ঢাকা ও খুলনা থেকে ভারতের কলকাতা ও নিউ জলপাইগুড়ি রুটে নিয়মিত চলাচল করে আন্তঃদেশীয় মোট তিনটি ট্রেন। ডলারের দাম বাড়ার কারণ দেখিয়ে আবারও এসব রুটে ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এটি নিয়ে করোনার পরের দুই বছরে আন্তঃদেশীয় ট্রেনের ভাড়া পঞ্চমবারের মতো বাড়তে যাচ্ছে। আগামী ১৫ জুনের যাত্রা থেকে যাত্রীদের নতুন এ ভাড়া গুনতে হবে।

এভাবে ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আন্তঃদেশীয় ট্রেনের যাত্রীরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশ রেলওয়ে দফায় দফায় ভারতগামী ট্রেনের ভাড়া বাড়াচ্ছে। ভাড়া বাড়াতে বাড়াতে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে ট্রেনের ভাড়া বাসের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এটি বিমানের ভাড়ার কাছাকাছি গিয়ে ঠেকেছে। এমন অবস্থায় যাত্রী হারাতে পারে আন্তঃদেশীয় ট্রেনগুলো।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার সময় আন্তঃদেশীয় ট্রেন-চলাচল দুই বছর বন্ধ ছিল। ২০২২ সালের ২৯ মে ঢাকা-কলকাতা-ঢাকা ও খুলনা-কলকাতা-খুলনা রুটে যথাক্রমে মৈত্রী এক্সপ্রেস ও বন্ধন এক্সপ্রেস চলাচল শুরু করে। এর মধ্য দিয়ে আবারও আন্তঃদেশীয় ট্রেন-যোগাযোগ চালু হয়। এর দুদিন পর ১ জুন চলাচল শুরু করে আন্তঃদেশীয় ট্রেন মিতালী এক্সপ্রেস। ট্রেনটি সর্বশেষ বাংলাদেশ-ভারত রুটে চলাচল করেছিল ১৯৬৫ সালে।

করোনার পর ২০২২ সালের ২৯ মে ফের আন্তঃদেশীয় ট্রেন চলাচল শুরুর আগে ২৩ মে তিনটি ট্রেনের ভাড়া বাড়ায় বাংলাদেশ রেলওয়ে। সেটি ২৪ মে থেকে কার্যকর হয়।

ওই সময় দেখা যায়, মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনের এসি সিট (কেবিন) ভাড়া তিন হাজার ৬০৫ টাকা এবং এসি চেয়ারের ভাড়া দুই হাজার ৫৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। বন্ধন এক্সপ্রেস ট্রেনের এসি সিট (কেবিন) ভাড়া দুই হাজার ৫৫ টাকা এবং এসি চেয়ারের ভাড়া এক হাজার ৫৩৫ টাকা করা হয়। মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনের এসি বার্থ (শুয়ে যাওয়ার কেবিন) ভাড়া পাঁচ হাজার ২৫৫ টাকা, এসি সিট (বসে যাওয়ার কেবিন) ভাড়া তিন হাজার ৪২০ টাকা এবং এসি চেয়ারের ভাড়া দুই হাজার ৭৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

দ্বিতীয় দফায় অর্থাৎ ওই বছরের (২০২২ সাল) ৩০ নভেম্বর ডলারের দাম বাড়ার সঙ্গে সমন্বয় করে আন্তঃদেশীয় তিনটি ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো হয় এবং ১ ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর হয়।

ওই সময় দেখা যায়, মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনের এসি সিট (কেবিন) ভাড়া চার হাজার ১৯৫ টাকা এবং এসি চেয়ারের ভাড়া দুই হাজার ৯৬৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। বন্ধন এক্সপ্রেস ট্রেনের এসি সিট (কেবিন) ভাড়া দুই হাজার ৩৫০ টাকা এবং এসি চেয়ারের ভাড়া এক হাজার ৭৩৫ টাকা করা হয়। মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনের এসি বার্থ (শুয়ে যাওয়ার কেবিন) ভাড়া পাঁচ হাজার ৯১৫ টাকা, এসি সিট (বসে যাওয়ার কেবিন) ভাড়া চার হাজার ৬৫ টাকা এবং এসি চেয়ারের ভাড়া তিন হাজার ২১০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

