পাঁচ বছরে পাঁচজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) দায়িত্ব নিয়েছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের। এর মধ্যে একজনের মেয়াদ ছিল মাত্র পাঁচ মাস। বিমানের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে আসীন হয়ে কোনো কিছু বোঝার আগেই বেজে যায় বিদায়ঘণ্টা! স্বল্প সময়ের এমন অতিথি দিয়ে আদৌ কি একটি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন সম্ভব? 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী একমাত্র প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বয়স ৫২ বছর হলেও এখানে ‘দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব’ পরিলক্ষিত হচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ৩০ হাজার কোটি টাকা মূল্যমানের প্রতিষ্ঠানটি। এর পেছনের অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে বিমানের ‘ব’ বোঝার আগেই এর শীর্ষ পদ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়া। 

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এমডি ও সিইও হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন মো. জাহিদুল ইসলাম ভুঞা। গত ৩০ মে তিনি নিয়োগ পেয়েছেন। 

বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় দেড় বছরের মতো সময় বিমানের সিইও হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন মো. মোকাব্বির হোসেন। তাকে সরিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয় ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামালকে। তিনি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত অর্থাৎ ১৭ মাস দায়িত্বপালন করেন। এরপর আসেন যাহিদ হোসেন। তিনি সময় পান মাত্র পাঁচ মাস। ২০২২ সালের জুলাই মাসে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। একই বছরের ৭ ডিসেম্বর তার মেয়াদ শেষ হয়। 

শফিউল আজিম ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর বিমানের এমডির দায়িত্ব নেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রুট চালু, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের দায়িত্ব পাওয়া, বিমানের জন্য অত্যাধুনিক উড়োজাহাজ কেনাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেন তিনি। গত ২৯ মে তাকেও দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের সিইও পদটি একটি অপারেশনাল পদ। একজন সিইওর প্রধান দায়িত্ব হলো প্রতিষ্ঠানকে নেতৃত্ব দেওয়া, যথাযথ পরিকল্পনা নেওয়া এবং তা বাস্তবায়ন করা। সময়োপযোগী দিকনির্দেশনা দেওয়া এবং পুরো কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থাপনা করা। তবে, গত পাঁচ বছরে বিমানের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে যে পাঁচজন সিইও হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন তাদের চারজনই মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আমলা ছিলেন। প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক পরিচালনার অভিজ্ঞতা এবং বিমান শিল্পের সামান্য অভিজ্ঞতা ছাড়াই তাদের এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। 

একমাত্র এভিয়েশন-সংশ্লিষ্ট ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল মো. মোকাব্বির হোসেনের। তিনি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের (বিমান ও সিএ) পদ থেকে বিমানের শীর্ষ পদে যোগ দেন। অন্যরাও ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে এসে বিমানের সার্বিক কর্মকাণ্ড প্রথমে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করেন। যখনই তারা নিজস্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে গেছেন, তখনই তাদের বদলি বা পদোন্নতি দিয়ে অন্যত্র চলে যেতে হয়েছে। 

বিমান থেকে সর্বশেষ পদোন্নতি পেয়ে অন্যত্র বদলি হয়েছেন শফিউল আজিম। বিমানের আন্তর্জাতিক রুট সম্প্রসারণের চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন তিনি। দায়িত্ব নেওয়ার পর তার আমলেই চালু হয় জাপানের নারিতা ও ইতালির রোম ফ্লাইট। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, বিমানকে লাভজনক করতে হলে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের কাজ নিজেদেরই করতে হবে। পুরো টার্মিনালের কাজটি যখন জাপানি প্রতিষ্ঠানের কাছে চলে যাচ্ছিল, তখন তিনি এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। তার তৎপরতায় অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি কেনা হয়, হাজারখানেক লোক নিয়োগ দেওয়া হয়। বিমানের এমন পরিবর্তন দেখে বাংলাদেশের কাছে বোয়িং ও এয়ারবাসের মধ্যে উড়োজাহাজ বিক্রির তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত হুট করে তাকে অন্য দপ্তরে বদলি করে দেওয়া হয়। 

