প্রতি বছর ভারী বর্ষণ ও জোয়ারের পানিতে ডুবে যায় চট্টগ্রাম নগরী, ভোগান্তিতে পড়েন মানুষ

জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে চট্টগ্রামবাসীর মুক্তি মিলবে কি না— তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কারণ, মেয়াদ শেষ হলেও জলাবদ্ধতা নিরসনে নেওয়া মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাকি কাজ শেষ করতে মেয়াদ বাড়াতে হবে আরও দুই বছর। এ বছর টাইডাল রেগুলেটর (জোয়ার প্রতিরোধক) নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। ফলে এবারের বর্ষায়ও জোয়ারের পানিতে ডুববে চট্টগ্রাম নগরী।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বাস্তবায়নাধীন মেগা প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা। প্রকল্পটির কাজ চলছে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে।

২০১৭ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়ে ২০২০ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল প্রকল্পটির। এরপরও কাজ শেষ না হওয়ায় এক বছর সময় বাড়িয়ে ২০২১ সাল পর্যন্ত করা হয় প্রকল্পের মেয়াদ। বর্ধিত সময়েও কাজ শেষ না হওয়ায় আরও দুই বছর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করা হবে বলে সিডিএ সূত্রে জানা গেছে।

মেগা প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে- কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ১৬টি খাল এবং এসব খালে সংযুক্ত আরও ২০টি খালসহ মোট ৩৬টি খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন। ১৭৬ কিলোমিটার আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ, ৪৮টি পিসি গার্ডার ব্রিজ প্রতিস্থাপন, ছয়টি আরসিসি কালভার্ট প্রতিস্থাপন, পাঁচটি টাইডাল রেগুলেটর বা স্লুইস গেইট, ১২টি পাম্প হাউজ স্থাপন, ৪২টি সিল্টট্রেপ স্থাপন এবং ২০০টি ক্রস ড্রেন কালভার্ট নির্মাণ

শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে নেওয়া এ মেগা প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে- কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ১৬টি খাল এবং এসব খালে সংযুক্ত আরও ২০টি খালসহ মোট ৩৬টি খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন। ১৭৬ কিলোমিটার আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ, ৪৮টি পিসি গার্ডার ব্রিজ প্রতিস্থাপন, ছয়টি আরসিসি কালভার্ট প্রতিস্থাপন, পাঁচটি টাইডাল রেগুলেটর বা স্লুইস গেট, ১২টি পাম্প হাউজ স্থাপন, ৪২টি সিল্টট্রেপ স্থাপন এবং ২০০টি ক্রস ড্রেন কালভার্ট নির্মাণ।

চলতি বছর টাইডাল রেগুলেটর (জোয়ার প্রতিরোধক) নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না

এক দফা মেয়াদ বাড়িয়েও প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ। যে পাঁচটি টাইডাল রেগুলেটরের নির্মাণকাজ চলছে সেগুলো শেষ হবে এ বছরের শেষের দিকে। সবমিলিয়ে ভারী বৃষ্টির সঙ্গে জোয়ারের পানি যোগ হলে এ বছরও চট্টগ্রাম নগরবাসীকে জলাবদ্ধতায় কষ্ট করতে হবে বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।

নগর পরিকল্পনাবিদ আশিক ইমরান ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছর (২০২০ সাল) চট্টগ্রামে বৃষ্টি কম হয়েছিল। তাই জলাবদ্ধতাও কম ছিল। যদি এ বছর ২০১৮-১৯ সালের মতো বৃষ্টি হয়, তাহলে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হবে। কারণ, অনেকগুলো খালে বাঁধ দেওয়া আছে। সেগুলোতে রিটার্নিং দেয়ালের কাজ চলছে। এছাড়া বিকল্প খাল খননের কথা থাকলেও তা এখনো করতে পারেনি সিডিএ। যদি বৃষ্টি হয় তাহলে অনেক বেশি জনদুর্ভোগের সৃষ্টি হবে এ বছর। আশা করছি, সিডিএ এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেবে।

জলাবদ্ধতা নিরসনে নেওয়া হয় মেগা প্রকল্প। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়েছে মাত্র ৫০ ভাগ কাজ