তৃতীয় দফায় ২০২৩ সালের ৬ জুন আবারও ডলারের দাম বাড়ার সঙ্গে সমন্বয় করে আন্তঃদেশীয় তিনটি ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো হয় এবং ১ জুলাই থেকে কার্যকর করা হয়।

ওই সময় দেখা যায়, মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনের এসি সিট (কেবিন) ভাড়া চার হাজার ৭৯৫ টাকা এবং এসি চেয়ারের ভাড়া তিন হাজার ৫৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। বন্ধন এক্সপ্রেস ট্রেনের এসি সিট (কেবিন) ভাড়া দুই হাজার ৯০০ টাকা এবং এসি চেয়ারের ভাড়া দুই হাজার ২৬৫ টাকা করা হয়। মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনের এসি বার্থ (শুয়ে যাওয়ার কেবিন) ভাড়া ছয় হাজার ৫৭০ টাকা, এসি সিট (বসে যাওয়ার কেবিন) ভাড়া চার হাজার ১৭৫ টাকা এবং এসি চেয়ারের ভাড়া তিন হাজার ৭৮৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

চতুর্থ দফায় অর্থাৎ ওই বছরের (২০২৩ সাল) ৫ অক্টোবর ডলারের দাম বাড়ার সঙ্গে সমন্বয় করে আন্তঃদেশীয় তিনটি ট্রেনেরই ভাড়া বাড়ানো হয় এবং ১০ নভেম্বর থেকে তা কার্যকর করা হয়।

ওই সময় দেখা যায়, মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনের এসি সিট (কেবিন) ভাড়া চার হাজার ৯০০ টাকা এবং এসি চেয়ারের ভাড়া তিন হাজার ৬০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। বন্ধন এক্সপ্রেস ট্রেনের এসি সিট (কেবিন) ভাড়া দুই হাজার ৯৫০ টাকা এবং এসি চেয়ারের ভাড়া দুই হাজার ৩০০ টাকা করা হয়। মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনের এসি বার্থ (শুয়ে যাওয়ার কেবিন) ভাড়া ছয় হাজার ৭২০ টাকা, এসি সিট (বসে যাওয়ার কেবিন) ভাড়া চার হাজার ২৯০ টাকা এবং এসি চেয়ারের ভাড়া তিন হাজার ৮৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

সর্বশেষ পঞ্চম দফায় আগামী ১৫ জুলাই থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে আরেকটি নতুন ভাড়া। এটিও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সমন্বয় করে করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনের এসি সিট (কেবিন) ভাড়া ৫ হাজার ১১০ টাকা এবং এসি চেয়ারের ভাড়া ৩ হাজার ৭৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বন্ধন এক্সপ্রেস ট্রেনের এসি সিট (কেবিন) ভাড়া ৩ হাজার ৫৫ টাকা এবং এসি চেয়ারের ভাড়া ২ হাজার ৩৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এবং মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনের এসি বার্থ (শুয়ে যাওয়ার কেবিন) ভাড়া সাত হাজার ২৫ টাকা, এসি সিটের ভাড়া ৪ হাজার ৫২০ টাকা এবং এসি চেয়ারের ভাড়া ৪ হাজার ১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

শুধু মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনের এসি সিটের ভাড়া ছাড়া বাকি প্রতিটি ট্রেনের ভাড়ার মধ্যে সরকারের ট্রাভেল ট্যাক্স অন্তর্ভুক্ত আছে।

ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আন্তঃদেশীয় ট্রেনের যাত্রীরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশ রেলওয়ে দফায় দফায় ভারতগামী ট্রেনের ভাড়া বাড়াচ্ছে। ভাড়া বাড়াতে বাড়াতে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে ট্রেনের ভাড়া বাসের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এটি বিমানের ভাড়ার কাছাকাছি গিয়ে ঠেকেছে। এমন অবস্থায় যাত্রী হারাতে পারে আন্তঃদেশীয় ট্রেনগুলো

