টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় রয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে ক্ষমতার আসনে বসে দলটি। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে নজির স্থাপন করলেও ভোটের মাঠে দিন দিন নিরাশ করছে দলটি।

২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ৮৭.১৩ শতাংশ ভোটের হার নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ২০২৪ সালের নির্বাচনে সেই হার এসে দাঁড়িয়েছে ৪১ দশমিক ৮ শতাংশে। শুধু সংসদ নির্বাচনেই নয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও দিন দিন ভোটের হার কমছে। শক্তিশালী বিরোধী দল নির্বাচনী মাঠে না থাকায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের সিনিয়র নেতারা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বা অনাস্থার বিষয়টি ফুটে ওঠে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষের জন্য যে লড়াই করেছিলেন, সেটার প্রতিফলন ৭০-এর নির্বাচনে পড়ে। মানুষ বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিকে গ্রহণ করেছিল এবং তার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করেছিল। রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা থাকলে দেশের নানা সমস্যা নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। আর অনাস্থা তৈরি হলে ক্ষমতায় যারাই থাকুক তাদের সমস্যা বেড়ে যায়। যার প্রভাব নির্বাচনে পড়ে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০০৮ সালের পর সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেশে হয়নি। ২০১৪ সালে মধ্যরাতে ভোট হয়েছে। ২০১৮ সালে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের জেলে রেখে ভোট হয়েছে। এটা কোনো অবস্থায় জাতীয় নির্বাচনের ধরন হতে পারে না। নির্বাচন হলো যেখানে বিকল্প প্রার্থী থাকবে, প্রার্থীর ওপর কোনো চাপ থাকবে না, যেখানে মানুষ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে।

তিনি আরও বলেন, মানুষ এখন মনে করে ভোট দিলেও কিছু আসে যায় না। ভোট সঠিকভাবে দিতে পারবে কি না, সেটা নিয়ে সন্দেহ থাকে। দিতে পারলেও সঠিকভাবে গণনা হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। আবার সরকার দলীয় লোকজন মনে করে তাদের প্রার্থীই জিতবে। এসব কারণে নির্বাচনের ওপর থেকে মানুষের আস্থা কমেছে। নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরও আস্থা কমেছে মানুষের। এই আস্থাহীনতার প্রতিফলনই হলো মানুষের নির্বাচনের প্রতি অনীহা।

নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৭৪.৯৭%। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৮৭.১৩ শতাংশ ভোট পড়ে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অধিকাংশ দলই এ নির্বাচন বর্জন করে। ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিজয়ী হন। মোট ২৩৪টি আসন পায় আওয়ামী লীগ। ভোটদানের হার ছিল মাত্র ৩৯.৫৮%। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৭টি আসন লাভ করে বিজয় অর্জন করে। ভোটদানের হার ৪০.২%। ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়েছে।

এদিকে দেশে এখন চলছে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। প্রথম ধাপে গত ৮ মে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ভোটের হার ছিল ৩৬.১ শতাংশ। এর মধ্যে ইভিএমে ভোটের হার ৩১ দশমিক ৩১ শতাংশ, আর ব্যালটে ৩৭ দশমিক ২২ শতাংশ। আর গত ২১ মে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৩৭.৫৭ শতাংশ। ৫০ শতাংশ কিংবা এর বেশি ভোট পড়েছে মাত্র ১৯টি উপজেলায়। ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে ইসির নানা উদ্যোগের পরও এই ধাপে ভোটের হার তেমন বাড়ানো যায়নি। প্রথম ধাপের চেয়ে দ্বিতীয় ধাপে ১ শতাংশের মতো ভোটার উপস্থিতি বেড়েছে। আর গত ২৯ মে তৃতীয় ধাপে দেশের ৮৭ উপজেলায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৩৮ শতাংশ ভোট পড়েছে।

২০১৯ সালের পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৪১ শতাংশের বেশি। তার আগে ২০১৪ সালে চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনে ৬১ শতাংশ এবং ২০০৯ সালে তৃতীয় উপজেলা নির্বাচনে ৬৭.৬৯ শতাংশ ভোট পড়েছিল। 

৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চার মাসের মাথায় সারা দেশে স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন হচ্ছে। সেখানে প্রথম দুই ধাপে সংসদ নির্বাচনের চেয়েও ভোটের হার কমেছে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেছেন, নির্বাচন হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়, অনেকজন থেকে একজনকে বেছে নেওয়ার পরীক্ষা। আমাদের দেশে মানুষের রাজনীতির প্রতি আগ্রহ রয়েছে। পান দোকানিও রাজনৈতিকভাবে সচেতন। রাজনীতিতে বিনোদনের একটা ব্যাপার আছে, তাই মানুষ সারাক্ষণ রাজনৈতিক আলোচনা পছন্দ করে। সাধারণ ভোটাররা যখন দেখে যে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, প্রতিযোগিতা নেই। তখন তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কারণ নির্বাচনে কে জয়ী হবে তখন সেটা নিশ্চিত হয়ে যায়। রাজনীতিতে যখন প্রতিযোগিতা কমে যায়, তখন ভোটের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহও কমে যায়।

তিনি আরও বলেন, বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় আওয়ামী লীগের লোকজনের মধ্যেই নির্বাচন হয়। অনেক সময় এক দলের কয়েকজন প্রার্থী থাকলে নেতাকর্মীরা নির্বাচনে সক্রিয় হতে চান না। কাউকে খুশি করতে গিয়ে কারো অখুশির কারণ হতে চান না তারা। এসব কারণে ভোটের হার কমছে।

২০১৪ সালের নির্বাচনে বিরোধী দল আসেনি। তখন সারাদেশে ভোট কেন্দ্রগুলো আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে, মানুষকে পুড়িয়ে মেরে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছে জামায়াত-বিএনপি। আওয়ামী লীগের যে সমর্থক সেও ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যায়নি। যার ফলে ভোটের হার কমেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোটের হার বেড়েছে। সেই নির্বাচনে বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক না হলে ভোটারদের আগ্রহ কমে যায়। আর ২০২৪ সালের নির্বাচনে যারা আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন তারা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা বলছেন, স্বাধীনতা বিরোধীদের অসুস্থ রাজনীতির কারণেই দেশের তরুণ প্রজন্ম রাজনীতির প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে ভোটের মাঠে বিরোধী দলগুলোকে সক্রিয় করতে। কিন্তু বিরোধীরা তো নির্বাচন বর্জনে বিশ্বাসী। তারা নির্বাচন বা রাজনীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। এতে মানুষ নির্বাচন ও রাজনীতি বিমুখ হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিরোধী দল আসেনি। তখন সারাদেশে ভোট কেন্দ্রগুলো আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে, মানুষকে পুড়িয়ে মেরে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছে জামায়াত-বিএনপি। আওয়ামী লীগের যে সমর্থক সেও ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যায়নি। যার ফলে ভোটের হার কমেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোটের হার বেড়েছে। সেই নির্বাচনে বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক না হলে ভোটারদের আগ্রহ কমে যায়। আর ২০২৪ সালের নির্বাচনে যারা আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন তারা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়েছেন। শক্তিশালী প্রার্থী থাকলে সমর্থকরাও সিরিয়াস হয়ে যায়। প্রতিপক্ষ মাঠে থাকলে সেখানে ভোটের রেশিও বাড়ে। যখন দেখছে বিএনপি মাঠে নেই, তখন আওয়ামী লীগের অনেক সমর্থকও ভোট কেন্দ্রে যায়নি।  

এটা কি ভোটের প্রতি সাধারণ মানুষের অনীহা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা অনীহা নয়। আওয়ামী লীগের উপর সাধারণ মানুষের আস্থা আছে। প্রতিপক্ষ না থাকায় সাধারণ মানুষ মনে করে আওয়ামী লীগ তো জিতে যাচ্ছে। অনেকে এই কারণে ভোট দিতে যায় না। যারা ডেডিকেটেড কর্মী তারা ঠিকই ভোটকেন্দ্রে যায়।  

এমএসআই/এসকেডি