শেষ কর্মদিবসে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন শফিউল আজিম। তার কাছে ‘নিজ কাজে কোনো অতৃপ্তি আছে কি না’— সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। উত্তরে তিনি বলেন, ‘বিমানবহরে আরও চারটি উড়োজাহাজ যুক্ত করতে পারলে খুব খুশি হতাম।’ 

যাহিদ হোসেন বিমানের এমডি ও সিইও হিসেবে দায়িত্বপালন করেন মাত্র পাঁচ মাস। এর আগে বিমানের প্রকিউরমেন্ট ও লজিস্টিক সাপোর্ট বিভাগে কাজ করেন তিনি। তার দায়িত্বপালনের সময় বিমানের বিভিন্ন পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়। তবে তার বদলির সঙ্গে এর কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে কি না— এ বিষয়ে কোনো তথ্য জানা যায়নি। 

যাহিদ হোসেনের আগে দায়িত্বপালন করেন ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামাল। তিনি এসেই বিমানকে ‘ক্যান্সারমুক্ত’ ও ‘শিডিউল অন-টাইম’ করার ঘোষণা দেন। তার আমলে উদ্বোধন করা হয় বিমানের ঢাকা-টরন্টো ফ্লাইট। ১৭ মাস দায়িত্বপালনের পর তাকে বদলি করা হয়। 

কোভিড-১৯ এর সময় লকডাউনের কারণে প্রায় দুই বছর সারাবিশ্বে আকাশপথের চলাচল অনিয়মিত হয়ে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকায় ছিল বিমানও। এ সময় বিমানের দায়িত্ব পড়ে মোকাব্বির হোসেনের ঘাড়ে। তার সময়ে ম্যানচেস্টারসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট চলাচল শুরু হয়। তিনি বিমানের নিউ ইয়র্ক ফ্লাইট, চীনের বিভিন্ন রুট ও টরন্টো ফ্লাইটসহ বেশ কয়েকটি রুট বাড়ানোর পরিকল্পনা করেন। তবে দেড় বছরের মাথায় তাকেও বদলি করে পাঠানো হয় রেলপথ মন্ত্রণালয়ে। 

দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে এভাবেই বিমানে একের পর এক ‘অনভিজ্ঞ’ সিইও ও এমডি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা বিমানের ব্যবসা বোঝা এবং নিজস্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই প্রতিষ্ঠানটি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। যে কারণে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটি তার যথাযথ উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে— মনে করছেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা। 

ব্যতিক্রম দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইন্সগুলো 

দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী ও বৃহৎ এয়ারলাইন্সগুলোর প্রত্যেকটির সিইও এ খাতে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। তারা দীর্ঘদিন ধরে এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। নেপালের নেপাল এয়ারলাইন্সের বর্তমান সিইও উবারাজ আধিকারি। তিনি ৩৪ বছর ধরে এ এয়ারলাইন্সে আছেন। এয়ারলাইন্সটির ইন্টারনাল অডিট, ফিন্যান্স, ফ্লাইট রিভিউ কমিটিতে থাকার পর তাকে সিইও পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। থাই এয়ারওয়েজের সিইও চাই এমসিরির এভিয়েশন খাতে অভিজ্ঞতা ৩৭ বছরের। থাই এয়ারওয়েজে দীর্ঘদিন চিফ ফিন্যানশিয়াল অফিসার হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন তিনি। 

সদ্য টাটা কোম্পানির হাতে মালিকানা গেছে ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এয়ার ইন্ডিয়ার। প্রতিষ্ঠানটির সিইও হিসেবে ২০২২ সালের জুন মাসে নিয়োগ দেওয়া হয় ৯২ বছর বয়সী ক্যাম্পবেল উইলসনকে। তিনি সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স, স্কুটসহ (এয়ারলাইন্স) বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন্সে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বপালন করেছেন। বাংলাদেশের বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোও একই মডেলে চলছে। ব্যতিক্রম শুধু বিমান

