ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ও নারায়ণগঞ্জ শহর এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) বর্তমান গ্রাহক সংখ্যা ১০ লাখ ২১ হাজার। যার মধ্যে ৬ লাখ ৫৬ হাজার গ্রাহকের টিআইএন নেই। তারা আয়কর রিটার্ন জমা দেন না।

এসব এলাকায় বিদ্যুতের গ্রাহক মানেই তারা সবাই বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মালিক। অর্থাৎ বাড়ির মালিক হওয়া সত্ত্বেও আয়কর রিটার্ন বা আয়কর দেন না তারা। ১০ লাখ গ্রাহকের মধ্যে মাত্র ৩ লাখ ৬৫ হাজার ব্যক্তির টিআইএন রয়েছে। তারাও নিয়মিত আয়কর রিটার্ন জমা দেন না বলে জানা গেছে।

অন্যদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) বর্তমান গ্রাহক সংখ্যা ১২ লাখ ৪০ হাজার। তাদের আয়করের বিষয়ে যথাযথ তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন এ প্রতিষ্ঠানের অন্তত ৬০-৭০ ভাগ গ্রাহক করজালের বাইরে রয়েছেন। অথচ তারা করযোগ্য আয় করেন বলে ধারণা কর কর্মকর্তাদের।

মাঠ পর্যায়ে সেবা প্রদানকারী মাত্র দুটি সংস্থার চিত্র এটি। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে গ্রাহক সেবা দিচ্ছে এমন ডজনখানেক সংস্থা। তাদের গ্রাহকদের বিষয়ে খোঁজ করলে দেখা যাবে হাজার হাজার কোটি টাকার কর ফাঁকি হচ্ছে প্রতিবছর।

আয়কর, ভ্যাট, আমদানি-রপ্তানি ও আবগারি শুল্ক আহরণের কার্যক্রম প্রযুক্তিনির্ভর পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও নিয়ন্ত্রণ করতে এমন মহাপরিকল্পনার পথে হাঁটছে এনবিআর

এ অবস্থায় কর ফাঁকি রোধ ও করযোগ্য ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে করের আওতায় আনার নতুন চ্যালেঞ্জে নেমেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে সরকারি-বেসরকারি অন্তত ১৬টি প্রতিষ্ঠানের সিস্টেমে আন্তঃসংযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে ২৫ শতাংশ, ২০৩১ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে শতভাগ আন্তঃসংযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

এনবিআরের বিদ্যমান সব সিস্টেমের সঙ্গে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে যুক্ত করার পরিকল্পনায় রয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান ডিপিডিসি ও ডেসকো, বিআরটিএ, প্রধান আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের দপ্তর (সিসিআইঅ্যান্ডই), ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি), বিডা, বেপজা, বেজা, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বাংলাদেশ ব্যাংক, আইবাস++, বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংক, সিটি কর্পোরেশন, ভূমি মন্ত্রণালয় ও বিটিআরসি ইত্যাদি।

এ বিষয়ে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারি ও বেসরকারি অন্তত ১৬ সংস্থার সিস্টেমে আন্তঃসংযোগ স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে। উদ্দেশ্য সেবাগ্রহীতাদের প্রযুক্তি নির্ভর সেবা, নির্ভুল তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি প্রতিরোধ ও রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার হার কয়েকগুণ বৃদ্ধি করা। এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে করজাল আরও বড় হবে এবং রাজস্ব আদায় বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। বিদ্যমান ১ কোটি টিআইএন খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে দুই থেকে তিনগুণ হয়ে যাবে। বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় দ্রুতই এ কার্যক্রম শুরু হবে।

তিনি আরও বলেন, আমরা মনে করি শুধু বিদ্যুৎ, গ্যাস আর সিটি কর্পোরেশনের ডেটাবেজের সঙ্গে আন্তঃসংযোগ করতে পারলেই অন্তত দুই কোটি করদাতা বেরিয়ে আসবে। উদ্যোগটি সফল হলে রাজস্ব আহরণের সঙ্গে সম্পর্কিত সব সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের তথ্য ও সেবা শতভাগ অনলাইনে পাওয়া সম্ভব হবে।

