সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস সিলিন্ডারের বিক্রি বাড়লেও বাড়েনি নজরদারি, নেওয়া হয়নি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা

গত ১৮ মার্চ রাজধানীর মহাখালী ফ্লাইওভারে যান্ত্রিক গোলযোগের পর সিলিন্ডার বিস্ফোরণে পুড়ে যায় একটি প্রাইভেটকার। গত ২৬ মার্চ রাজশাহীর কাটাখালীতে বাস-মাইক্রোবাস-লেগুনার ত্রিমুখী সংঘর্ষের পর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনে পুড়ে দগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে মারা যান ১১ জন, হাসপাতালে আরও ছয়জন। ফায়ার সার্ভিস বলছে, দুর্ঘটনার পর সিলিন্ডারের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে মাইক্রোবাসের ভেতরেই আগুনে পুড়ে নিহত হন তারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে গ্যাসের ব্যবহার এবং বোতলজাত গ্যাস বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও দুর্ঘটনার ঘটনাও বাড়ছে। গ্যাস সিলিন্ডার যেন তাজা বোমা। সম্পদহানির পাশাপাশি মৃত্যুর মতো অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। বাসাবাড়ি, দোকান, মার্কেট কিংবা গাড়িতে লাগানো গ্যাস সিলিন্ডার এখন আতঙ্কের নাম। সময়ের সঙ্গে এর বিক্রি বাড়লেও বাড়েনি নজরদারি, নেওয়া হয়নি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সিএনজি, এলপিজি, অক্সিজেনসহ বিভিন্ন গ্যাস সিলিন্ডারের খুচরা ব্যবসায় বিশেষ কোনো নজরদারি নেই। অনেক খুচরা ব্যবসায়ী ও ব্যবহারকারী সিলিন্ডার রক্ষণাবেক্ষণের যথাযথ নিয়ম জানেন না। সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে এ বিষয়ে নেই কোনো সঠিক পরিসংখ্যান। অনিয়মে শাস্তির বিধান থাকলেও প্রয়োগ নেই। সরকারের উচিত খুব শিগগিরই এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। পাশাপাশি আইন করে যানবাহনের ফিটনেস নেওয়ার সময় সিলিন্ডার রিটেস্ট (পুনঃনিরীক্ষণ) বাধ্যতামূলক করা উচিত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)।

দেশে সিএনজি, এলপিজি, অক্সিজেনসহ বিভিন্ন গ্যাস সিলিন্ডারের খুচরা ব্যবসায় বিশেষ কোনো নজরদারি নেই। অনেক খুচরা ব্যবসায়ী ও ব্যবহারকারী সিলিন্ডার রক্ষণাবেক্ষণের যথাযথ নিয়ম জানেন না। সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে এ বিষয়ে নেই কোনো সঠিক পরিসংখ্যান। অনিয়মে শাস্তির বিধান থাকলেও প্রয়োগ নেই। সরকারের উচিত খুব শিগগিরই এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া

ফায়ার সার্ভিস ও হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত ৮ মার্চ নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পশ্চিম মাসদাইরে এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মারা যান চারজন। কুমিল্লার গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গত ১১ মার্চ একটি বাসের সিএনজি সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুনে পুড়ে মারা যান দু’জন। আহত হন ১১ জন। গত ২২ জানুয়ারি কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে বেলুনের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নিহত হন অন্তত তিনজন। ১১ জানুয়ারি বরগুনার পাথরঘাটার একটি বরফ কলে অ্যামোনিয়ার গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে একজন নিহত হন। আহত হন শতাধিক।

রাজশাহীর কাটাখালীতে বাস-মাইক্রোবাস-লেগুনার ত্রিমুখী সংঘর্ষের পর অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়ে মারা যান ১৭ জন

ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে গ্যাস লাইন ও গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ৯৫৭টি। ক্ষতি হয় তিন কোটি ৭৬ লাখ ৮২ হাজার ২৯০ টাকার সম্পদের। আহত হন ১৪ জন। প্রাণ যায় দু’জনের। ২০১৯ সালে সারাদেশে একই কারণে আগুনের ঘটনা ঘটে ৮১৮টি। ক্ষতি হয় ১২ কোটি ১৫ লাখ ১২ হাজার টাকার সম্পদের। মারা যান ২৫ জন, আহত হন ৬৯ জন।