তিনি আরও বলেন, খালগুলো পরিষ্কারের অল্পদিনের মধ্যেই পলিথিন ও বর্জ্য এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নাব্যতা ধরে রাখার জন্য যে কাজগুলো করা দরকার, সেগুলোর সবই যে সিডিএ’র কাজ, এমন নয়। এছাড়া নগরের পাহাড় কাটা হচ্ছে। ফলে বৃষ্টি হলে পাহাড়ের মাটি এসে নালা-নর্দমা ও খাল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম নগরকে জলাবদ্ধতামুক্ত রাখতে সিটি করপোরেশন ও সেবাসংস্থাগুলোর কাজের সমন্বয় করতে হবে।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় এক বছর সময় বাড়ানো হয়েছে। এ বছরও জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ শেষ হবে না। শেষ হতে আরও দুই বছর লাগবে। এখনো প্রকল্পের অধীন কিছু ভূমি অধিগ্রহণের কাজ বাকি। তাই কাজ শেষ করতে সময় লাগবে।

তিনি আরও বলেন, মেগা প্রকল্পের অধীন পাঁচটি স্লুইস গেট বা টাইডাল রেগুলেটর নির্মাণ চলছে। এগুলোর জন্য কিছু যন্ত্রপাতি দেশের বাইরে থেকে আনতে হচ্ছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে এগুলো আনতে সময় লাগছে। তাই নির্মাণকাজ শেষ করতে পারিনি। এ কারণে এবারের বর্ষায় চট্টগ্রাম নগরে জোয়ারের পানি প্রবেশ করবে।

‘জোয়ারের পানি প্রবেশ করলেও এবার নগরে বৃষ্টির পানি তেমন জমবে না। আশা করছি, চলতি বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে স্লুইস গেটের নির্মাণকাজ শেষ হবে। আগামী বর্ষায় নগরবাসী এর সুফল পাবে। তবে, এ বর্ষায় নগরবাসীকে কিছুটা কষ্ট ভোগ করতে হবে।’

বর্ধিত সময়েও কাজ শেষ না হওয়ায় আরও দুই বছর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করবে সিডিএ

প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে অর্থসংকটে পড়তে হচ্ছে জানিয়ে প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, মোট ছয় হাজার কোটি টাকার মধ্যে আমরা এখন পর্যন্ত পেয়েছি এক হাজার ৮০০ কোটি টাকার মতো। টাকা পেতে সময়ক্ষেপণ হলে কাজের গতি কমে যেতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ ঢাকা পোস্টকে বলেন, চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে যে মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে তার ৫০ শতাংশ শেষ হয়েছে। বর্ষায় যে জলাবদ্ধতা হয় তা এ বছর কমে আসবে বলে আশা করছি।

তবে, প্রকল্পের অধীনে যে স্লুইস গেট নির্মাণ হচ্ছে, সেগুলোর কাজ শেষ না হওয়ায় জোয়ারের পানি এ বছরও নগরীতে প্রবেশ করবে। স্লুইস গেট নির্মাণের কিছু সামগ্রী নেদারল্যান্ড থেকে আসার কথা ছিল। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির জন্য আসতে সময় লাগছে। তাই সেগুলোর কাজ শেষ হতে কিছুটা সময় লাগবে বলেও জানান চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান।

প্রতি বছর জলাবদ্ধতার ভোগান্তির বিষয়ে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল এলাকার বাসিন্দা মনির হোসেন বলেন, বর্ষা এলেই আমাদের কষ্ট বেড়ে যায়। বৃষ্টির সঙ্গে জোয়ার এলে হাঁটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে যায় রাস্তাঘাট। বাড়িঘরেও পানি ওঠে। সিডিএ’র মেগা প্রকল্পের কাজ শুরুর পর আশা করেছিলাম জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাব। কিন্তু কাজ শেষ না হওয়ায় এ বছরও বর্ষায় আমাদের কষ্ট করতে হবে। 

বর্ষায় বৃষ্টির সঙ্গে জোয়ারের পানিতে চট্টগ্রামের অনেক নিচু এলাকা তলিয়ে যায়। বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও দোকানপাটে পানি ওঠে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের প্রতি বছর আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্ষার জলাবদ্ধতায় আমাদের কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে জলাবদ্ধতা নিরসনে তিন বছর আগে প্রকল্পের কাজ হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু এখনও তা শেষ হয়নি। চাক্তাই এলাকায় যে স্লুইস গেট নির্মাণ হচ্ছে তার কাজও শেষ হয়নি। 

‘খাতুনগঞ্জ এলাকার নালা-নর্দমা ও খাল নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। এ বছরও আমরা আতঙ্কে আছি। যদি ভারী বৃষ্টি হয়, তাহলে এ বছরও জলাবদ্ধতা হবে। এ কারণে কাজটি দ্রুত শেষ করার দাবি জানাচ্ছি। জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে আমরা মুক্তি চাই।’ 

কেএম/আরএইচ/এমএআর/