বাসের ডাবল, বিমানের ছুঁইছুঁই

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আন্তঃদেশীয় রুটে বিআরটিসি-শ্যামলী বাসে ঢাকা থেকে কলকাতা পর্যন্ত ভাড়া লাগে দুই হাজার থেকে দুই হাজার ৩০০ টাকা। একই বাসে ঢাকা থেকে শিলিগুড়ি যেতে ভাড়া লাগে দুই হাজার থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা। অন্যদিকে বাংলাদেশ বিমান, নভোএয়ার ও ইউএস-বাংলার একটি ফ্লাইটে ঢাকা থেকে কলকাতা যেতে ভাড়া লাগে আট থেকে নয় হাজার টাকা।

যা বলছেন যাত্রীরা

আন্তঃদেশীয় রুটে ট্রেনে চলাচল করা যাত্রী আশরাফুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভারতে যাওয়ার ট্রেনের ভাড়া বেশ কয়েকবার বাড়ানো হলো। সবসময় ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কথা বলা হয়। ভাড়া বাড়াতে বাড়াতে এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে ট্রেনের ভাড়া এখন বাসের ভাড়ার ডাবল (দ্বিগুণ)। অন্যদিকে, এটি বিমানের ভাড়ার কাছাকাছি পৌঁছেছে। ফলে যাদের টাকা-পয়সা কম তারা বাসে এবং যাদের টাকা বেশি তারা বিমানে যেতে আগ্রহী হবেন। মাঝ দিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে যাত্রী হারাবে।

অপর যাত্রী মাহমুদুল হাসান বলেন, কলকাতায় ট্রেনে যেতে-আসতে এখন ১০ হাজার টাকার বেশি লাগবে। বাসে যেতে-আসতে লাগে পাঁচ হাজার টাকা। বর্তমান ভাড়া তো বাসের ডাবল হয়ে গেল। অন্যদিকে, বিমানে আপ-ডাউন লাগে ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা। সিঙ্গেল ট্রিপে সাড়ে সাত থেকে নয় হাজার টাকা লাগে।

বাস-মালিকদের সুবিধা করে দিচ্ছে রেলওয়ে

ট্রেনের ভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডলারের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে ট্রেনের ভাড়া সমন্বয় করা চলে না। তেলের দাম বাড়লেও ট্রেনের ভাড়া কিন্তু বাড়ে না। ভারত এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। দেশটিতে ডলার বা তেলের দাম বাড়লেও ট্রেনের ভাড়া কখনও বাড়ানো হয় না। অথচ আমাদের দেশে ডলারের কথা বলে কয়েকবার ভাড়া বাড়ানো হলো। এশিয়ার মধ্যে আমাদের দেশে ট্রেনের ভাড়া সর্বোচ্চ।

‘আন্তর্জাতিক রুটে আবারও ট্রেনের ভাড়া বাড়ানোর মধ্য দিয়ে বাস-মালিকদের সুবিধা করে দিচ্ছে রেলওয়ে। অন্যদিকে, সাধারণ মানুষের মধ্যে ট্রেন ব্যবহারে অনীহা তৈরি করছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) শাহ আলম কিরণ শিশির ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ডলারের দাম বাড়ার কারণে বাংলাদেশ ও ভারত একসঙ্গে বসে এ ভাড়া সমন্বয় করেছে। এর আগেও ভাড়া সমন্বয় করা হয়েছে, কখনও বাড়ানো হয়নি।’

বাংলাদেশ রেলওয়ের উপপরিচালক (ইন্টারচেঞ্জ) মো. মিহরাবুর রশিদ খাঁন বলেন, ‘আমরা আগেই অর্ডার ইস্যু করে দিয়েছি। ভাড়া বাড়াইনি, মূলত সমন্বয় করা হয়েছে। আন্তঃদেশীয় ট্রেনের ভাড়া নিজ নিজ দেশের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে।’

এমএইচএন/এমজে