আছে অনুমোদন, নেই দেখভালের দায়

সব ধরনের গ্যাস সিলিন্ডার (এলপি, অক্সিজেন) মজুত ও বিক্রির অনুমোদন দেয় বিস্ফোরক অধিদফতর। তবে অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান কোথায় ও কীভাবে সেগুলো খুচরা বিক্রি করছে, তা দেখভালের দায়িত্ব পালন করে না প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি আইনি বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও সে দায় নিচ্ছে না বিস্ফোরক অধিদফতর।

এছাড়া যানবাহনে ব্যবহৃত সিলিন্ডারসহ সব ধরনের গ্যাস সিলিন্ডার পুনঃনিরীক্ষণের (রিটেস্ট) অনুমোদন দেয় বিস্ফোরক অধিদফতর। প্রতি পাঁচ বছর পর গাড়িতে লাগানো গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষার নিয়ম থাকলেও রিপোর্ট জমা দেয় মাত্র ১৪/১৫ হাজার যানবাহন।

এ বিষয়ে অধিদফতরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা অনুমোদন দেই আমদানি, মজুত ও বিক্রির। কিন্তু খুচরা বা দোকানে দোকানে এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার বিক্রির বিষয়টি আমরা দেখভাল করি না। যদিও এটা এখন বড় সমস্যা। এলপিসহ সিলিন্ডার যারা বিক্রি করছে সেই কোম্পানিগুলোর উচিত এর তদারকি, সচেতনতা এবং বিক্রি-পরবর্তী সেবা দেওয়া।’

গ্যাস সিলিন্ডার যেন তাজা বোমা। সম্পদহানির পাশাপাশি মৃত্যুর মতো অপূরণীয় ক্ষতিও হচ্ছে

সিলিন্ডার বিস্ফোরণসহ যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে সেজন্য কি অধিদফতরের দায় নেই— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, আমাদের কোনো দায় নেই। দায় তো তাদের যারা অনুমোদন নিয়েছে। প্রতি বছর তাদের রিপোর্ট দেওয়ার কথা। সেটাও তারা করে না। খুচরা বিক্রেতাদের অনেকে আবার সঠিকভাবে সিলিন্ডার সংরক্ষণ করেন না।’

‘তবে গ্যাস সিলিন্ডারের যত্রতত্র বিক্রি বন্ধ করা জরুরি’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘খুচরা বা মুদি দোকানদারদের কাছে থাকা সিলিন্ডারগুলো অল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা হালকা লিকেজ হলে তা তারা বুঝতে পারেন না। পরে ওই ক্ষুদ্র লিকেজ বা ত্রুটি গ্রাহকপর্যায়ে বড় দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।’

গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালার অপব্যবহারে শাস্তির বিধান আছে, প্রয়োগ নেই

গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালা- ১৯৯১ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বিনা লাইসেন্সে গ্যাসপূর্ণ সিলিন্ডার আমদানি বা লাইসেন্সের কোনো শর্ত লঙ্ঘন করে সিলিন্ডারে গ্যাস ভর্তি করলে ন্যূনতম দুই বছর, সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আবার গ্যাসপূর্ণ সিলিন্ডার বিনা লাইসেন্সে অধিকারে রাখলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

শাস্তির বিধান ও বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে বিস্ফোরক পরিদর্শক মনিরা ইয়াসমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘স্ট্যান্ডার্ড (মান) মেনে অনুমোদন পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবেদন দেবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর গোডাউন স্টোরেজ ঠিক আছে কি না, সেটা আমরা দেখি। বছর বছর তা নবায়নও করা হয়। কিন্তু বড় বড় প্রতিষ্ঠান যারা খুচরা বিক্রি করছে, সেটি আমরা দেখি না। তবে, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা তদন্ত করি।’

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় অবস্থিত বিস্ফোরক অধিদফতর

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাসাবাড়িতে অনেকে সঠিকভাবে এলপিজি সিলিন্ডার সংযোগ দিতে পারেন না। লিক থাকলেও অনেকে তা বুঝতে পারেন না। গ্যাস সিলিন্ডার তাজা বোমার মতো। সামান্য লিক থেকে অনেক বড় দুর্ঘটনা ঘটে। অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সিলিন্ডার বিক্রি ও পরবর্তী সেবা নিশ্চিত করা জরুরি। এক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে।’

জেইউ/এমএআর/