মূলত আয়কর, ভ্যাট, আমদানি-রপ্তানি ও আবগারি শুল্ক আহরণের কার্যক্রম প্রযুক্তিনির্ভর পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও নিয়ন্ত্রণ করতেই এমন মহাপরিকল্পনার পথে হাঁটছে এনবিআর।

এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুনিম বলেন, আমাদের ১ কোটির বেশি টিআইএনধারী রয়েছে। কিন্তু রিটার্ন দিচ্ছে ৪১ লাখ মানুষ। করদাতার সংখ্যা কিন্তু বাড়ছে। আমরা চেষ্টা করছি, হঠাৎ করে বড় ধরনের জাম্প হয়ত দিতে পারছি না। তবে আমাদের চেষ্টার কমতি নেই।

তিনি বলেন, করজাল সম্প্রসারণের কাজে হাত দিয়েছি। তার মধ্যে একটি উদাহরণ দিতে পারি। বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ডিপিডিসিতে গ্রাহক ১০ লাখ ২১ হাজার। আমরা দেখলাম মাত্র ৩ লাখ ৬৫ হাজারের টিআইএন রয়েছে। তারাও নিয়মিত রিটার্ন দেন না। বাকি ৬ লাখ ৫৬ হাজার গ্রাহককে রিটার্ন দাখিলের আওতায় আনতে কাজ শুরু করেছি।

করের আওতা বাড়ানোর মাধ্যমে কর আদায় বাড়াতে এনবিআর জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে বিপুল সংখ্যক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর বা টিআইএন রেজিস্ট্রেশনের আওতায় এনেছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে টিআইএন’র আওতায় আনা হলেও রিটার্ন জমায় কাঙ্ক্ষিত সাড়া মেলেনি। এমন পরিস্থিতির মধ্যে প্রথমে ৩৮ খাতের সেবা নেওয়ার সময় রিটার্ন জমার প্রমাণ বা পিএসআর বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু তাতেও রিটার্ন জমার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি হয়নি। পরে আরও ছয়টি সেবা খাত যুক্ত করে ৪৪ ধরনের সেবা নিতে রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যার ইতিবাচক প্রভাব হিসেবে বর্তমানে টিআইএনধারীর সংখ্যা কোটি ছাড়িয়েছে।

এনবিআরের বিদ্যমান সব সিস্টেমের সঙ্গে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে যুক্ত করার পরিকল্পনায় রয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান ডিপিডিসি ও ডেসকো, বিআরটিএ, প্রধান আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের দপ্তর (সিসিআইঅ্যান্ডই), ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি), বিডা, বেপজা, বেজা, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বাংলাদেশ ব্যাংক, আইবাস++, বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংক, সিটি কর্পোরেশন, ভূমি মন্ত্রণালয় ও বিটিআরসি ইত্যাদি

পাশাপাশি করের আওতা বাড়াতে ও কর ফাঁকি বন্ধ করতে মোটরযান ও নৌযান নিবন্ধন, সব ধরনের ট্রেড লাইসেন্স এবং ঠিকাদার তালিকাভুক্তি কিংবা নবায়নে আয়কর রিটার্ন বাধ্যতামূলক করতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ২০২২ সাল থেকে চিঠি চালাচালি করে আসছে এনবিআর।

বর্তমানে বিআরটিএ থেকে গাড়ি মালিকদের আর জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর থেকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের ডেটা নিয়ে তথ্য যাচাই করার সুযোগ পাচ্ছে এনবিআরের আয়কর বিভাগ। যার সুফল আসতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন কর কর্মকর্তারা।

আয়কর আইন-২০২৩ অনুযায়ী ই-টিআইএন থাকলে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ দাখিল না করার সুযোগ নেই। কিন্তু অনেকেই আয় গোপন ও কর পরিহারের উদ্দেশ্যে রিটার্ন দাখিল থেকে বিরত থাকছেন। সর্বশেষ তথ্যানুসারে দেশে টিআইএনধারীর সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়েছে। যার মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন ৪১ লাখ ৪৫ হাজার ব্যক্তি।

আরএম/এসএসএইচ