দেশের ১১২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৩টিতে শীর্ষ তিন পদ ভিসি, প্রো-ভিসি ও ট্রেজারারের অন্তত একটি পদ ফাঁকা রয়েছে। কোথাও কোথাও ২টি করে পদ ফাঁকা আছে। এর মধ্যে ৩৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পদই শূন্য! অর্থাৎ এই ৩৩টি বিশ্ববিদ্যালয় এই মুহূর্তে অভিভাবকহীন অবস্থায় আছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সনদে সাক্ষর করার কেউ নেই। এছাড়া ট্রেজারার পদ ফাঁকা ২৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বলছে, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য ভিসি, প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার এ তিনটি পদে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। এই পদে কেউ না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। এজন্য এ তিনিটি শূন্যপদ পূরণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় বার বার তাগিদ দেওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ এ পদগুলোতে নিয়োগের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।

জানা গেছে, বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) সদস্যরা নিজেদের মতো করে পরিচালনা করতে পছন্দের ব্যক্তিদের এ পদে নিয়োগ দিতে তৎপরতা চালান। এটি করতে গিয়ে অযোগ্য ব্যক্তিদের নাম সুপারিশের ফলে আটকে যায় এসব পদের নিয়োগ প্রক্রিয়া। এছাড়া বছরের পর বছর মালিক-কাম ভিসির দায়িত্ব পালনের ঘটনাও রয়েছে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এদিকে তিন পদের কোনো একটি শূণ্য এমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকা সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।

সংস্থাটির সর্বশেষ তথ্য বলছে, শীর্ষ এ তিন পদের একজন নেই এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৭৩টি। এর মধ্যে ভিসি নেই ৩৩টিতে, ২৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শূন্য রয়েছে ট্রেজারার পদ। ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি এবং ট্রেজারার দুটি পদই শূন্য। বছরের পর বছর এসব পদে কাউকে নিয়োগ না দিয়ে ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চালাচ্ছে মালিকরা। এতে ক্ষিপ্ত হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। 

শীর্ষ পদে এত বিশ্ববিদ্যালয়ে পদ ফাঁকা কেন জানতে চাইলে ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ ঢাকা পোস্টকে বলেন, যখন এসব পদ ফাঁকা হয় তখন তাদের তাগাদা দেওয়া হয়। কিন্তু তিনজনের প্যানেল পাঠাতে দেরি করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ। আর পাঠালেও যোগ্য ব্যক্তির নাম না থাকায় সেই তালিকা সংশোধন করতে বলা হয়। এরপর থমকে যায় এই নিয়োগ প্রক্রিয়া। এসব কারণে প্যানেল যাচাই-বাছাইয়ের পুরো প্রক্রিয়ায় কিছুটা সময়ক্ষেপণ হয়। এছাড়া ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে মামলাসহ নানা জটিলতা রয়েছে। ফলে তারা চাইলেও নাম প্রস্তাব করে পাঠাতে পারে না। এসব কারণে এই পদগুলো ফাঁকা।

তিনি জানান, যাদের আইনগত সমস্যা নেই তাদের দেরি হওয়ার অন্যতম কারণ যোগ্য ব্যক্তিদের প্যানেল না পাঠানো। তারা নিজেদের মতো করে একটি প্যানেল পাঠায়। পরে সেটি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরত যায়।

যেভাবে নিয়োগ হয় শীর্ষ পদগুলোতে

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী, ভিসি, প্রো-ভিসি এবং ট্রেজারার এ তিনটি পদে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয় চ্যান্সেলর। তবে প্রাথমিক কাজটি করে থাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ইউজিসির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছ থেকে নামের প্রস্তাব (৩ জনের প্যানেল) আসার পর তারাই সরকারের কাছে এসব পদে নিয়োগের জন্য প্রস্তাব পাঠায়। সেটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে যায়। যাদের নাম প্রস্তাব করা হবে তাদের বয়স যেন ৭০ বছরের ঊর্ধ্বে না হয় সে দিকে নজর রাখতে বলা হয়। এছাড়া তিনজনের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত পাঠাতে বলা হয় প্রস্তাবে। সেই তিনজন থেকে একজনকে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি।   

ভিসি নেই ৩৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে

ভিসি যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক সবকিছুর প্রধান। তিনি শিক্ষার্থীদের সনদে মূল সাক্ষরদাতা। কিন্তু সেই ভিসি ছাড়াই চলছে দেশের ৩৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।

এই তালিকায় আছে, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, আহছানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি, মানারাত ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি, রয়েল ইউনিভার্সিটি, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি, চিটাগং ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি সৈয়দপুর, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি কাদিরাবাদ, এন. পি. আই ইউনিভার্সিটি, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি খুলনা, রূপায়ন এ. কে. এম শামসুজ্জোহা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহ মখদুম ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটি, মাইক্রোল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শেখ হাসিনা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, লালন বিজ্ঞান ও কলা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি, আশা ইউনিভার্সিটি, বরেন্দ্র ইউনিভার্সিটি, খাজা এনায়েত আলী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী সাইন্স এন্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি, জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজি খুলনা, বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব স্কিল এনরিচমেন্ট এন্ড টেকনোলজি এবং ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। ছবি- সংগৃহীত

 

ভিসি-ট্রেজারার একজনও নেই ১১ বিশ্ববিদ্যালয়ে

রাষ্ট্রপতি নিয়োগকৃত শীর্ষ তিনটি পদের ভিসি-ট্রেজারার পদের একটিও নেই ১১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। 

এই তালিকায় রয়েছে, আহছানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব অব বাংলাদেশ, রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি, চিটাগং ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি সৈয়দপুর, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি কাদিরাবাদ, এন. পি. আই ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি এবং বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি খুলনা।

ট্রেজারার নেই ২৯ বিশ্ববিদ্যালয়ে

সেন্ট্রাল উইমেন'স ইউনিভার্সিটি, আহছানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, দি পিপল'স ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি, নর্দান ইউনিভার্সিটি, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি, দি মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি, রয়েল ইউনিভার্সিটি, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি, নর্থ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, চিটাগং ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি সৈয়দপুর, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি কাদিরাবাদ, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি কুমিল্লা, এন পি আই ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়, রূপায়ন এ কে এম শামসুজ্জোহা বিশ্ববিদ্যালয়, আহছানিয়া মিশন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা খান বাহাদুর আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহ মখদুম ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটি রাজশাহী, ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ইউনিভার্সিটি, মাইক্রোল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শেখ হাসিনা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি খুলনা, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বাংলাদেশ এবং লালন বিজ্ঞান ও কলা বিশ্ববিদ্যালয়।

মানারাত ইউনিভার্সিটি। ছবি- সংগৃহীত

 

শিক্ষা কার্যক্রমের অনুমতি মেলেনি ৫ বিশ্ববিদ্যালয়ে

সরকার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য অনুমিত পেলেও শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি মেলেনি ৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এগুলো হলো-রূপায়ন এ. কে. এম শামসুজ্জোহা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহ মখদুম ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটি, মাইক্রোল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শেখ হাসিনা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি এবং লালন বিজ্ঞান ও কলা বিশ্ববিদ্যালয়। 

তাদের বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সাময়িক অনুমতি দেওয়া হলেও শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দেয়নি ইউজিসি। ফলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়েও ভিসি-প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

এনএম/এমএসএ