে ভারত। ইতোমধ্যে দেশটি ১৪টি রেলপথের জন্য ফাইনাল লোকেশন সার্ভে (এফএলএস) অনুমোদন করেছে বলে জানা গেছে। নতুন রেলপথগুলো বাংলাদেশ ছাড়াও নেপালকে যুক্ত করবে। এ পরিকল্পনায় বাংলাদেশের ভেতরে থাকবে ৮৬১ কিলোমিটার রেলপথ।

সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা জানান, বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে ব্যবহার করে ভারতের এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে রেলওয়ে সংযোগ চালু করতে দুই নেতার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের পথ ব্যবহার করে গেদে-দর্শনা দিয়ে হলদিবাড়ি-চিলাহাটি ক্রস-বর্ডার ইন্টারচেঞ্জ পয়েন্ট পর্যন্ত একটি পণ্যবাহী ট্রেনের ট্রায়াল চালানো হবে। আগামী জুলাই মাসের কোনো এক সময়ে এটি হতে পারে। এটি ভুটানের সঙ্গে উপ-আঞ্চলিক সংযোগে সহায়তা করবে।

বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে একগুচ্ছ রেলপথ তৈরি হলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে রেলওয়ে যোগাযোগ সহজ ও উন্নত হবে। এটি বাংলাদেশ ছাড়াও নেপালকে যুক্ত করবে। নতুন পরিকল্পনার আওতায় মোট এক হাজার ২৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথের ১৪টি সেকশন থাকবে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ভেতরে থাকবে ৮৬১ কিলোমিটার। নেপালে ২০২ কিলোমিটার এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে থাকবে ২১২ কিলোমিটার রেলপথ

তবে, বাংলাদেশের রেলপথ ব্যবহার করে ভারতই বেশি লাভবান হবে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এর আগে নৌ-করিডোর নিয়ে চুক্তি হলেও বাংলাদেশ বেশি লাভবান হতে পারেনি। আবার ট্রেনে যাত্রী পরিবহনে বাংলাদেশ লাভ করলেও পণ্য পরিবহনে খুব বেশি লাভ করতে পারবে না।

সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৭৭ বছর পর রাজশাহী ও কলকাতার মধ্যে পুনরায় আন্তর্দেশীয় ট্রেন সার্ভিস চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। এটি হবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চলাচলকারী চতুর্থ আন্তর্দেশীয় ট্রেন। এ ছাড়া এ স্মারকের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, বাংলাদেশের রেলপথ ব্যবহার করে ভারতের কলকাতা থেকে সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত সাত রাজ্যের ১২টি রুটের দূরত্ব ও সময় কমিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ। ফলে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে ব্যাপক সুবিধা পাবে দেশটি।

গুগল ম্যাপের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে কলকাতা থেকে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ‘চিকেন নেক’ করিডোর হয়ে আগরতলা পর্যন্ত রেলপথের দূরত্ব প্রায় এক হাজার ৬০০ কিলোমিটার। এটি পাড়ি দিতে সময় লাগে ৩১ থেকে ৩৬ ঘণ্টা। এটি বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ঢাকা হয়ে পাড়ি দিতে দূরত্ব কমে দাঁড়াবে প্রায় ৫০০ থেকে ৫৫০ কিলোমিটার। পাড়ি দিতে সময় লাগবে সাড়ে ১১ থেকে ১২ ঘণ্টা।

গত ১৪ জুন ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ভারতের অপর অংশের যোগাযোগের একটিই রেলপথ, যেটি শিলিগুড়ি করিডোর হয়ে গেছে। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ করিডোর ‘চিকেন নেক’ নামে পরিচিত। এটি উপমহাদেশের সবচেয়ে সরু ভূমি। চিকেন নেকের উত্তরে নেপাল এবং দক্ষিণে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত। অন্যদিকে, চীন সীমান্ত থেকে এটির দূরত্ব ১৭০ কিলোমিটার।

বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে একগুচ্ছ রেলপথ তৈরি হলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে রেলওয়ে যোগাযোগ সহজ ও উন্নত হবে। এটি বাংলাদেশ ছাড়াও নেপালকে যুক্ত করবে। নতুন পরিকল্পনার আওতায় মোট এক হাজার ২৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথের ১৪টি সেকশন থাকবে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ভেতরে থাকবে ৮৬১ কিলোমিটার। নেপালে ২০২ কিলোমিটার এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে থাকবে ২১২ কিলোমিটার রেলপথ।

দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার দেশের ভেতরে ভারতকে রেলপথ স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় নয়াদিল্লির পরিকল্পনা সহজ হয়েছে। ভারতীয় রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে মোট ৮৬১ কিলোমিটার, নেপালে ২০২ দশমিক ৫০ কিলোমিটার এবং উত্তরবঙ্গ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২১২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে জরিপ চালানো হবে।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, কলকাতা থেকে যদি আগরতলা বলি তাহলে তাদের দূরত্ব ও ব্যয় কমে যাবে। এটিই তাদের মূল উদ্দেশ্য। ফলে ভারত ব্যাপকভাবে লাভবান হবে।

‘ভারতের কানেক্টিভিটির প্রত্যেকটি রুট আমাদের দিক থেকে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা উচিত। আমাদের সেকশন ও রেলপথের ক্যাপাসিটি বিবেচনায় নেওয়া উচিত। যেহেতু তারা আর্থিকভাবে ব্যাপক লাভবান হবে এবং তাদের যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের সক্ষমতা বাড়বে, সেই জায়গায় আমাদের দরকষাকষি খুব ভালোভাবে হওয়া উচিত। সেকশন ও রেলপথের ক্যাপাসিটির বাইরে আমরা কীভাবে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারি, বিষয়টি খুব ভালোভাবে দেখতে হবে। এটি যেন এমন না হয় যে, শুধু ভারত আমাদের ভেতর দিয়ে গিয়ে ভুটানের সঙ্গে কানেক্টিভিটি তৈরি করবে। আমরা যেন সেই কানেক্টিভিটির সুবিধাভোগী হতে পারি, সেটিও দেখতে হবে এবং গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। ভারতকে সুবিধা দিতে গিয়ে আমাদের যেন লোকসানে পড়তে না হয়, সেটি আগে বিবেচনায় নিতে হবে।’

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেন, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারত যে রেল-সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে যোগাযোগের যে নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে চায়, তা আদতে একটি ‘ওপেন ডোর’ পলিসি। এ সম্পর্ক উন্নয়নের মূল কথা হলো, ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমতাভিত্তিক উন্নয়নের সুযোগ দেওয়া। কেউ এগিয়ে যাবে, কেউ পিছিয়ে যাবে— এ নীতিতে আসলে উন্নয়ন স্থিতিশীল হয় না।

‘আঞ্চলিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি চমৎকার ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে। আমাদের কোস্ট লাইন বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। সুযোগটি কিন্তু প্রতিবেশী ভারতের সেভেন সিস্টারস, নেপাল বা ভুটানের নেই। সেই জায়গায় বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থানের সুযোগ নিতে পারে।’

রেল-ট্রানজিটে কীভাবে বাংলাদেশ লাভবান হবে— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ভারত বাংলাদেশের যে রেলপথ দিয়ে আন্তর্দেশীয় যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ করতে চায়, সেই রেলপথের জন্য পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা করতে হবে। অন্য একটি দেশের ট্রেন যখন দেশে ঢুকবে, তখন কিন্তু ট্রেনের অপারেশনাল ডিজরাপশন (পরিচালনায় ব্যাঘাত) তৈরি হবে। তারপর সিকিউরিটির জন্য টাকা খরচ আছে। আমার অবকাঠামো অবচয় কত হবে, প্রতি বছর সেটি হিসাব করতে হবে। ভারত যে সুবিধা পাবে তা যেন নেপাল ও ভুটানও সমভাবে পায়। শুধু যেন একটি দেশ সুবিধা না পায়, সেটিও দেখতে হবে। আমি যখন মাশুল নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে আলোচনার টেবিলে বসব, তখন জেনে নিতে হবে প্যাসেঞ্জার বা কার্গো রেল-চলাচলে আমাদের হিস্যা কী হবে। কারণ আমরা দেখছি, নৌ-বন্দর আর সমুদ্র বন্দরে আমাদের হিস্যা ন্যায্য নয়।’

‘অধ্যাপক ড. রহমতউল্লাহ স্যারের তত্ত্বাবধানে বহু বছর আগে একটি সমীক্ষা হয়েছিল। আন্তর্দেশীয় যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে প্রতি বছর এক বিলিয়ন ডলার পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল বাংলাদেশের।’

বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে আন্তর্দেশীয় রেল-যোগাযোগ নিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী বলেন, ‘দুটি বিষয়ে এখানে এসেছে; একটি হচ্ছে রাজশাহী থেকে একটি ট্রেন কলকাতায় যাবে, আরেকটি হচ্ছে রেল-ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট। রাজশাহীবাসীর একটি দাবি দীর্ঘদিন ধরে ছিল যে, রাজশাহী থেকে দর্শনা হয়ে তারা ট্রেনে কলকাতা যাবেন। এ ট্রেন চালাতে আমাদের বিদ্যমান রেললাইনে কোনো সমস্যা নেই। আমাদের হাতে যে ব্রডগেজ ইঞ্জিন রয়েছে, সেটি দিয়ে আমরা ১/২টি ট্রেন সপ্তাহে ২/৩ দিন চালাতে পারব। কিন্তু আমাদের ক্যারেজ সমস্যা আছে। অর্থাৎ ব্রডগেজ কোচ নেই। প্রাথমিক এ সময়টায় ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের কোচ দিয়ে চালানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা যেহেতু ২০০টি ব্রডগেজ কোচ ভারত থেকে আমদানি করছি, ৮/৯ মাস পরে সেগুলো হাতে পেলে আর এ সমস্যা থাকবে না। এতে করে দুই দেশের রাজস্ব আয় বাড়বে। আমাদের প্রয়োজনটা বেশি। রাজশাহী থেকে দর্শনা পর্যন্ত যে দূরত্ব, দর্শনা থেকে কলকাতা বা শিয়ালদা পর্যন্ত দূরত্ব কম। ফলে এখানে আমরা রাজস্ব আয় বেশি পাব।’

রেল-ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের যে ইন্টারচেঞ্জ পয়েন্ট আছে, এর বাইরে আগরতলা রুট; এ রুট দিয়ে ট্রেন চলাচল করানো হয়েছে, ট্রায়াল রান করানো হয়েছে। এ রুট দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ভারত যখনই চাইবে তখনই মালামাল পরিবহন করতে পারবে। সেই ব্যবস্থা আমাদের নেওয়া হয়েছে। কুলাউড়া-শাহবাজপুর রুটের কাজ চলছে। প্রস্তাবিত রুট হিসেবে রয়েছে ফেনী-বেলুনিয়া। বুড়িমারী-চ্যাংড়াবান্ধা, মোগলহাট-গীতলগাও রুটের কথাও ভাবা হচ্ছে।

‘আগরতলা-আখাউড়া দিয়ে কলকাতা পর্যন্ত সরাসরি ট্রানজিট হবে না। কারণ, আখাউড়া থেকে টঙ্গী পর্যন্ত তো মিটারগেজ ট্র্যাক। আমরা চিন্তা করছি, পদ্মা ব্রিজ পার হওয়ার পর নিমতলীতে অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার ডিপো বা আইসিডি করব। সেখান থেকে ট্রান্সশিপমেন্ট করে পণ্য কলকাতায় যাবে। ভারত থেকে মালবাহী বা প্যাসেঞ্জার যে ট্রেনই চলুক না কেন, আমরা রাজস্ব পাব। ট্যারিফ কমিশন একটা ভাড়া ঠিক করে দেবে। তাতে রাষ্ট্র আর্থিকভাবে লাভবান হবে। এখানে একতরফাভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই। তবে যাত্রীবাহী ট্রেন থেকে মালবাহী ট্রেনে আমাদের সাত-আট গুণ বেশি লাভ হয়।’

গত ১০ জুন জাতীয় সংসদ রেলপথমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম জানান, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে রেলওয়ের আয় নির্ভর করে মূলত মালবাহী ট্রেনের আয়ের ওপর। একটি যাত্রীবাহী ট্রেনের গড় আয় যেখানে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা, সেখানে একটি মালবাহী ট্রেনের গড় আয় প্রায় সাত থেকে আট লাখ টাকা। বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের যাত্রীবাহী প্রতিটি ট্রেনের ধারণক্ষমতা প্রায় ১০০-১২০ শতাংশ। কিন্তু মালবাহী ট্রেন চলাচল করে মাত্র ২০-২৫টি।

এমএইচএন/এমএআর