শ্রীলঙ্কান এয়ারের সিইও রিচার্ড নুট্টাল তিন বছর ধরে এয়ারলাইন্সটির সিইও হিসেবে আছেন। এর আগে তিনি কেনিয়া এয়ারলাইন্স, রয়েল জর্দানিয়ান ও সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্সে চাকরি করেছেন। 

সদ্য টাটা কোম্পানির হাতে মালিকানা গেছে ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এয়ার ইন্ডিয়ার। প্রতিষ্ঠানটির সিইও হিসেবে ২০২২ সালের জুন মাসে নিয়োগ দেওয়া হয় ৯২ বছর বয়সী ক্যাম্পবেল উইলসনকে। তিনি সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স, স্কুটসহ (এয়ারলাইন্স) বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন্সে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বপালন করেছেন। বাংলাদেশের বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোও একই মডেলে চলছে। ব্যতিক্রম শুধু বিমান। 

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন 

একটি এয়ারলাইন্সে অভিজ্ঞ ও লম্বা সময়ের জন্য এমডি ও সিইও নিয়োগ কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ— জানতে চাইলে বিমানের সাবেক পরিচালনাপর্ষদের সদস্য ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে স্বল্প সময়ের মধ্যে সিইও বদলি হওয়াটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সারাবিশ্বে এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি উন্নতি করছে। আমাদেরও সে পথে হাঁটতে হবে। আমাদের এ মুহূর্তে প্রতিযোগী এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতার পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। 

‘আমরা যদি কাতার এয়ারওয়েজ, এমিরেটসের মতো মেগা ক্যারিয়ারগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যেতে চাই, আমাদের শুধু বেশি বেশি এয়ারক্রাফট (উড়োজাহাজ) কিনলেই চলবে না। বেশি বেশি হিউম্যান রিসোর্স লাগবে। একটি প্রতিষ্ঠানের হিউম্যান রিসোর্সের যে টিম লিডার থাকবেন (এমডি বা সিইও), তার স্বপদে দীর্ঘ সময় থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। কেউ যদি এক বছরের জন্য এসে আবার চলে যান, ওই এক বছরে তিনি যে দক্ষতা অর্জন করলেন, সেটি তো আর কাজে আসল না। আরেকজন আসলেন, তিনিও ছয় মাস বা এক বছর পর চলে গেলেন। এভাবে মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো যদি শীর্ষ পদে বদলি হতে থাকে তাহলে তো প্রতিষ্ঠানের জন্য ভালো কিছু হলো না।’ 

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এ টি এম নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিমান যেহেতু একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, এটি লাভ-ক্ষতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ এখানে। অথচ সিইও হিসেবে একজন সেনাবাহিনী বা অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কর্তা বসানো হয়। এভিয়েশন খাতে চাকরি করতে গেলে একজন সিইওকে অনেকগুলো কমপ্লায়েন্স ইস্যু জানতে হয়। আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন সংস্থার (আইকাও) কিছু কমপ্লায়েন্স আছে, বেবিচকের কিছু আছে; যে দেশের সঙ্গে ফ্লাইট পরিচালনা করতে যাবেন সে দেশের সিভিল এভিয়েশনের কিছু কমপ্লায়েন্স মানতে হয়। আন্তর্জাতিক অনেক রুল জানতে হয়। ১৯টি অ্যানেক্স আছে। 

‘এসব একজন লোক এক দিনে শিখতে পারেন না। একজন সিইওর যদি এসব আগে থেকে জানা না থাকে তার জন্য প্রতিষ্ঠান চালানো অনেক কঠিন। এসব জানার জন্য তার একজনের সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। যেহেতু আরেকজনের ওপর নির্ভর করতে হবে, সেক্ষেত্রে মিসগাইডেড (বিপথগামী) হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এভাবে তিনি নিজ প্রতিষ্ঠানকে লিড দিতে পারবেন না।’ 

এআর/জেডএস